পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের উত্থান ও পতন
টানা ২৭ ঘণ্টার ম্যারাথান জিজ্ঞাসাবাদ। শেষ পর্যন্ত শনিবার সকালে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করল ইডি। জিজ্ঞাসাবাদে অসংগতি থাকায় প্রথমে আটক, তারপর গ্রেফতার।
এ যেন সাপলুডো খেলা। তবে এই খেলা বিধাতার সঙ্গে নয়, চলছে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে কেন্দ্র করে। এতদিন মই বেয়ে তরতরিয়ে উঠছিলেন। কেউ কেউ বলেন, মাথায় ছিল দিদির হাত। এতদিন বিতর্কে তাঁর নাম জড়ালেও মমতার দলের মহাসচিবের কেউ কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেনি। কিন্তু দুর্নীতির শিকড় ক্রমে ক্রমে গভীরে পৌঁছেছে। তাই কি তাঁকে ঢাল দিয়ে আড়াল করতে পারলেন না মমতা? গ্রেফতার হতেই হলো?
টানা ২৭ ঘণ্টার ম্যারাথান জিজ্ঞাসাবাদ। শেষ পর্যন্ত শনিবার সকালে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করল ইডি। জিজ্ঞাসাবাদে অসংগতি থাকায় প্রথমে আটক, তারপর গ্রেফতার। জানা গেছে ইডি সূত্রে। দোতলার ঘর থেকে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীকে নামিয়ে একতলায় বসানো হয়। তারপর পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে বের করে নিয়ে যাওয়া হয় সিজিও কমপ্লেক্সে।
তাঁর বাড়ি থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বেশ কিছু নথি। নাকতলার বাড়িতে মোতায়েন করা হয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। শুক্রবার রাত ১০টা নাগাদ প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর আইনজীবীকে ডেকে পাঠায় তদন্তকারী সংস্থা। একজন ইডি আধিকারিক আসেন পার্থর নাকতলার বাড়িতে। তাঁর সঙ্গে আসেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান। দিনভর জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেফতারি।
আরও পড়ুন: স্রেফ ভয় দেখানো নয়, ২০ কোটি উদ্ধার বলছে লক্ষ্য আরও গভীর…
পার্থর উত্থান
রাজনীতির সঙ্গে পরিচয় কলেজজীবনেই। কিন্ত তাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া অনেক পরে। এ-যাবৎ আক্ষরিক অর্থেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছায়াসঙ্গী ছিলেন তিনি। কিন্তু দুর্নীতি মামলায় নাম ওঠায় নেত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না বলে দাবি পার্থর। দীর্ঘ রাজনৈতিক কেরিয়ারে এর আগে তাঁকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি।
রাজ্য রাজনীতির ভরকেন্দ্র কলকাতা শহরেই জন্ম পার্থর। পড়াশোনা নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে। এরপর আশুতোষ কলেজে অর্থনীতি পড়ে শেষ করে এমবিএ। কলেজজীবনেই সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান। কার্যত দাদা-ভাইয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কিন্তু পরে দীর্ঘ বিচ্ছেদও হয়। সংসার চালাতে মোটা বেতনের কর্পোরেট চাকরি বেছে নিয়েছিলেন পার্থ। চাকরি করতেন অ্যান্ড্রিউ ইউলে-র মতো বহুজাতিক সংস্থার উঁচু পদে। পরে মমতার পাশে থাকতে রাজনীতিতে প্রবেশ। মমতা সরকারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের দায়িত্বে দেখা গেছে পার্থকে, যেমন শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা, উচ্চাশিক্ষা পরিষদীয়।
তিনি সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস দলের রাজনীতিবিদ। ২০১১ সালের ২০ মে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন রাজ্য মন্ত্রিসভার ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা ছিলেন। ২০১১ সালে তিনি বিধানসভার শাসক তৃণমূল কংগ্রেস পরিষদীয় দলের উপনেতা নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে তিনি বেহালা পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন। ২০০৬ সালে পুনরায় ওই কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হন। ২০১১ সালে তিনি বেহালা পশ্চিম থেকেই ৫৯,০২১ ভোটের ব্যবধানে জিতে টানা তিনবারের বিধায়ক নির্বাচিত হন। ব্রাত্য বসুর পর তিনি উচ্চশিক্ষা ও স্কুলশিক্ষা বিভাগের মন্ত্রী হন, ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস জয়লাভ করে সরকার গঠন করার পরও যা বহাল থাকে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, তার ওপর দলের মহাসচিব, রাজ্যের এমন ডাকসাইটে নেতা কিন্তু বিভিন্ন সময় বিতর্কেও জড়িয়েছেন। কেউ কেউ বলেন, এর পরেও দিদির ছায়াসঙ্গী হওয়ায় তাঁকে রসাতলে টেনে নিয়ে যেতে পারেনি ইডি, সিবিআই। এবার কেঁচো খুঁড়তে বেরলো কেউটে। পার্থ-ঘনিষ্ঠর বাড়ি থেকে উদ্ধার একেবারে রাশি রাশি টাকা। সোশ্যাল মিডিয়ায় টাকার পাহাড় দেখে রাজ্যবাসীর ভিরমি খাওয়ার জোগাড়!
বারবার বিতর্ক
এর আগে আইকোর মামলায় নাম জড়িয়েছিল পার্থর। তদন্তে নেমে সিবিআই জানায়, আইকোর অনুষ্ঠানের মঞ্চে দেখা গিয়েছিল পার্থকে। তার জন্য তাঁকে ডেকে পাঠায় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার অনুষ্ঠানে কী কারণে উপস্থিতি, তা জানতেই তাঁকে তলব করা হয় বলে সিবিআই সূত্রে খবর। প্রথমে তাঁকে তলব করা হলে তিনি হাজিরা দেননি। বিধানসভা ভোটের প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন বলে সিবিআই তলব করলেও হাজির হননি তৃণমূলের মহাসচিব। আইকোর মামলায় ইডিও তলব করে পার্থকে। পরে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শিল্প সদনেও যায় সিবিআই টিম।
শিক্ষায় রাজনীতিকরণের বিতর্ক ওঠে পার্থ শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীনই। সাড়ে তিন দশকের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতির কবল থেকে মুক্ত করবেন। বিরোধীদের অভিযোগ, এতগুলো বছর কেটে গেলেও শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ বন্ধ তো হয়ইনি, উল্টে তার বহর বেড়েছে। এমনকী, কেউ কেউ বলেন, তা বাম জমানাকে ছাপিয়ে গেছে। কয়েক বছর আগে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে এসে প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী রাজ্যের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে সামনে রেখে শিক্ষার রাজনীতিকরণ নিয়ে সরকারকে আক্রমণ করেন। তিনি বলেন, এব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপ করা উচিত। যদিও এই নিয়ে বারবার পরিস্থিতি জটিল হলে পার্থর সাফাই, শিক্ষায় রাজনীতিকরণের প্রশ্নই নেই।
সম্প্রতি এসএসসি নিয়োগ মামলার তদন্তে তাঁর নাম উঠে আসে। সেই আবহে দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান থেকে থেকে পার্থকে ছেঁটে ফেলন মমতা। নিজের মর্জিমতো চললে দলে 'ঘ্যাচাং ফু' হয়ে যেতে সময় লাগবে না বলে জানান মমতা। এসএসসি মামলায় লাগাতার কোর্টে চক্কর কাটতে হয় পার্থকে। শুক্রবার রাতে ইডি-র তরফে ট্যুইট করে বলা হয়, মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে নগদ ২১ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে। ডায়মন্ড সিটির বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ উদ্ধার হয়েছে বলে ইডি জানায়। মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠর বাড়ি থেকে বিপুল সোনা, বৈদেশিক মুদ্রা, ২০টি মোবাইল ফোনও উদ্ধার হয়েছে। খতিয়ে দেখা হচ্ছে মোবাইলের কল লিস্ট। এত বিপুল টাকার উৎস কী, এসএসসি দুর্নীতির সঙ্গে এর যোগ আছে কি না, তাও খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
এসএসসি গ্রুপ ডি এবং নবম, দশম শ্রেণির শিক্ষক দুর্নীতি মামলায় রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করার আর্জি জানায় সিবিআই। পার্থকে সিবিআই দফতরে হাজিরার নির্দেশ দেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। ১২ এপ্রিল হাজিরা দিতে বলা হয় তাঁকে। প্রয়োজনে, রাজ্যের হেভিওয়েট মন্ত্রীকে গ্রেফতারের ছাড়পত্র দিয়েছিল আদালত।
এদিকে ইডিও তদন্তে নামে। টাকার বিনিময়ে নিয়োগের অভিযোগ সামনে আসে। ইতিমধ্যে মামলাকারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ইডি যেসব তথ্য পেয়েছে, তাতে টাকার বিনিময়ে কম নম্বরপ্রাপ্ত ও অনুত্তীর্ণদের কেন চাকরি দেওয়া হয়েছে, তা জানতে চাইছে ইডি। এতে শিক্ষা দফতরের একাংশ এবং জেলা স্তরে এই চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন, তাঁরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন বলে অভিযোগ। দফতরের তৎকালীন মন্ত্রী হিসেবে এই আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি সম্পর্কে তিনি কি অবগত ছিলেন? এই লেনদেন থেকে তিনি কোনওভাবে লাভবান হয়েছেন?
ইডির জেরায় উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য, দুর্নীতির জাল অনেক দূর ছড়িয়েছে। বিরোধীরা গলায় জোর পেয়েছে। তারা বলতে শুরু করেছে, কান টানলে মাথা আসবে না তো! তৃণমূল অস্বস্তি সামলাতে কার্যত দিশাহারা। এভাবে রাঘব বোয়াল জালে ওঠা বেশ বিপদেই ফেলেছে তাদের।