বইমেলা থেকে নিষিদ্ধপল্লি- সব একাকার ছিল কলেজস্ট্রিটের এই আড্ডায়
আমার দেখা অপরাজেয় আড্ডাধারী ছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু ওপরে যত লেখক-শিল্পীদের নাম লিখেছি, তার অধিকাংশই সন্দীপনদাকে অপছন্দ করতেন। তিনি ছিলেন স্বভাব-রসিক। একবার অরূপরতন সম্পর্কে আমায় বলেছিলেন যে, 'আচ্ছা বলো তো, অরূ...
গত শতাব্দীর শেষ ভাগে, আটের দশকের শুরুতে হাংরি লেখকদের সঙ্গে আমার ও আমার তৎকালীন বন্ধুদের যোগাযোগ শুরু হয়। তখন কলেজ স্ট্রিটে 'কাগজের বাঘ' নামে একটি ভিন্ন গোত্রের লিটল ম্যাগাজিন ও বইপত্র নিয়ে একটি ছোট্ট দোকান চালাতাম যৌথ উদ্যোগে, আমরা বন্ধুরা মিলে। পিয়ারীচরণ সরকার স্ট্রিটে একটি সাধারণ কিয়স্ক নিয়ে চলত সে দোকান। এই দোকানকে কেন্দ্র করে এক ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আমরা সংগঠিত করতাম। সেই রাস্তার ওপর মেলা সংগঠিত করেছি, জীবনানন্দের জন্ম ও মৃত্যুদিন পালন করেছি। সোমনাথ হোড়, মীরা মুখোপাধ্যায়, হিরণ মিত্র-সহ বিভিন্ন শিল্পীর প্রদর্শনী হয়েছে আর এখানে ফুটপাতে বসে শঙ্খ ঘোষ কবিতা পড়েছেন। রাস্তাজুড়ে পর্দা টাঙিয়ে সিনেমা দেখানো হয়েছে এই তিন মাথার মোড়ে। গানেবাজনায় নগর-গায়কদের সঙ্গে বাউলফকির থেকে উত্তরবঙ্গের গান আর ঝুমুর থাকত নিয়মিত। প্রকৃতপক্ষে বাবু-সংস্কৃতির বিপরীতে রাস্তার সংস্কৃতি বা সংস্কৃতিকে পথে নামানোর চেষ্টা।
এই লম্বা লিস্টির প্রয়োজন হলো কারণ 'কাগজের বাঘ'-এর আকর্ষণ বোঝাতে। যা কিনা পুরো আটের দশকজুড়ে একটা ভিন্ন স্পেস তৈরি করতে পেরেছিল। ফলে এইসব সাংস্কৃতিক উদ্যোগ নেওয়ার কারণে সেখানে অনেক লেখক-শিল্পী যেমন আসতেন, তেমন হাংরি জেনারেশনের বেশ কয়েকজন কবি ও গল্পকারও আসতেন। আমাদের তৎকালীন উদ্যোগের সার্বিক সমর্থনে প্রথম আসেন বাসুদেব দাশগুপ্ত। ক্রমশ শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, অরুণেশ ঘোষ, সুবিমল বসাক। তার আগে আমরা হাংরি সাহিত্য অনেকেই পড়ে ফেলেছি। ফলে এই সমস্ত লেখকদের প্রতি ছিল আমাদের দরাজ মান্যতা। অপরপক্ষে সেইসব কবি-সাহিত্যিকরাও আমাদের পছন্দ করতেন। উজ্জ্বল তারুণ্য আর যে কোনও কাজে মেতে ওঠা ও পরিশ্রমের দিল কাবার দেখে তাঁরাও আকৃষ্ট হয়েছিলেন আর কি!
এখানে জানিয়ে রাখা ভালো যে, এই জড়ো হওয়ার অভিপ্রায় আর সমবেত করার চেষ্টা খুব সহজ ও সোজা পথে এগোয়নি। হাংরিরা যেমন আসতেন, তেমনই হাংরি-বিরোধীরাও আসতেন। যেমন দীপক মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত, পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, হিরণ মিত্র, অরূপরতন বসু, নবারুণ ভট্টাচার্য, উদয়ন ঘোষ, সুবিমল মিশ্র, গৌতম চট্টোপাধ্যায় (গায়ক/চলচ্চিত্রকার), রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোৎস্নাময় ঘোষ- এরা কেউই হাংরি সাহিত্যের ধরনধারণে আগ্রহী ছিলেন না। জীবনযাপনের ওই যে অ্যানার্কি, নেশা ও আপাত নিষিদ্ধ জীবনের সদরঘরে প্রবেশ করার যে ঘোষণা হাংরি লেখকরা করেছিলেন, তা এরা মানতে পারেননি। সেই কারণেই এদের হাংরি-বিরোধী বলছি।
আরও পড়ুন: ধর্মে মুসলমান, কণ্ঠে শিবের গীত, রাজস্থানের আশ্চর্য জাতি মাঙ্গানিয়ার
এই গৌরচন্দ্রিকাটি বেলাগাম বড় হলেও অনেকে বাদ গিয়েছেন নিশ্চিত। অন্তত তিন-কুড়ি পাঁচ বছরে পা দিয়ে এ আমার নেহাতই মতিভ্রমও হতে পারে। তো বিস্তর তর্ক, তত্ত্বালোচনা আর আড্ডা ছিল এই কেন্দ্রের অন্যতম চালিকাশক্তি। গান ছিল, লেখা-পড়া ছিল, নেশা ছিল আর ছিল ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া গতানুগতিক জীবনের আগডুম বাগডুম। এই যে লেখক-শিল্পীরা তাদের মধ্যে সিংহভাগই ছিলেন প্রতিষ্ঠানবিরোধী। ফলে মূল ধারার লেখালিখিতে এদের কোনও ভূমিকা ছিল না। না থাকারই কথা। অথচ নতুন প্রজন্মের লেখক ও পাঠকদের মধ্যে এদের সম্পর্কে উৎসাহ আজও আমাকে অবাক করে। যেমন সুবিমল মিশ্র দিয়ে শুরু করা যায়। যাঁর সাদামাটা জীবনে কোনও নৈরাজ্য (অ্যানার্কি) দেখিনি। অথচ তাঁর লেখার নতুন ছাঁচ আর বক্তব্যের দৃঢ়তা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এক প্রান্তিক পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করেছিল। অথচ তাঁর জীবনের কোনও চটকাইমটকাই ছিল না। প্রতিষ্ঠানবিরোধের অন্যতম মাইলফলক হলো সুবিমলের পাঠক হয়ে ওঠার ধারাবাহিকতা। সুবিমল মনে করতেন, পাঠক হওয়ার জন্য সময় লাগে। পাঠক হয়ে উঠতে হয়। সুবিমল পরিশ্রমী, সুবিমল ফাইটার। কিন্তু আড্ডাবাজ হিসেবে সুবিমলদা ছিলেন বেশ মামুলি।
আবার হাংরিদের মধ্যে বাসুদেব দাশগুপ্ত ছিলেন সম্পূর্ণত ভিন্ন মনোভাবের লেখক। তাঁর শুরু 'দেশ' পত্রিকায় গল্প ছাপা দিয়ে। কিন্তু শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। অত্যন্ত কম লিখেছেন। ওঁকে দিয়ে লেখানো যে কী, তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। বাসুদার সঙ্গে দীর্ঘ যোগাযোগের সমস্তটাই ছিল আড্ডা। অসম্ভব ভালো কথা বলতেন আর কণ্ঠস্বরটি বেশ দরাজ ছিল তাঁর। ফলে সাহিত্য-সংস্কৃতির তুল্যমূল্য বিচারের সঙ্গে চলে আসত গান। বাসুদার আড্ডা মানেই তা উচ্চকিত, পানাহারে কেটে যাওয়া রাতের পর রাত। টালা থেকে বেহালা, অশোকনগর থেকে সোনাগাজি, আর বুকফেয়ার থেকে চলচ্চিত্র উৎসব- সব একাকার করে ফেলেছিলাম কলেজস্ট্রিটের সেই আড্ডায়।
হাংরি কবি শৈলেশ্বর ঘোষ ছিলেন তাত্ত্বিক প্রকৃতির। তাঁর সাহিত্যের তত্ত্বসম্পৃক্ত আড্ডায় সবসময়ই অনুঘটকের কাজ করত মদ। তিনি ছিলেন স্পষ্ট ও অকপট। বউ ও বেশ্যার ঘর আলাদা করেননি। কিন্তু একটা বিষয় লক্ষ করেছি যে, হাংরিদের নিজেদের মধ্যে তেমন সদ্ভাব ছিল না। মলয় রায়চৌধুরী ও সমীর চট্টোপাধ্যায়ের নাম শুনলে চটে যেতেন শৈলেশ্বর ঘোষ। আমার সঙ্গে মলয় রায়চৌধুরীর কখনও কথা হয়নি। কিন্তু তাঁদের লেখাও তো আমাদের উজ্জীবিত করেছিল, সেকথা মানতে চাইতেন না শৈলেশ্বর। কবি হিসেবে শৈলেশ্বর কিন্তু আমাদের কাছে এরপরও যথেষ্ট মান্যতা পেয়েছেন।
বাঙালির আড্ডা নিয়ে লিখব আর কূটকচালি এড়িয়ে যাব তা কি হয়? এ যেন সেই গারট্রুড স্টেইন আর জেমস জয়েস, কামু আর সার্ত্রের, এলুয়ার আর দালি আর ইভান বুনিনের কেচ্ছা। আমাদের সেই ঝলমলে আড্ডার প্রত্যন্তে ছিল নিন্দা-মন্দ। আমার দেখা অপরাজেয় আড্ডাধারী ছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু ওপরে যত লেখক-শিল্পীদের নাম লিখেছি, তার অধিকাংশই সন্দীপনদাকে অপছন্দ করতেন। তিনি ছিলেন স্বভাব-রসিক। একবার অরূপরতন সম্পর্কে আমায় বলেছিলেন যে, 'আচ্ছা বলো তো, অরূপ তারকোভস্কির মতো গল্প লেখে কিন্তু সুখেন দাশের মতো ছবি করে কি করে?' সেসময় চাকরি ছেড়ে অরূপরতন সন্দীপনদার গল্প নিয়ে একটি সিরিয়াল করছিলেন দূরদর্শনের জন্য। সে যাই হোক। সন্দীপনদার সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন, 'তোমার কাছে গাঁজা আছে? নেই? তাহলে একটা চারমিনার দাও, ওটাই মন দিয়ে টানি তাহলে খানিকটা গাঁজার ভাব আসবে।' অরূপদা সবসময় অকারণ মনখারাপের গল্প শোনাতেন আর ফিজিক্স আর ম্যাথামেটিক্স নিয়ে কথা বলতে ভালবাসতেন। দেশি ও বিদেশি সাহিত্যের সম্পর্কে ছিল তাঁর অপার ধারণা।
এই আড্ডায় কখনও কখনও চলে আসতেন মীরা মুখোপাধ্যায়, শ্যামলী তান খাস্তগীর কিংবা সুকুমারী ভট্টাচার্য। তখন আবার আড্ডার অন্য ভাব। মীরাদির নিজের ঘরের বাইরে আড্ডা তেমন জমত না। কিন্তু শ্যামলীদি জমিয়ে দিতেন। সুকুমারীদির সঙ্গে আড্ডা সবসময়ই গম্ভীর চলনে ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব ঘুরে রাজনীতির ঘাটা-আঘাটায় পৌঁছে যেত। যেমন সুধীর চক্রবর্তী এলে জমে যেত আড্ডা।
আসলে কোনও মূল্য বিচারে যাচ্ছি না। যাকে ইংরেজিতে ভ্যালু জাজমেন্ট বলে। স্মৃতির উজান বেয়ে যেসব স্মৃতিকাতর শব্দ-বাক্য ভিড় করেছিল, তাই কোলাজের আকারে ছড়িয়ে দিলাম।
আড্ডা দীর্ঘজীবী হোক।