প্রেমের চেয়ে বড় বন্ধুতা? বলিউডে না হলেও বাংলা সাহিত্যে

হিন্দি সিনেমা, জনপ্রিয় মূলধারার হিন্দি সিনেমা যেভাবে বন্ধুত্ব আর প্রেমের ঠাঁই বদল করে, সাহিত্য সেভাবে করে না।

আপনারা যাঁরা শাহরুখ খানের হিন্দি সিনেমায় দুলেছেন, তাঁরা জানেন ফার্স্ট হাফে যে বন্ধু, সেকেন্ড হাফে সেই প্রেমিকা ও বধূ। শুধু মরে যেতে হবে নমনীয়-কমনীয় রানি মুখার্জিকে, শুধু টম বয় কাজলকে জেগে উঠতে হবে লম্বা চুল আর শাড়িতে। তাহলেই সামার ক্যাম্পের বাস্কেট গ্রাউন্ডে হ্যাপি এন্ডিং, নিরাপদ প্রেম, অতঃপর বিবাহ। সিনেমার ফার্স্ট হাফে দুই বন্ধু শাহরুখ আর টম বয় কাজলের মাঝে রানি মুখার্জির আগমন। শাহরুখের মন উচাটন, সখ্য আর মধুর– এই দুইয়ের মধ্যে যে মধুর ওপরে। তাই রানি মুখার্জি আর শাহরুখ ওপরে এবং ঐকান্তিক নিভৃতে, মনকেমন কাজল চলে গেল। চলে গেল, কিন্তু সে চলে যাওয়ায় শেষ হল না ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’-এ। সে-ছবি পুরুষের ভরপুর জীবন উপভোগের ছবি, সুতরাং সেকেন্ড হাফ শাহরুখ-কাজলের জন্য। টম বয় কাজলের বেশ বদল হল, পুরুষকে উসকে দেওয়ার জন্য নারী– দীর্ঘ চুল আর শাড়িতে তন্বী শ্যামা, সখ্যর ধাপ থেকে শাহরুখের মধুরে উত্থান।

বন্ধুত্ব শাহরুখ-কাজলের হিন্দি সিনেমায় প্রেম হয়ে উঠল, উঠল, কারণ কাজল সেটাকে একটা সময়ের পর থেকে প্রেম হিসেবেই ভাবতে চেয়েছিল, শাহরুখ রানি মুখার্জি আছে বলে ও তার কাছে নারী হিসেবে রানি গ্রহণযোগ্য বলে কাজলকে নাকচ করে দেয়। রানি মুখার্জি মরে গেলে ও কাজল মোহময় মেয়ে হয়ে উঠলে শাহরুখ নিজেকে জাগিয়ে তুলতে আর আপত্তি করেনি। কেনই বা করবে! প্রয়োজন বড় বালাই।

Kuch Kuch hota hai

'কুছ কুছ হোতা হ্যায়' ছবির দৃশ্য

হিন্দি সিনেমা, জনপ্রিয় মূলধারার হিন্দি সিনেমা যেভাবে বন্ধুত্ব আর প্রেমের ঠাঁই বদল করে, সাহিত্য সেভাবে করে না।

আরও পড়ুন: ভালবাসা থাকলে ভালবাসার অত্যাচার থাকবেই, বুঝিয়েছেন বঙ্কিম

প্রেম নয়, বন্ধুত্ব যে কত গভীর ও সংবেদী, মহাভারতে দ্রৌপদী আর কৃষ্ণের সম্পর্ক তার প্রমাণ। যখনই দ্রৌপদী বিপদে পড়ে, তাকে রক্ষা করেন সখা কৃষ্ণ। কৌরবসভায় পাশাখেলার আসর বসেছে। আত্মবিস্মৃত যুধিষ্ঠির পণ রাখছেন ও পরাভূত হচ্ছেন। একসময় তিনি দ্রৌপদীকে পণ রাখলেন। শুধু পণই রাখলেন না, পণের দ্রব্যটির বর্ণনা দিতেও কসুর করলেন না। ধর্মপুত্র বললেন, "যিনি অতিখর্বা বা অতি কৃষ্ণা নন, কৃশা বা রক্তবর্ণা নন, যিনি কৃষ্ণকুঞ্চিতকেশী, পদ্মপলাশাক্ষী, পদ্মগন্ধা, রূপে লক্ষ্মীসমা, সর্বগুণান্বিতা, প্রিয়ংবদা সেই দ্রৌপদীকে পণ রাখছি।" যুধিষ্ঠির হেরে গেলেন। তখন দুঃশাসন একবস্ত্রা রজঃস্বলা দ্রৌপদীকে টানতে টানতে নিয়ে এলেন রাজসভায়। কর্ণ প্রকাশ্য রাজসভায় বললেন, "স্ত্রীদের এক পতিই বেদবিহিত, দ্রৌপদীর অনেক পতি, অতএব এ বেশ্যা।" সেই অবমাননার সময় দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করলেন যিনি, তিনি সখা কৃষ্ণ, দ্রৌপদীর বন্ধু। দ্রৌপদীকে ভালবাসেন তিনি, কিন্তু সেই ভালবাসা অধিকারবাচক মধুরের পক্ষে অগ্রসর হয়নি, তা সখ্যের মধ্যে স্থিতি লাভ করেছে। দুঃশাসন আর কর্ণ দ্রৌপদীকে অপমান করেছিলেন, কারণ দ্রৌপদীর স্বয়ংবর-সভার প্রত্যাখ্যান ও পরাভব স্মৃতি তাঁদের আহত পৌরুষকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তুলেছিল।

দ্রৌপদীকে আরেকবার রক্ষা করেছিলেন কৃষ্ণ। বস্ত্র দিয়ে রজঃস্বলা দ্রৌপদীকে আবৃত করেছিলেন যে কৃষ্ণ, সেই কৃষ্ণ বাঁচিয়েছিলেন দুর্বাসার অভিশাপ থেকে। পাণ্ডবরা তখন পাশাখেলায় হেরে বনবাসে। দুর্যোধন দুর্বাসাকে পাঠিয়ে দিলেন তাঁদের কাছে। স-শিষ্য দুর্বাসা হাজির। তখন দ্রৌপদীর আহার হয়ে গেছে। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির মুনি ও তাঁর শিষ্যদের স্নান করে আসতে বললেন, আহারে নিমন্ত্রণ জানালেন। একবারও ভাবলেন না, এতজনের খাবারের ব্যবস্থা কীভাবে করবেন দ্রৌপদী? এবারেও কৃষ্ণের শরণ নিতে হল। দ্রৌপদীর রন্ধন-পাত্রে লেগে থাকা অন্ন মুখে দিয়ে কৃষ্ণর পরিতৃপ্ত উদগার উঠল। আর তারপরেই সেই অলৌকিক কাণ্ড! সখা কৃষ্ণের পরিতৃপ্তি সঞ্চারিত হল দুর্বাসা আর তাঁর শিষ্যদের মধ্যে। তাঁরা পেট ভরে গেছে দেখে স্নান সমাপন করে লজ্জায় পালিয়ে গেলেন।

এই যে সখ্য, মহাকাব্যের সখ্য, অলৌকিক সহায়তার উদাহরণে যা পরিপূর্ণ, তা কি বাস্তবত হতে পারে না যুবক-যুবতীর মধ্যে! রমাপদ চৌধুরী লিখেছিলেন ‘দিনকাল’-এর মতো গল্প। সেই গল্পে ছেলেটি আর মেয়েটি বন্ধু। বাবা-মা অবশ্য তখনও তা ভাবতে পারেন না। তাঁরা ভাবতে থাকেন বন্ধুত্বের নির্ভারতা অতিক্রম করে সে সম্পর্ক একদিন মধুরে গিয়ে পৌঁছবে। গল্পের শেষে অবশ্য দেখা গেল বন্ধুত্বেই শেষ হল তা- মেয়েটির বিয়ের খবরে মোটেই ভেঙে পড়ল না ছেলেটি।


আমি আর অরুণা অন্তুর ঘরের দিকে তাকাতে পারলাম না। শুধু চুপ করে বসে রইলাম আতঙ্কে অপেক্ষায়। যেন এখনই একটা ভূমিকম্প হয়ে যাবে অন্তুর বুকের মধ্যে, এখনই একটা ভূমিকম্প হবে। হঠাৎ একটা হট্টগোল ভেসে এল ওর ঘর থেকে। চিৎকার, উল্লাস, হইহই। ‘তুমি একটা ইডিয়েট’, অন্তুর গলা। ‘নিরুপম, ভাল হবে না বলছি, তুমি না হলে...’
আমি অরুণার দিকে তাকালাম। অরুণা আমার চোখের দিকে তাকাল।
একটু পরেই অন্তু আর টুকটুক বেরিয়ে এল।
অন্তু চিৎকার করছে, ‘আচ্ছা বাবা, মা, তুমি বলো, স্টুপিড বলব না ওকে? ওর পরশু বিয়ে, একটা বন্ধুকে এখনো নেমন্তন্ন করেনি।’

রমাপদ চৌধুরীর ‘দিনকাল’ বন্ধুত্বের গল্প– সেখানে সম্পর্ক মধুরে ওঠেনি। ১৩৭৭ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত এই গল্পে রমাপদ বোঝাচ্ছিলেন, সম্পর্কের মধ্যে বদল এসেছে, ছেলে-মেয়ের মধ্যে সখ্য সম্ভব। মহাভারতের ধ্রুপদী জগতেই মাত্র নয়, বাস্তবেও বন্ধুতা সম্ভব– সম্ভব নর-নারীর মধ্যে। ১৯২৯ এ ‘শেষের কবিতা’-য় লাবণ্য প্রত্যাখ্যান করেছিল যে চিঠিতে, সে চিঠিতে অমিতকে বন্ধু বলে ডেকেছিল সে। তাদের সম্পর্কের মধুর তখন নেমে এসেছে সখ্যে। সেখানে এই বন্ধু ডাকের মধ্যে রয়েছে পূর্ব-প্রণয়ের প্রত্যাখ্যাত স্মৃতি।

এই যে সখ্য মধুরের তলায়, এ-কথাই তো ভাবতেন বৈষ্ণব রসশাস্ত্রীরা। শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য, মধুর- এভাবেই সম্পর্কের তলা থেকে ওপরে উঠেছিলেন তাঁরা। মধুর সবার ওপরে। সে মধুরে সখ্যের গুণ আছে, তবে আছে আরও কিছু, যা সখ্যে নেই। তাই মধুর শ্রেষ্ঠ। কেউ ভাবতেই পারেন তা, তবে সখ্যের যে সহজতা, সখ্যে যে পারস্পরিক নির্ভরতা তা কি কিছু কম! দ্রৌপদী-কৃষ্ণর পৌরাণিক উপাখ্যানের বাইরে রমাপদর দিনকাল– তা অবশ্য খুব ধ্রুপদী নির্ভরতার গল্প নয়, তবে বন্ধুত্বের গল্প। আর মন্দাক্রান্তার উপন্যাস ‘দলছুট’? সেখানে মনীষা নামের মেয়েটি বলে, সে বন্ধুত্ব-সন্ধানী। সে বন্ধুত্বের মধ্যে স্পর্শ আছে। 'নন্দন'-এ সৈকতের গালে অনায়াসে চুমু খায় মনীষা, বন্ধুত্বের চুম্বন। আদর করে– অযৌন বন্ধুত্বের আদর। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রীরা রতিকে সম্প্রয়োগ আর অসম্প্রয়োগ দু'-ভাগে ভাগ করেছিলেন। বন্ধুত্ব সেই অসম্প্রয়োগ বিষয়া রতি। স্পর্শ সেখানে থাকতে পারে, কিন্তু তা মধুরের সম্প্রয়োগের থেকে ভিন্ন।

যা প্রাগাধুনিক সাহিত্যে ও রসশাস্ত্রে উচ্চারিত, আধুনিক বাংলা সাহিত্য তা নতুনভাবে আবিষ্কার করছে। সাহিত্যের নর-নারী ও পাঠক নতুন করে বুঝতে চাইছে তা। এ যেন সম্পর্কের নতুন নির্মাণ নয়, হারিয়ে যাওয়া ভাবনার পুনর্নির্মাণ।

দুই সখার হেতুহীন আবেগের কথায় শেষ করা যাক। এবার আর নারী পুরুষ নয়, এবার দুই পুরুষের বন্ধুত্ব। ব্যোমকেশ আর অজিত। শরদিন্দু বাস্তবধর্মী বাংলা গোয়েন্দাকাহিনির এক অর্থে প্রথম সার্থক প্রণেতা। ‘ব্যোমকেশের ডায়েরী’ বইয়ের প্রথম গল্প ‘সত্যান্বেষী’-তে অজিত ভালবেসেছে অতুলরূপী ব্যোমকেশকে। সে ভালবাসার বয়ান তার কথনে স্পষ্ট।

আমার কিছু ভাল লাগিতেছিল না, উঠিয়া গিয়া নিজের ঘরে দ্বার বন্ধ করিয়া শুইয়া পড়িলাম। স্নানাহার করিবারও প্রবৃত্তি হইল না। ঘরের ওপাশে অতুলের জিনিষ-পত্র ছড়ানো রহিয়াছে – সেই দিকে চাহিয়া আমার চক্ষে জল আসিয়া পড়িল। অতুলকে যে কতখানি ভাল বাসিয়াছি, তাহা বুঝিতে পারিলাম।

এই সখ্য বন্ধুর প্রতি অধিকারপরায়ণ নয়, ব্যোমকেশের জীবনে সত্যবতীর প্রবেশ ঘটলে অজিতের প্রস্থান ঘটে না। অজিত ব্যোমকেশ-সত্যবতীর সঙ্গে থেকে যায়। পরশুরাম অবশ্য জানেন, বন্ধু হওয়ার অধিকার সবার নেই। অবিবাহিত পুরুষের জীবনে ইয়ার-দোস্ত লেগেই থাকে। সেই ইয়ার-দোস্তদের আয়ু কদ্দিন? বিবাহের আগে পর্যন্ত। বিয়ে হলে পরশুরামের গল্পে ইয়ার-দোস্তদের আড্ডা ভেঙে যায়।

বিবাহের অধিকরণে তখন বন্ধুদের অপাদানত্ব প্রাপ্তি। সবাই তো আর ব্যোমকেশ-অজিত নয়।

More Articles