'সৃষ্টির তাড়নাই আমার কাছে যৌনতা', বলেছিল প্রসেনজিৎ
Prasenjit weds Rituparna: ‘প্রসেনজিৎ ওয়েডস ঋতুপর্ণা', এই ঘোষণা ও আমন্ত্রণ আমার মধ্যে ঈর্ষা জাগাবে না, এমন অমানুষ আমি হতে পারিনি।
যাক, বাঁচা গেল! বিরাশি বছর বয়সে পৃথিবীর সবথেকে দুর্ভাগা, সবচেয়ে বিপন্ন বিয়ের নেমন্তন্নটা পেলাম। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় বিয়ে করছে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে। ইংরেজি নেমন্তন্নপত্র। প্রসেনজিৎ ওয়েডস ঋতুপর্ণা। বুম্বা আর ঋতু, দু'জনেই খুব ভালো মানুষ। আমি দু'জনকেই ওদের ভালোত্বের জন্য ভালবাসি। দু'জনেই খুব মিষ্টি মানুষ। আমি ওদের ভালবাসি মাধুর্যের জন্য, যে হিরের টুকরো মধুরিমা পৃথিবী থেকে প্রায় লুপ্ত। এখন মানুষের ব্যবহারের গায়ে হয় ব্যাঙের ছাতা, নয় ক্যাকটাস। কুকথার ডালপালায় এখন শুধু নিমফল। বুম্বা আর ঋতুপর্ণা, মিষ্টি ভাষার রাজা-রানি। তাই ওদের বিয়েতে আমার ভারি ভয়। বিয়ে মানেই তো নরক! দু'বার বিয়ে করে, বিয়ে ভেঙে, হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। বুম্বা আর ঋতু সেই নরকে গিয়ে হারিয়ে ফেলবে না তো ওদের ভালোত্ব, গুডনেস, গ্রেস, মাধুর্য, মিষ্টত্ব! বিয়ের মতো ধ্বংসাত্মক আর কিছু হয় না।
তাই আমার সত্যি ভয়ে বুক কাঁপল বুম্বা-ঋতুর বিয়ের নেমন্তন্ন পেয়ে। তবে ওদের বিয়ের নেমন্তন্ন আমি মিস করব না একটাই কারণে। কারণটা শুনলে আপনারা অবাক হবেন। আমি যে-বিয়ের নেমন্তন্নে যাই, সেটাই চুরমার হয়। চুরমার বিয়ন্ড রিপেয়ার। আমি চাই বুম্বা-ঋতুর অন্বয়ও তাড়াতাড়ি যেন ভেঙে যায়। যেন বেশিদিন ওদের বিয়ের কষ্ট সহ্য করতে না হয়। দুটো বড়সড় বিয়ে আমার অপয়া উপস্থিতির ডায়নামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছি। চার্লস আর ডায়নার বিয়ে। আমি উপস্থিত ছিলাম। অ্যানড্রু আর সারার বিয়ে। আমি উপস্থিত ছিলাম। রানি এলিজাবেথ আমার ওপর সেই যে চটলেন, আমৃত্যু চটেই থাকলেন অপয়া আমার ওপর! সুতরাং আমি যাচ্ছিই বুম্বা-ঋতুর বিয়েতে। ভাঙুক এ-বিয়ে তাড়াতাড়ি!
একটি গূঢ় সত্য স্বীকার করতেই হবে। সত্যটি হলো, বুম্বা-ঋতুর বিয়ে কিন্তু আমার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনের গল্পে একটা সত্যি সত্যিই সরণিচিহ্ন হয়ে থাকল। ‘সরণিচিহ্ন’ শব্দটি অনেকের কাছে গ্রিক মনে হতে পারে। তাই সহজ বাংলায় বলি, ‘ল্যান্ডমার্ক’! কত কী লেখার আছে বলুন তো এই বিয়ে নিয়ে! বাকি জীবন ক্রমাগত লিখতেই থাকব হয় বুম্বা-ঋতুর বিয়ের প্রসঙ্গে। এবং সেই প্রসঙ্গে প্রাথমিক আলোচনাটা বরং আজও লিখে ফেলি। ভাবনা, পর্ব ১, কোথায় যাবে বুম্বা-ঋতু, জায়াপতি, মধুচন্দ্রিমায়। কোথায় কাটাবে বিয়ের পরেই প্রথম রাত, প্রথম দিন! বলে দিচ্ছি, একুশ দিন ধরে তর্কাতর্কি, বাকবিতণ্ডা, তোলপাড়ের পর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছবে বাংলা সিনেমার শ্রেষ্ঠ নায়ক-নায়িকা। বুম্বা যাবে সাউথ পোল, দক্ষিণ মেরুর সবথেকে আবছা, গাঢ়, বিপজ্জনক স্থানে। আর ঋতু যাবে স্পেনে, ট্যাঙ্গো আর রোদ্দুরের আঁচ পোহাতে। তবে এহেন সোলো- মধুচন্দ্রিমার শেষে (‘মধুচন্দ্রিমা’ শব্দটি যাদের কাছে গ্রিক, সেই বাঙালিদের জন্য চলতি বাংলা হলো ‘হানিমুন’) বুম্বা-ঋতু পরস্পরকে তাদের একক নলেনগুড়-চাঁদের গল্প বলতে শেষ পর্যন্ত মিলিত হবেই হবে প্যারিসে, তুলুস লোত্রেক-এর স্মৃতিস্নাত ‘মুলারুজ’-এ, শ্যাম্পেন স্রোতে!
আরও পড়ুন: পতৌদি-শর্মিলার প্রাইভেট রুমে বজ্রপাত! বিখ্যাত দাম্পত্যের বিস্ফোরক সত্যি
কী কেলো করলাম বলুন তো ! বুম্বা-ঋতুর ‘হানিমুন’ ভাবলাম, অথচ ওদের অব্যূঢ়ান্নর কথা ভাবলাম না। ‘অব্যূঢ়ান্ন’! সরি, বারবার আমার শব্দগুলিকে গ্রিক মনে হচ্ছে তো? তাহলে আসুন বাংলা মেছোমিতে। ‘আইবুড়োভাত’! কী বিশ্রী শব্দ! এবং আমি যত দূর জানি, ‘বুড়ো’ শব্দটিতে বুম্বা-ঋতুর ঘোর আপত্তি। বেশিরভাগ বাঙালিই তো বুড়ো হয়ে জন্মায়। আমি বুম্বা-ঋতুকে যত দূর জানি, ওরা অন্তত একটি জায়গায় বাঙালি নয়। ওরা বুড়োমিতে নেই। ওরা আজীবন তরতাজাবাদী। ওরা জলজ্যান্ত তারুণ্য! ওরা চাঁদের আলোয় চিকচিকে রেললাইন। প্যারালাল দৌড়। অনন্তে মিলন। ইউক্লিড পুরোহিত প্যারালাল সেই দৌড়ের আনন্তিক মিলনে। নিখাদ জ্যামিতি। বিয়ে কি হতে পারে ওদের? বুম্বা-ঋতু: বিয়ে ! খুব ঈর্ষা হচ্ছে আমার। দু'জনকেই যে ভালবাসি! আবার তাহলে ঝেড়ে কাশি।
বুম্বার বাড়িতে আমি। ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর জন্য একটি সাক্ষাৎকারের যাচক। কিন্তু ‘যাচক’ শব্দটির মধ্যে একটি অতনু তঞ্চকতা আছে। আমি ‘যাচনা’-র মসৃণতা বজায় রেখেছি বটে। কিন্তু আমি আসলে বুম্বাকে খুঁড়তে এসেছি। শাবল, কোদাল, এমনকী, মরাপাতা ছাঁটার কাঁচি, সব এনেছি সঙ্গে। মানুষ খুঁড়তে আমার খুব ভালো লাগে। আমার যে-কোনও সাক্ষাৎকারেই মানুষ-খোঁড়ার শ্রম আছেই আছে। এবং আছে মজা। এবং আছে নিষ্ঠুরতা। এবং আছে মায়া, মমতা, ভালবাসা। এবং শেষ পর্যন্ত আবিষ্কারের আনন্দ। বুম্বার বাড়ি, বা দুর্গও বলা যায় হয়তো– তার গঠন দেখে আমি অবাক। কেমন যেন খণ্ডে খণ্ডে তৈরি নিরালা, ব্যক্তিগত আড়াল, নিজস্ব পরিসরের নানা রূপ ও আবহ। কিন্তু সমস্তটাজুড়ে বিস্তারিত বুম্বার ব্যক্তিত্ব, স্বাতন্ত্র, প্রাতিস্বিকতা ও মৌলিক নিলয়মনন! এবং তার শিল্পিত জীবনদর্শন। এই রকম নিজস্ব ভাবনার প্রিয়মান বাসা প্রথম দেখলাম।
আমি জানতে চেয়েছি, বুম্বার জীবনে কোনও অনিশ্চয়তা আছে কি না। বুম্বা সংক্ষেপে বলেছে, জীবনের আসল চার্ম তো তার অনিশ্চয়তাতেই। তাই তো জীবন প্রতি মুহূর্তে নতুন। জানতে চেয়েছি, যে কোনও শিল্পই সেক্সুয়ালিটির প্রকাশ। অভিনয়েও যৌনতার প্রকাশ ঘটে। বয়সের সঙ্গে কোনও সমস্যা হচ্ছে না? হাসতে হাসতে বুম্বার উত্তর, বরং সমস্যা কমছে। যত বয়স বাড়ছে, ততই বাড়ছে আমার ক্রিয়েটিভ আর্জ, সৃষ্টির তাড়না। সেটাই আমার সেক্সুয়ালিটি। দ্যাট ক্রিয়েটিভ আর্জ। সুতরাং, বয়স বেড়ে আমার অনেক সমস্যার সমাধানই করেছে। এই উত্তর শুনে আমার অবস্থা হলো মালির মতো। মালি প্রথমে অনেক খোঁড়াখুঁড়ি করে। তারপর লতাপাতায় ছড়ায়। ফুল ধরে। মালি বাগানের প্রেমে পড়ে। আমার অবস্থাও তা-ই হলো। আমি শাবল-কোদাল সরিয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে বাগানে শুয়ে পড়লাম। বুম্বার প্রেমে পড়লাম।
বুম্বা আমার সব অনুষ্ঠানে এসেছে। ডেকেছি, আসেনি, আজও হয়নি। আমার অনেকগুলি বইয়ের উদ্বোধন হয়েছে বুম্বার হাতেই। এবং বুম্বার এটা মস্ত বড় গুণ, ওর সময়জ্ঞান চমকে দেওয়ার মতো অসামান্য। একবার বুম্বা এল তার জন্মদিনে আমার একটি বই উদ্বোধন করতে। এবং বুম্বার জন্মদিনের কেক কাটা হলো সেই বই-উন্মোচন অনুষ্ঠানে।
বুম্বাকে ভালবাসার আর একটি কারণ, ওর অনায়াস ব্যবহারিক মধুরিমা। বাঙালির সংস্কৃতি থেকে এই মধুরতা ক্রমশ উধাও হয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয় বুম্বাও কষ্ট পায় আমারই মতো। এবং ও যে নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছে নিজস্ব নিভৃতিতে, তার কারণ হয়তো বাঙালির এই শ্রীহীন কর্কশতা। বুম্বার হৃদয়েও নিশ্চয় আমারই মতো নীরব বহতায় একটি গভীর যাচনা, ফিরে আসুক বাঙালির হারানো সংস্কৃতি, হারিয়ে যাওয়া কোমল শ্রীময়তা!
অন্য একটি সাক্ষাৎকারের কথা বলি এবার, ঋতুর সাক্ষাৎকার, গঙ্গার তীরে, তার নিজস্ব শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত, বিলাসবহুল মেক-আপ ভ্যানে। ঋতু তৈরি করতে পারে তার নিজস্ব মায়াভুবন। ঋতু ছড়িয়ে দিতে পারে তার নিজস্ব বহতা, চোরাস্রোত, টান। ঋতু সত্যিই ভুলিয়ে দিতে পারে আমাদের বয়সের ফারাক, ভ্রূ-ভঙ্গিতে ডাক দিতে পারে চন্দনের বনে! গঙ্গার তীরে ঋতু সেদিন বলেছিল, সহস্র মানুষের মাঝে তার নিভৃত দুঃখ, প্রকাশবিহীন একাকিত্বের কথা। ঋতুর উচ্চারিত শব্দগুলি ফুলের মতো ঝরে পড়েছিল আমার মনের মাটিতে। ঋতুর প্রেমে পড়েছিলাম।
তাই ‘প্রসেনজিৎ ওয়েডস ঋতুপর্ণা', এই ঘোষণা ও আমন্ত্রণ আমার মধ্যে ঈর্ষা জাগাবে না, এমন অমানুষ আমি হতে পারিনি।
*'প্রসেনজিৎ ওয়েডস ঋতুপর্ণা' সম্রাট শর্মা পরিচালিত আসন্ন বাংলা ছবি, যা মুক্তি পাবে ২৫ নভেম্বর।