'বাংলার মাটিতে তৃণমূলকে একটুও ছাড় নয়, দেশজুড়ে লড়াই চলবে বিজেপির সঙ্গে': দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
বিহার থেকে বাম ঐক্য, বিলকিস বানো থেকে অসংগঠিত শ্রমিক- নানা বিষয়ে সোজা কথায় দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। সম্পাদকের মুখোমুখি ১।
অর্ক দেব: প্রথম যে প্রশ্নটা রাখব দীপঙ্করদা, কলকাতার ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীরা, আপনার মেয়ের বয়সি বা তার থেকেও ছোটরা, তারা শুধু রাজনৈতিক লাইনের পার্থক্য, রাজনৈতিক অসূয়ার বশবর্তী হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানারকম টীকাটিপ্পনী কাটে, দীপঙ্করকে 'ডেঁপোঙ্কর' বলে। এরা কিন্তু বেশিরভাগই বাম ঘরানার ছাত্রছাত্রী। সোশ্যাল মিডিয়ার এই অসহিষ্ণুতা, ট্রোল সংস্কৃতিকে আপনি কীভাবে দেখেন? খারাপ লাগে না কি আপনি পাত্তাই দেন না?
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য: একদম পাত্তা দিই না বললে মিথ্যে কথা বলা হবে। যদি বুঝতাম, যারা এমন মন্তব্য করছে, তারা মানুষ নয়, বট, গোটাটাই রোবোটিক ব্যবস্থা, তাহলে হয়তো ভাবতাম না। কিন্তু যারা এসব বলছে, তাদের আমরা চিনি, জানি অনেককেই। একটা সময় ছিল, যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের পরিচয় ঢেকে রাখার সুযোগ নিয়ে অনেকেই নানা কিছু বলত। এখন ব্যাপারটা আর তা নয়, এখন সবটাই প্রকাশ্য। এই বিষয়টা ভাবায় তো বটেই। তবে আমার যেটা মনে হয়, যে রাজনৈতিক পরিবেশ এখন তৈরি হয়েছে, আমাদের ভাবনাচিন্তা, অনুশীলনের যে পরিসর তৈরি হচ্ছে, এসব তারই ফসল। ফলে, এটাকে ব্যক্তিগতভাবে নিই না আমি। বরং যারা এসব বলে, তাদের বক্তব্যটা বোঝার চেষ্টা করি কেবল।
অর্ক দেব: কিন্তু এই সহিংসতাটা তো দক্ষিণপন্থী ঝোঁক। আমরা দক্ষিণপন্থীদের ২০১৩-'১৪ থেকে ফেসবুক-ট্যুইটারকে ব্যবহার করে এভাবে হিংস্র হতে দেখে এসেছি। বামেদের একাংশও এই স্রোতে ভাসল?
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য: আমি এটা নির্দিষ্টভাবে পশ্চিমবঙ্গেই দেখতে পাই। অন্য রাজ্যের বামপন্থীদের সঙ্গে আমার যে যোগাযোগ, কথাবার্তা হয়েছে, সেখানে এই প্রবণতা আমি এতটা দেখি না। আসলে আমার ধারণা, ২০০৬-'০৭-এর সময় থেকে সিপিএম শিবিরের যে গণবিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে, এবং সেই ধারাবাহিক গণবিচ্ছিন্নতা থেকে তৈরি হয়েছে এক ধরনের আত্মমুগ্ধতা।
অর্ক দেব: হতাশাও কি?
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য: হ্যাঁ। হতাশা এবং আত্মমুগ্ধতা। অর্থাৎ, নিজেরা যা বললাম, তাতেই খুশি। মানুষ কীভাবে তা গ্রহণ করছে, তা সঠিক বলে মনে করছে কি না, এইসব নিয়ে যায়ই আসে না এই শিবির। একরকমের উল্লাসে মেতে উঠছে। এটার উৎস শুধু সোশ্যাল মিডিয়া নয়। ২০০৬-এর পর থেকেই যখন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে, কৃষক থেকে শুরু করে ছাত্রযুব- সকলের মধ্যে একটা আলোড়ন শুরু হলো, তখন তো সেই আলোড়নটা নিয়ে ভাবা উচিত ছিল সিপিএমের। জ্যোতিবাবুর মতো নেতা তাঁর নিজের কায়দায় বলেছিলেন, আমাদের কৃষক নেতারা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে? তারা কোথায়? গণসমর্থন না থাকলে সিপিএম তো আর এত বছর ক্ষমতায় থাকতে পারত না। এত বড় একটা দল, যারা পশ্চিমবঙ্গকে নখদর্পণে চিনত, তারা এমন জনবিচ্ছিন্নতার আবহে ঢুকল, যেখান থেকে তারা আর বেরতে পারল না। এবং সিপিএমের এই আকাশচুম্বী অহংকার ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে, কমছে না কিছুতেই। তারই একটা ছোট্ট প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার অসহিষ্ণুতা ও সহিংসতার মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গের যে এতটা পরিবর্তন হয়েছে, তাতে তাদের কোথায় ভুল ছিল, তা নিয়ে কোনও আত্মসমীক্ষা বা আত্মসমালোচনা করতে অস্বীকার করা, এবং এক ধরনের আত্মতুষ্টিতে বিরাজ করা, এটাই হয়ে গেছে এখন সিপিএমের বাস্তবতা। নতুন প্রজন্ম পার্টির এই পরিবেশ দেখছে বলে তাদের মধ্যেও এমন অসহিষ্ণুতার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
অর্ক দেব: পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের ফুসফুস, হৃদপিন্ডে পচন ধরেছে, কোটি টাকার দুর্নীতি চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে। এই পচনের গন্ধও আমরা অনেকদিন ধরে পাচ্ছিলাম। দীপঙ্কর ভট্টাচার্য কি এখনও লেসার ইভিল তত্ত্বে অবিচল?
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য: প্রথমত, লেসার ইভিল আলাদা করে আমার তত্ত্ব নয়। আমি মনে করি, যে-কোনও রাজনীতিতেই মানুষকে বাধ্যত কোনও একটি লেসার ইভিল বেছে নিতে হয়, সেকথা তত্ত্ব দিয়ে বলা হোক বা না হোক। যেখানে ভালো কোনও বিকল্প আমার কাছে নেই, সেখানে লেসার ইভিল না বেছে আমি যদি গ্রেটার ইভিলকে বেছে নিই, তবে তা তো আমার মূর্খতা! এটা বোঝার জন্য কোনও তত্ত্বর দরকার হয় না। এটা কোনও রকেট সায়েন্স নয়। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের আগে এমন একটা আবহাওয়া ছিল, যেখানে আশঙ্কা করা হচ্ছিল বাংলা বিজেপির দখলে চলে যাবে। সেই আবহাওয়া বিজেপি-ই তৈরি করেছিল। এর আগে অসম, ত্রিপুরা বিজেপির কুক্ষিগত হয়েছে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ১৮টি আসন জিতে নিয়েছিল। ফলে, ২০২১-এর নির্বাচনের আগে আমি একথাই বলেছিলাম যে, বাংলার বিপদ বেড়েছে, কিন্তু বিপন্নতাবোধ বাড়েনি, বিপদটা টের পাচ্ছে না কেউ। সেই বোধটুকু সৃষ্টির চেষ্টা আমরা করেছিলাম। তাই আমরা বলেছিলাম, বিজেপিকে একটিও ভোট নয়। বহু মানুষই সেরকমটাই মনে করেছিল। আমরা তো পশ্চিমবঙ্গে খুব ছোট একটি শক্তি, শুধু আমাদের কথায় তো নির্বাচনের ফলাফলে প্রভাব পড়ার কথা নয়। একটা বড় অংশের মানুষ এই বিপদের ভয়টা যদি না পেতেন, তাহলে এই ফলাফল হত না। এই কারণেই তৃণমূল তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ সত্ত্বেও বর্ধিত আসন ও ক্ষমতা নিয়ে ফিরল। ফিরেই তারা আবার স্বমূর্তি ধারণ করেছে। আবার সেই পুরনো কায়দায় অপশাসন চলছে। তাই আমরা যেমন বলেছিলাম, বিজেপিকে একটিও ভোট নয়, তেমনই আমরা বলছি, বাংলার মাটিতে তৃণমূলকে একটুও ছাড় নয়। আবার দেশের প্রেক্ষিতে, বিজেপি-বিরোধী শিবির খুব একটা সংগঠিত নয়। আজ বিজেপি যেখানে পৌঁছে গেছে, জাতীয় দল হিসেবে কংগ্রেস সেখানে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। এছাড়া রয়েছে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা আঞ্চলিক দল। এরকম একটা পরিবেশে অবশ্যই একটা বড় বিজেপি-বিরোধী ঐক্য দরকার বলে আমরা মনে করি। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ নিঃসন্দেহে বিজেপি-বিরোধী শক্তি হিসেবেই তৃণমূলকে দেখেছিল এই বিধানসভা নির্বাচনে। এবার যদি বিকল্প শক্তি হিসেবে তৃণমূলের বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভূমিকা ও উদ্যোগও ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তা নতুন প্রশ্ন তৈরি করবে। উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৃণমূলের ভূমিকা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিজেপি-বিরোধী মানুষের মধ্যে যথেষ্ট সংশয় জেগেছে। এটা কোনও নতুন বার্তা দিচ্ছে কি না, তা নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে। ফলে, পশ্চিমবঙ্গের ভেতরে তৃণমূলের অপশাসন একটা দিক, সেখানে তৃণমূলকে সমর্থন করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তার যাবতীয় দুর্নীতি, সন্ত্রাস, যে পচনের কথা আপনি বলছেন, সেই পচনের সমস্ত অভিব্যক্তি এবং সংকেতের বিরুদ্ধে জোরালো আন্দোলন চলছে এবং চলবে। আর সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও বিজেপির বিরুদ্ধে আন্দোলনেও কোনও শেষ কথা নেই। নীতীশ কুমার গতকাল অবধি বিজেপির সঙ্গে ছিলেন, আজ বিরুদ্ধে। এখানে তাৎক্ষণিকতার একটা বড় জায়গা রয়েছে। এটা একটা চলমান ও গতিশীল প্রক্রিয়া। এই প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ইতিহাস আলাদা, মতাদর্শ আলাদা, গতিপথ আলাদা। এখন এমন একটা ঐতিহাসিক বাঁকে আমরা দাঁড়িয়ে, যেখানে বিজেপির বুলডোজারের বিরুদ্ধে কীভাবে রুখে দাঁড়ানো যাবে, কীভাবে সেই আগ্রাসন থেকে দেশ মুক্তি পাবে, তার কোনও চূড়ান্ত জবাব নেই। কিন্তু এই তাগিদটা অনেকেই অনুভব করছে। এই যৌথ তাগিদটা কতটা সফল হয়, তাই এখন দেখার।
অর্ক দেব: ২০২৪-এর আগে বিহারে যে বদল আমরা দেখলাম, যা আপনারা বাইরে থেকে সমর্থনও করলেন, আপনি কি মনে করছেন, এর ফলে বিরোধী পরিসর কিছুটা শক্তিশালী হল?
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য: অবশ্যই বিহারের ঘটনা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৯৬ থেকে ২০২২, এর মধ্যে ২০১৩-'১৭- এই চারটে বছর যদি আমরা বাদ দিই, প্রায় ২২ বছর ধরে নীতীশ কুমারের বিজেপির সঙ্গে থাকা বিজেপিকে বিহারে এবং উত্তর ভারতের হিন্দি বলয়ে তাদের ক্ষমতা সম্প্রসারণে অনেকটা সাহায্য করেছে। নীতীশ কুমারের ঘাড়ে বন্দুক রেখে বিজেপি বিহারের সরকারি ক্ষমতায় ছিল। আমরা জানি যে, বিজেপির মতাদর্শ চিরকালই এক। কিন্তু ক্ষমতার প্রশ্রয় পেলে সেই মতাদর্শের দাঁতনখ আরও সুস্পষ্ট হয়। নীতীশ কুমার এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছেন বিহারে। কেউ হয়তো বলতেই পারেন, শেষ জীবনে কিছুটা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছেন তিনি।
অর্ক দেব: দীপঙ্করদা, আমরা মোদির নির্মাণ দেখেছি। ফেসবুকের আঁখি দাসের কথা জানি। বিজেপির একরকম ঈশ্বর নির্মাণের প্রকল্প ছিল সেটা, ভারত এখন ঈশ্বর প্রকল্পেই বিশ্বাস করে। মনমোহন সিং সেই জায়গা থেকেই কোণঠাসা হয়েছিলেন। রাহুল গান্ধীর কি এই প্রকল্পের বিপ্রতীপে দাঁড়ানোর পরিস্থিতি আছে? কোনও মুখ ছাড়া ২০২৪-এ নির্বাচন কীভাবে হবে?
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য: একথা ঠিক যে, মানুষ মুখ খোঁজে। একই সঙ্গে একথাও ঠিক, এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যখন মানুষ মনে করে, এই পরিস্থিতি থেকে বেরতেই হবে। তখন সে হাতের কাছে খড়কুটো যা পায়, আঁকড়ে ধরে। বিজেপি এমনই এক বিপর্যয়। বিজেপি আর পাঁচটা দলের মতো নয়, নরেন্দ্র মোদি আর পাঁচ জন প্রধানমন্ত্রীর মতো নয়- একথা মানুষ যতদিন না বুঝছে, ততদিন বিজেপির রাজত্ব চলতে থাকবে। এই মুহূর্তে ভারতের রাজনীতি, গণতন্ত্র সম্পূর্ণ ভারসাম্যহীন। তার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য সম্পূর্ণ নড়ে গেছে। সেখান থেকে নতুন ভারসাম্য কী করে আসবে, তা অবশ্যই বড় প্রশ্ন। রাহুল গান্ধী বা কংগ্রেস চেষ্টা করছে। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত পাঁচমাসব্যাপী 'ভারত জোড়ো' যাত্রার পরিকল্পনা তাঁরা নিয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে। সমস্ত পার্টিকেই বিজেপি-বিরোধী লড়াইয়ে নিজের মতো শামিল হতে হবে।
আমার মতে, ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদের কাছে কিছু সম্বল আছে। যেমন, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি ঐতিহ্য আছে, ইতিহাস আছে। তা কিছুটা ফলিত, সেখানে নানা স্রোত এসেছে, স্লোগান এসেছে, অনেক ধারণা এসেছে, যা হয়তো চূড়ান্ত সাফল্যে পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই আদর্শ জরুরি।
অর্ক দেব: কিন্তু বামেদের পার্টি অফিসে আজও সেভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি দেখা যায় না। আমাদের যে পাঠ্যক্রম, তাতে বিগত পঞ্চাশ বছরে বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। সূর্য সেনের জীবনী বা হেমচন্দ্র কানুনগোর জীবনী কি আমরা পড়েছি, কোনও প্রেরণা নিতে পেরেছি?
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য: হয়তো হয়নি। কিন্তু এই নিয়ে জানাবোঝার পরিসর ভারতে বেড়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের দুটো দিক আছে। এক, ব্রিটিশ-বিরোধী লড়াইয়ের দিক। দ্বিতীয়ত, সমাজটাকে পাল্টানোর লড়াই যাঁরা লড়েছেন। তার মধ্যে সাবিত্রীবাই ফুলে রয়েছে, বি. আর. আম্বেদকর রয়েছেন। তারাও আমার চোখে স্বাধীনতা সংগ্রামী। স্বাধীনতা অনেক গভীর বিষয়। শুধু জাতির মুক্তি নয়, সমাজের মুক্তি, নাগরিকের মুক্তি সেখানে জরুরি। ফলে বৃহৎ অর্থে দেখলে স্বাধীনতা সংগ্রাম আমাদের কাছে একটি বড় ঐতিহ্য নিঃসন্দেহে। সেখানে কিন্তু বিজেপি নেই, আরএসএস নেই। যেটুকু আছে, তা বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকায়, স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপরীত মেরুতে। এই স্পিরিটটাকে আমাদের বিরাটভাবে কাজে লাগানো প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, যেটা প্রয়োজনীয়, ভারতে গণতন্ত্রের সব দুর্বলতা সত্ত্বেও, মাঝে জরুরি অবস্থা এসেছে, বিভিন্ন জায়গায় উপদ্রুত এলাকা রয়েছে, যেখানে সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতার আইন চলে, এতকিছু সত্ত্বেও গত সাত দশক ধরে আমরা কিন্তু একটা সংসদীয় গণতান্ত্রিক অনুশীলনের মধ্যে আছি। এখানে কোনওদিন সামরিক শাসন আসেনি। জরুরি অবস্থা এসেছে ব্যতিক্রম হিসেবে, তা দু'বছরের মধ্যে প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছে। ফলে এই যে নিরবচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক অনুশীলন, এটা আমাদের কাছে একটা বড় সম্পদ। অনেকেই বলে, ফ্যাসিবাদ চলে আসে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, কিন্তু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তারা যায় না। ইতালি বা জার্মানির ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয় বটে। বিশ্বযুদ্ধ না হলে হিটলার বা মুসোলিনির পতন কী করে ঘটত, আমরা জানি না। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধর মধ্য দিয়েই ফ্যাসিবাদ চিরকাল যাবে, এমনটাও আবার সঠিক নয়। আমাদের হাতে যখন এখনও পর্যন্ত নির্বাচনী ক্ষমতা রয়েছে, একটা গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা রয়েছে, তা আমরা কাজে লাগাতে পারি। ফলে, স্বাধীনতার ঐতিহ্য ও এই গণতান্ত্রিক চর্চা, এই দু'টিকে হাতিয়ার করে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। এই প্রতিরোধ যখন সর্বাত্মক হবে, যখন মানুষ বুঝবে বিজেপি একটা বিপর্যয়, তার থেকে রক্ষা পাওয়া দরকার, তখন হয়তো সবটা পালটাবে। বিপর্যয় মোকাবিলায় অনেক কিছু করতে হয়। উদ্ধার করতে হয়, ত্রাণ দিতে হয়, পুনর্নির্মাণ করতে হয়। এই যে আমরা বলছি, সংবিধান বাঁচাও, এটা উদ্ধারকল্প। এর সঙ্গে চলবে ত্রাণ, বিরাটভাবে যে অংশের মানুষ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তাকে কিছু দেওয়া, এবং তার সঙ্গেই চলবে পুনর্নির্মাণ। যে ক্ষতি বিজেপি করে ফেলেছে ইতিমধ্যেই, তাতে আগামিদিনে যদি বিজেপি সরকারি ক্ষমতা থেকে চলেও যায়, তাহলেও এই ক্ষতিটা জিইয়ে থাকবে। তাদের যে ৩০-৩৫ শতাংশ ভোট, রাজ্যে রাজ্যে তাদের ক্ষমতা, তা তো চলে যাবে না। ফলে, পুনর্নির্মাণটা খুবই জরুরি।
অর্ক দেব: আপনি সংবিধানের কথা বললেন। এখানে একটা প্রশ্ন চলে আসে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, বারাণসীর শঙ্করাচার্য পরিষদের সভাপতি আনন্দ স্বরূপ সম্প্রতি হিন্দুরাষ্ট্রর সংবিধানের কথা বলেছেন। কথা হচ্ছে, মিডিয়ার যে অংশের টিআরপি খুব উঁচুতে, তারা মানুষের কাছে এই তথ্যগুলি পৌঁছে দিচ্ছে না। কিন্তু এই ঘটনা, এই ধরনের চিন্তা কোথায় সংবিধানের পরিপন্থী, তা নিয়ে মিডিয়া কথা বলে না। এই যে মানুষের মনবদলে গোদি মিডিয়ার ভূমিকা, সেই ফাঁদে মানুষ বুঝে বা না বুঝে পা দিচ্ছে। কীভাবে এর প্রতিরোধ সম্ভব বলে আপনি মনে করেন?
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য: গোদি মিডিয়া যেমন আছে, তেমন মূলধারার মিডিয়ার মধ্যে অন্য স্বরও আছে, একথা অস্বীকার করব না। কিন্তু এর পাশাপাশি একটা অন্য মিডিয়া বাস্তুতন্ত্র তৈরি হচ্ছে। বহু নতুন ডিজিটাল পোর্টাল, ইউটিউব চ্যানেল তৈরি হচ্ছে, যেগুলো একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করি আমি। কারণ মিডিয়া এখন ক্ষমতার সহযোগী হয়ে উঠছে। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ যে বলা হতো মিডিয়াকে, সেখান থেকে গোটা বিষয়টা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে কার্যনির্বাহী নিয়ন্ত্রণে। বিচারব্যবস্থাও ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে, আইনসভার ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। আর মিডিয়া এখানে অবতীর্ণ হচ্ছে চিয়ারলিডারের ভূমিকায়। যে হিন্দুরাষ্ট্রর কথা বলা হচ্ছে, বিজেপি তো তার সঙ্গে নিজের সম্পর্ক অস্বীকার করছে। বিজেপি বলছে প্রচলিত সংবিধানের মধ্যেই তারা আছে। কিন্তু এই প্রচলিত সংবিধানে থেকেই যেভাবে সংবিধানকে ছিবড়ে করে ফেলা হচ্ছে, তা নিয়ে কথা বলার যথেষ্ট প্রয়োজন আছে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমরা দেখলাম ১৫ অগাস্ট। বেছে বেছে ওইদিনই বিলকিসের ধর্ষকদের মুক্তি দেওয়া হল। বলা হচ্ছে, এটা একটা আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হল। এর চেয়ে বড় হিন্দুরাষ্ট্রর স্টেটমেন্ট হতেই পারে না, কাশীকে রাজধানী করার দাবি এর কাছে অনেক নিরীহ। ভারতের সংবিধান যে আর আগের অবস্থায় নেই, এটাই তার প্রমাণ। ওইজন্যই ১৫ অগাস্ট দিনটাকে বেছে নেওয়া হল। সেদিন এদের মুক্তি দিয়ে দেখানো হলো আসলে, যে গুজরাতের গণহত্যা নিয়ে এই সরকার আদৌ লজ্জিত নয়। তিস্তা শীতলবাদকে জেলে পাঠিয়ে গুজরাতের অপরাধীদের ছাড় দেওয়ার চেয়ে বড় হিন্দুরাষ্ট্রর পদধ্বনি আর কী হতে পারে?
অর্ক দেব: সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের একটি ঘটনা আমরা দেখলাম, পোশাকের কারণে একজন অধ্যাপিকাকে বহিষ্কার করা হলো। এই প্রেক্ষিতে একটা প্রশ্ন করতে হয়। বামপন্থীদের একাংশ, যারা তৃণমূল নয়, বিজেপি তো নয়ই, তারা মূলধারার বামেদের মুক্তমনের অভাব নিয়ে কিঞ্চিৎ বিরক্ত। তারা একটা প্রগতিশীল বিকল্প চাইছেন, বা বলা ভালো, সিপিএমের একটা বাম বিকল্প চাইছেন বলে মনে হয় না? সিপিআইএম(এল)-এর ভূমিকা কী হবে সেক্ষেত্রে?
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য: আমাদের মতে, বামপন্থার সঙ্গে মুক্তমন তৈরি না হলে, বামপন্থী হওয়া যায় না। প্রত্যেকের নিশ্বাস নেওয়ার পরিসর থাকা দরকার। ৩৪ বছরের বাম শাসন, এবং দশ বছরের তৃণমূল শাসনের যে অভিজ্ঞতা বাঙালির হয়েছে, সেখান থেকে তারা কিছুটা মুক্তি নিশ্চয়ই চায়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আসার ইচ্ছে এবং প্রয়াস অবশ্যই আমাদের আছে। আমরা বারবার বলি, বাংলার একটা স্বতন্ত্র বামপন্থী পরিচিতি আছে। তা তো কেবল ৩৪ বছরের বাম শাসন দিয়েই গড়ে ওঠেনি, তা সেই স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকেই। পশ্চিমবঙ্গের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা বড় ধারাই ছিল বামপন্থী। তেভাগা, খাদ্য আন্দোলন, নকশালবাড়ি আন্দোলনের সূত্র ধরে তা সম্প্রসারিত হয়েছে। ফলে এরাজ্যে বামপন্থার একটা দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। নো ভোট টু বিজেপির যে সাড়া পাওয়া গেল, তাতে একটা কথা স্পষ্ট। পশ্চিমবঙ্গের একাংশের মানুষ, যারা তৃণমূল সম্পর্কে অত্যন্ত বিরক্ত, যারা তৃণমূল সম্পর্কে নির্মোহ, কিন্তু কখনওই চাননি বিজেপি বাংলায় ক্ষমতায় আসুক, তাদের একটা পরিসর প্রয়োজন। ২০২১-এর গণরায়কে আমি নিছক তৃণমূলের আসনসংখ্যার নিরিখে দেখি না। এই প্রতিরোধের মালিকানা আমাদের হাতে আছে। ওই গণরায়ের যে স্পিরিট, তাকে তুলে ধরতে হবে। অনেকেই বলে, পশ্চিমবঙ্গ আবার বামদিকেই যাবে। কিন্তু পুরনো বাম নয়, নতুন বামের প্রাণস্পন্দন জরুরি। আমরা সেই স্পন্দন তৈরির চেষ্টাতেই আছি। যতটুকু করতে পারব, মানুষের কাছে পৌঁছতে পারব, তার চেষ্টা করে যেতে হবে।
অর্ক দেব: পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিএম জোট করতে আহ্বান জানালে সাড়া দেবেন?
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য: একথা এখনই বলা মুশকিল। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের সঙ্গে জোটে লড়ার অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। এবার তা হলেও হতে পারে। আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় কথা, সন্ত্রাসমুক্ত পঞ্চায়েত নির্বাচন। অন্তত মনোনয়ন জমা করার জন্য যেন কাউকে মার না খেতে হয়।
অর্ক দেব: আপনারা প্রার্থী দেবেন?
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য: হ্যাঁ, অবশ্যই দেব। হয়তো জোটের সম্ভাবনা থাকবে। পশ্চিমবঙ্গে যাতে সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন হতে পারে, এবং পশ্চিমবঙ্গের কৃষক, ক্ষেতমজুরের দাবিগুলো যাতে উঠে আসে, সেদিকে নজর রাখব আমরা।
অর্ক দেব: শেষ প্রশ্ন রাখব। পশ্চিমবঙ্গের গত নির্বাচনের আগে একটি কথাবার্তায় প্রণব বর্ধন বলেছিলেন, বঙ্গের বামেরা শ্রেণিকে যতটা গুরুত্ব দেয়, বর্ণকে ততটা নয়। ভারতজুড়ে দলিতদের ওপর যে সীমাহীন নিপীড়ন চলেছে, তা আমরা দেখেছি। পরিযায়ী শ্রমিকরা নির্বিচারে মারা গেছেন অতিমারীতে। তাদের জন্য দেশে এখনও একটামাত্র আইন। আরেকটা বর্গের কথা আমি বলব, তারা 'ডেলিভারি বয়'। নতুন শ্রমিক তারা। এদের জুড়তে পারছে না কেন বামপন্থীরা? এই মানুষগুলির অনেক না পাওয়া আছে, সস্তা শ্রম, প্রাণের ঝুঁকি-সব মিলে অকহতব্য অবস্থা। এদের স্বর হয়ে উঠছে না কেন বামপন্থীরা?
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য: এটা তো একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। একটা সময় যে বামপন্থী আন্দোলনের একটা বড় গণভিত্তি হয়েছিল, তা সম্ভব হয়েছিল এই কারণেই, যে, সবচেয়ে নিপীড়িত ও সবচেয়ে শোষিত মানুষক তারা একজোট করতে পেরেছিল। একটা সময়ের অর্জন দিয়ে তো সারাজীবন চলবে না। বাংলায় জাতি বললে লোকে নেশন বোঝে, জাতপাত বললে কাস্ট বোঝে। জাতপাত শব্দটার মধ্যে একটা তাচ্ছিল্য আছে, যেন বিষয়টার অস্তিত্ব নেই। কিন্তু আসলে তা আছে। তা এই নিপীড়িত জাতের মানুষ হোক বা নতুন ওয়ার্কিং ক্লাস, যারা অসংগঠিত, তাদের কথা বলা প্রয়োজন। শ্রমিকশ্রেণির চেহারা-চরিত্র পালটাচ্ছে। সংগঠিত পাবলিক সেক্টরের শ্রমিকদের অনুপাত কমছে আন্দোলনের ক্ষেত্রে। অসংগঠিত ঠিকা শ্রমিক, অঙ্গনওয়াড়ি, ডেলিভারি বয়- এরা কী করে সংগঠিত হবে, শিশু, নারী শ্রমিকরা কীভাবে সংগঠিত হবে, তা নিয়ে বামপন্থীরা ভাবছে। নিশ্চয়ই কোনও না কোনও নতুন দিশা দেখা যাবে শ্রমিক আন্দোলনের।