'বড্ড গরম, হিমালয়ে যাই', বলেই চিরতরে নিরুদ্দেশ হলেন সেই বাউল

এমন বহু বাউল-ফকিরের সঙ্গে দেখা হয়েছে, যাঁরা গান করেন না, ছবি আঁকেন কিংবা পদ লেখেন বা কিছুই করেন না সেভাবে, তাঁরা শুধুই তত্ত্বসাধনায় মশগুল।

ট্রেনে-বাসে, মাচায় মাচায়, পাড়ার অনুষ্ঠানে মাথায় পাগড়ি অথবা চুল বেঁধে, আলখাল্লা পরে যারা গান গায়, তারা কি বাউল? তারা কি ফকির? আমি ঠিক বলতে পারব না। বলা উচিত হবে কি না, তাও বুঝতে পারি না মাঝেমধ্যে! তবে একথা স্বীকার করতেই হবে, যে এদের মধ্যেও অনেকানেক লোক মায় পল্লিগীতি-গায়ক আছে, যাদের জনপ্রিয়তা তর্কাতীত। আসলে বাউলফকিরি গান আর প্রকৃত বাউল ও ফকিরের জীবনচর্যার  মধ্যে একটা বিস্তর পার্থক্য থেকে গেছে। বাউল মানে তো আর গান নয়! ফকিরালি কি শুধুমাত্র গান?

এমন বহু বাউল-ফকিরের সঙ্গে দেখা হয়েছে, যাঁরা গান করেন না, ছবি আঁকেন কিংবা পদ লেখেন বা কিছুই করেন না সেভাবে, তাঁরা শুধুই তত্ত্বসাধনায় মশগুল। এরা হয়তো ক্রমেই বিলীন হচ্ছেন। কিন্তু তারপরও বাউল থেকে গেছে তাঁদের চর্যাচর্যে, একনিষ্ঠ সাধনার মধ্যে। এঁরা দিনান্তে একবারটি শাক-অন্ন সেবা নেন।গ্রামের শুরুতে বা শেষে থাকেন আবার থাকেনও না। ঘুরে বেড়ান গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। তাঁরা ব্যতিক্রমী, সমাজ-সংস্থায় তাঁরা ব্রাত্য, তাঁরা প্রান্তিক, কৌম সমাজের মানুষ। মূলধারার ধর্ম মানেন না। অনুমানে আস্থা নেই, বর্তমান নিয়ে কারবার তাঁদের। তাঁদের আকাদেমি নেই, তাঁদের কোনও সরকারি কার্ড নেই, সরকারের দু'লক্ষ না আড়াই লক্ষ বাউলের মধ্যে এঁরা নেই।

তথাপি আজও তাঁরা আছেন। ছড়িয়েছিটিয়ে আছেন,  এ-বাংলা থেকে ও-বাংলার নানা গ্রামের প্রত্যন্তে। যেখানে মিডিয়ার আলো পৌঁছয় না, কর্পোরেট টাকার শব্দ পাওয়া যায় না, ইউটিউবের ঝকমারি নেই, যেখানে ডিজিটাল নেটওয়ার্ক মুখ থুবড়ে পড়েছে। শুনতে ম্যাজিকের মতো ঠেকবে বা মনে হবে অলীক। কিন্তু হ্যাঁ, এঁরা আছেন আবার নেই। এঁরা হারিয়ে যায়, ভেসে যায় সময়ের স্রোতে। তেমন দু'-চারজনের কথা বলব, যাঁরা সত্যিই উধাও হয়ে গেলেন ক্রমে। শত চেষ্টাতেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমার যুক্তিবাদী মন আজও তাঁর কোনও কারণ খুঁজে পায়নি।

আরও পড়ুন: এই শহরের গোপন গুহা থেকেই লড়াই শুরু স্পার্টাকাসের

তা এখানে রামানন্দকে দিয়েই শুরু করা যাক।

তিনি ছিলেন এক বাউল। আমার সঙ্গে যখন দেখা হয়েছে তখন তিনি সত্তর ছুঁইছুঁই (আন্দাজ)। তাঁকে শীর্ণকায় বলা যায়। তেজোদ্দীপ্ত তাঁর শরীর ছিল সতেজ, টানটান। অসম্ভব এনার্জি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে যেতেন। তত্ত্বকথা, গান আর খ‍্যাপামিতে ছিলেন লা-জবাব। তাঁর ভক্তবৃন্দর সংখ্যা তারিফ করার মতো। গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষ থেকে শহুরে মধ্যবিত্ত, প্রতিষ্ঠিত কেষ্টবিষ্টু থেকে বিদেশিরা তাঁকে ঘিরে থাকত। আর রামানন্দ ঠাট্টা করতেন তাঁদের ভাষা নিয়ে। ইংরেজি নানা শব্দের অর্থ না জেনে লোফালুফি করতেন আশ্চর্যজনকভাবে। ইংরেজি সংখ্যা (ডিজিট) শুনলে তো কথাই নেই। রামানন্দ গানের ফাঁকে ফাঁকে সিক্সটিফোর, ফর্টিথ্রি সুরছন্দে লাগিয়ে দিতেন। এর কারণ না জেনেই বলতে পারি, শুনতে বেশ লাগত। মনে হতো, এই শহুরে যোগবিয়োগ যেন রামানন্দ মেনে নিতে পারছেন না। তাই রসিকতায় বিদ্ধ করছেন আমাদের।

অর্থাৎ বোঝাতে চাইছি যে, রামানন্দ ছিলেন ভালোই। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জর্জ লুনোর সঙ্গে কাজ করেছেন। সেই অর্থে দারিদ্রের চাপ ছিল না। কিন্তু হঠাৎই খবর পাওয়া যায় যে, বেশ কিছুদিন ধরে রামানন্দকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। নেই মানে নেই। খোঁজাখুঁজি করা হয়েছিল, কিন্তু কোথাও তার হদিশ পাওয়া যাইনি। 'মহীনের ঘোড়াগুলি'-র গৌতম চট্টোপাধ্যায় একটা ছবি করবে বলে ভেবেছিল। যার নাম হবে 'রামানন্দের সন্ধানে'।

যথারীতি সে ছবি আর হয়নি।

আরেক তরুণ ছিল গোপাল শাহ্ ফকির। বাপ-মা হারা এই ছেলেটি ছোট থেকেই কুকুড্ডিতে তার গুরু কদম শাহ্ ফকিরের কাছেই মূলত থাকত। গোপাল ছিল অসাধারণ গাইয়ে, বাজিয়ে। তার দুটো হাতের পাঞ্জাতে অধিকাংশ আঙুল ছিল না। তারপরেও নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে ডুবি (খঞ্জরি) বাজাত। গলাটা একটু ফ্যাঁসফ্যাঁসে, মানে একটু 'হাস্কি ভয়েস' যাকে বলে। কিন্তু সে গানে ছিল মধুমাখা দরদ আর উথলে ওঠা প্রেম। গোপাল বেশি লোকজনের মধ্যে কখনও স্বাচ্ছন্দ‍্য পেত না। মেলাখেলায় রাত যখন ঘনিয়ে আসে, আখড়াবাসীরা যখন ঘুমে কাতর, তখন গোপাল গান শুরু করবে। একটার পর একটা গান গেয়েই যাবে, যতক্ষণ তার মনে হবে। কনকনে শীতের আবহে ঘেমে-নেয়ে অস্থির অবস্থা। গোপাল শুধু গাইবে আর অঝোর ধারে কেঁদে যাবে। আমরা গুটিকতক মানুষ তা দেখেছি আর বিস্মিত হয়েছি। তবে বুঝেছি, গানই এই ফকিরের আস্তানা, তার নিভৃতযাপন।

এই গোপাল শাহ্ ফকিরও একদিন হারিয়ে গেল। তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো। তৎকালীন বীরভূমের জেলা প্রশাসক অনেক চেষ্টা করলেন পুলিশ মারফৎ, কিন্তু পাওয়া গেল না। গুরু কদম শাহ্কে প্রশ্ন করতে উনি বলেছিলেন, "গোপাল নিজের পথে চলেছে। ও কোথাও থাকতে আসেনি।" এমন ফকিরালি কথা আমার বোধগম্য হয়নি বটে। তবে কিছু একটা টের পাওয়া গেছে।

আড়ংঘাটার জয়া ক্ষ‍্যাপার কথা মনে পড়ল। অসম্ভব রাগী আর ক্ষ‍্যাপাটে। অসংখ্য গানের পুঁজিপাটা নিয়ে নদীর ধারে শ্মশানে থাকতেন। নিজের গান, অন্য অনেক মহাজনের গান তাঁর কাছে শুনেছি, যা আগে শুনিনি। সেইসব গানে ছিল প্রেম। কিন্তু ঝরে পড়ত আগুন হয়ে। এই ধরনের রাউডি, অ্যাংরি বাউল আর পরে দেখিনি। সে নাকি তার ভক্তদের বলেছিল, "একটু হিমালয় থেকে ঘুরে আসি, বড্ড গরম কচ্চে।" জয়া ক্ষ‍্যাপার আর ফিরে আসা হয়নি। কোনও খোঁজখবর পাওয়া যায়নি।

এমন আর কত বাউল-ফকিরের কথা লিখব? রানিবাঁধের অন্ধ কানাই বৈরাগী তো সঙ্গে তিন খেপি-সহ চলে গেলেন। কোথায় গেলেন? কেউ জানে না। একইরকম মুর্শিদাবাদের জালাল শাহ্ ফকির কিংবা নদিয়ার রাদু বা রাধেশ্যাম বাউল। অত্যন্ত কমবয়সে রাদু গৌর ক্ষ‍্যাপার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। সে কাউকে কিছু না বলেই লা পাতা। এর কারণ, বৃত্তান্ত হয়তো ভবিষ্যতের গবেষকরা খুঁজে বের করবেন।

কিন্তু কিছু পাবেন তো?

More Articles