আজও বাঘের চোখে চোখ রেখে জঙ্গলে পা ফেলেন সুন্দরবনের 'বাঘ বিধবা'-রা
একদিকে বাঘের উৎপাত, সরকারি উদ্যোগের অভাব, অন্যদিকে জনবসতির বিপুল চাপ- সব নিয়েই একা নিজেদের পরিবারের মুখে অন্ন জোগানোর লড়াই করে চলেছেন ‘বাঘ বিধবা'-রা।
বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি
-সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
নদীর ধার ঘেঁষে একের পর এক জনপদ। কুলতলি, গোসাবা, সাতজেলিয়া, পাথরপ্রতিমা। এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা-উপার্জন বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করেই। বেশিরভাগ সময়েই বাঘ-মানুষের টানাটানিতে বাঘ জিতে যায়। ‘ভয়ংকর সুন্দর’ সুন্দরবনে এই নিয়তি মেনে নিয়েই দিন কাটাচ্ছেন শিখা মন্ডল, নমিতা মন্ডল এবং আরও অনেকে। সুন্দরবনের স্থানীয় মানুষের ভাষায় এরা ‘বাঘ বিধবা’। প্রান্তিক জীবনের এক নিরবচ্ছিন্ন লড়াইয়ের নাম বাঘ বিধবা। গত কয়েক বছরে বাঘের আক্রমণে সুন্দরবনে প্রাণ হারিয়েছেন বহু মানুষ। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বাঘ বিধবাদের সংখ্যা। পরিবারের একমাত্র রোজগেরে পুরুষ বাঘের হাতে প্রাণ খোয়ানোয় সন্তান-সন্ততি নিয়ে বাঘ বিধবাদের বেশিরভাগই বুকফাটা হাহাকার নিয়ে কোনওরকমে দিন কাটাচ্ছেন।
২০১৫ সালের নভেম্বর মাস। নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন গোসাবার শিখা মন্ডলের স্বামী অসিত মন্ডল। আর ফেরেননি। শিখার কথায়, ‘আরও দুজনের সঙ্গে বাগানবাড়ি জঙ্গলের গড়াল নদীতে কাঁকড়া ধরতে গিয়েছিলেন আমার স্বামী। ওখানেই ওকে বাঘে ধরে নিয়ে গেছে। আমার স্বামীই ছিলেন আমাদের পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্য’। স্বামী অসিত মন্ডলের মৃত্যুর পর দুই নাবালক পুত্র সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করছেন ‘বাঘ বিধবা’ শিখা মন্ডল। স্বামীর মৃত্যুর পর সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলেন শিখা মন্ডল। কিন্তু আইনি জটিলতায় টাকা পাওয়া হয়ে ওঠেনি তার। বর্তমানে কাঁকড়া ও চিংড়ি ধরে সন্তানদের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন শিখা।
এই একই ছবি সুন্দরবনের বেশিরভাগ অংশের। প্রায় ৪২০০ বর্গ কিমি জায়গাজুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবন পৃথিবীর দীর্ঘতম এবং গভীরতম ম্যানগ্রোভ অরণ্য। সঙ্গে রয়েছে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। সুন্দরবনে বর্তমানে ৯৬টি বাঘ রয়েছে। হিঙ্গলগঞ্জ, গোসাবা, কুলতলি, পাথরপ্রতিমা এবং বাসন্তী এলাকার মানুষের জীবনস-জীবিকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জঙ্গল। এই প্রত্যেকটি এলাকাই সুন্দরবনের মূল জঙ্গলের খুব কাছাকাছি। সুন্দরবনের প্রায় ১৭০০ বর্গ কিমি এলাকা জঙ্গলের কোর এরিয়া আর বাকি ৯০০ বর্গ কিমি হলো বাফার এরিয়া।
আরও পড়ুন: শত সংঘাতের পরেও সুন্দরবন জানে, বাঘ না বাঁচলে বাঁচবে না সাধের জঙ্গল
জঙ্গলের মূল অংশ বা কোর এরিয়ায় গ্রামবাসীদের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমনকী, বাফার এরিয়ায় প্রবেশ করতে এলে নিতে হয় বন দফতরের লিখিত অনুমতি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রামের মানুষ জীবিকার টানে জঙ্গলের মূল অংশে ঢুকে পড়ে। জঙ্গলের ওইসব অংশে বাঘের উপস্থিতি তুলনামূলক বেশি। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারান সুন্দরবনের বেশিরভাগ মৎস্যজীবী বা মধু সংগ্রহকারী। এখানেই তৈরি হয় আইনি জটিলতা। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী যেসব মৎস্যজীবী বা মধু সংগ্রাহক জঙ্গলের কোর এরিয়ায় যাবেন, বাঘের আক্রমণে তাঁদের মৃত্যু হলে কোনও সরকারি ক্ষতিপূরণ মিলবে না। আবার বাফার এরিয়ায় যেসব মৎস্যজীবী যাবেন, তাদের ক্ষেত্রে থাকতে হবে বন দফতরের অনুমতি এবং বোটের ক্ষেত্রে থাকতে হবে সরকারি লাইসেন্স। সুন্দরবনের বেশিরভাগ মৎস্যজীবী বন দফতরের থেকে লিখিত অনুমতি নেয় না এবং তাদের বোটের লাইসেন্সও সঠিকভাবে দেখাতে পারে না। ফলে বাঘের আক্রমণে স্বামী প্রাণ হারালেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষতিপূরণ জোটে না ‘বাঘ বিধবা'-দের।
শিখা মন্ডলের মতোই এক পরিস্থিতি বিজয়নগর গ্রামের নমিতা মন্ডলের। নমিতা মন্ডলের স্বামী অরুণ মন্ডল মাছ ধরতে গিয়েছিলেন নদীতে। সেখানেই বাঘের আক্রমণে মারা যান তিনি। বাঘের আক্রমণে স্বামীকে হারালেও জীবিকার জন্য জঙ্গল যাওয়া তখনই ছাড়তে পারেননি নমিতা। নিজের তিন মেয়ের মুখে ভাত জোটাতে কাঁকড়া ধরতে গভীর জঙ্গলে যেতেই হতো নমিতাকে। নমিতার কথায়, "আমার তিন মেয়েই খুব ছোট। জঙ্গলে যাওয়ার আগে সবসময়ই মাথায় বাঘের আক্রমণের চিন্তা থাকত। কিন্তু খাবার জোটাতে গেলে জঙ্গলে যাওয়া ছাড়া আমার কাছে আর কোনও উপায় ছিল না।" অবশেষে একদিন এক বেসরকারি এনজিও তাকে মাছের চারা কিনে স্থানীয় পুকুরে মাছ ধরা শেখায়। তার পর থেকে নমিতা মন্ডল মাছ ধরে এবং বিক্রি করেই সংসার চালান। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর আইনি জটিলতায় ক্ষতিপূরণ মেলেনি নমিতারও। নমিতার পাশেই থাকেন আরেক বাঘ বিধবা সুবলা মন্ডল। স্বামী মারা যাওয়ার পর তাকেও মাছ ধরতে, মধু আনতে গভীর জঙ্গলে যেতে হতো। কিন্তু এক স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সহায়তায় বর্তমানে মৌমাছি প্রতিপালন করেন সুবলা। সুবলা বলেন, "স্বামী মারা যাওয়ার পর প্রথম প্রথম পেটের টানে আমাকে জঙ্গলে কাঁকড়া শিকার করতে যেতে হতো। কিন্তু তারপর মৌমাছি প্রতিপালনের কাজ শিখলাম। এখন এখান থেকেই মাসে ছয়-সাত হাজার টাকা রোজগার হয়। আমাকে আর এখন জঙ্গলে যেতে হয় না।"
বিজয়নগর গ্রামের বেশিরভাগ অংশজুড়েই জঙ্গল। এখানে প্রতি মুহূর্তেই বাঘের সঙ্গে লড়ে জীবনধারণ করতে হচ্ছে মানুষকে। যত জঙ্গলে বসতির চাপ বাড়ছে, মানুষ তত বেশি জঙ্গলে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে 'বাঘ বিধবা'-র সংখ্যা। শেষ কয়েক বছরের পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে সুন্দরবন অঞ্চলে বাঘ বিধবার সংখ্যা প্রায় ৩০০০ জন, অর্থাৎ প্রত্যেক বছর গড়ে ১০০ জন করে মহিলা বাঘের কারণে বৈধব্যের স্বীকার হচ্ছেন।
এই পরিস্থিতিতে সরকারি পুনর্বাসন প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে বাংলা ওয়েব প্ল্যাটফর্ম হইচই-এর একটি সিরিজ ‘সুন্দরবনের বিদ্যাসাগর'-এর চিত্রনাট্যকার অর্কদীপ নাথ বলেন, "আমি এই ওয়েব সিরিজের সূত্রে দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়েছি। কিন্তু বাঘ বিধবাদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে সরকারের কোনও জোরালো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। তবে কিছু বেসরকারি এনজিও নিজেদের উদ্যোগে এই মহিলাদের জন্য বেশ কিছু ভালো কাজের ব্যবস্থা করেছে। আবার সব এনজিও যে বিশ্বস্ত, এমনটাও নয়। তবে আগের থেকে অবস্থা বদলাচ্ছে।"
প্রত্যেক বছর কীভাবে এত মানুষ মরছে, বাঘের বিষয়ে সেখানে গ্রামবাসীদের সচেতনতার পাঠ কত দূর, এই বিষয়ে অর্কদীপ নাথ বলছেন, "সুন্দরবনে যেভাবে জনবসতি বাড়ছে, বাঘের জন্য বরাদ্দ জঙ্গল কমছে, তাতে ভবিষ্যতে এই আক্রমণ আরও বাড়বে। ট্যুরিজমের চাপে সুন্দরবনের নাভিশ্বাস উঠেছে। সরকার জঙ্গলে যাওয়ার জন্য নিষেধ করলেও বিকল্প রুটি-রুজির ব্যবস্থা না হলে মানুষ তো জঙ্গলে যাবেই।"
একদিকে বাঘের উৎপাত, সরকারি উদ্যোগের অভাব, অন্যদিকে জনবসতির বিপুল চাপ- সব নিয়েই একা নিজেদের পরিবারের মুখে অন্ন জোগানোর লড়াই করে চলেছেন ‘বাঘ বিধবা'-রা।