ব্যাঙ্ক লেনদেন থেকে ব্যক্তিগত কথা, 'অমৃত মহোৎসব'-এর দেশে গোপনীয়তার নেই মালিকানা
পরাধীনতার শৃঙ্খল কাটিয়ে উঠতে ২০০ বছর লেগেছিল যে ভারতের, মাত্র আড়াই দশকে সেই ভারতকে ফের দাসত্ব স্বীকারে বাধ্য করে ফেলেছে ইন্টারনেট।
সাদা সুতোয় জাল বোনে সে,
হয় না বুনোন সারা—
পণ ছিল তার ধরবে জালে
লক্ষ কোটি তারা...
আন্তর্জালের ফাঁদে বন্দি দুনিয়া দেখে যেতে পারেননি কবি। নইলে তারা নয়, হয়তো শিকার ধরার কথা লিখে যেতেন। ঘুমে ঢুলে পড়া তো দূর, অজস্র অতন্দ্র চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে রাতদিন। পৃথিবীর এক প্রান্তে বসে অন্য প্রান্তের মানুষের নাওয়া-খাওয়া-শোওয়ার হিসেব রাখছে। কাজটি এককথায় খোচড়গিরি হলেও, পুঁজিপতি নাম বাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে শিকারির দল। রাতারাতি সিলিকন ভ্যালিতে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে গগনচুম্বী প্রাসাদ। কোন দেশে কে সরকার চালাবে, তা-ও ঠিক করে দিচ্ছে। আর সেই ফাঁদে পা দিয়ে পার্থিব, অপার্থিবর ভেতরের ফারাক ভুলতে বসেছেন খেটে খাওয়া মানুষ। তাই ধুমধাম করে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ৭৫ বছর পালন করলেও, নিজের অজান্তেই স্বীকার করে নিচ্ছেন আন্তর্জালের দাসত্ব।
খাতায়-কলমে ১৯৮৩ সালে উৎপত্তি ঘটে ইন্টারনেটের, যার বাংলা তর্জমা আন্তর্জাল। ভারতে এর আগমন আরও পরে, ১৯৯৫ সালে। কিন্তু পরাধীনতার শৃঙ্খল কাটিয়ে উঠতে ২০০ বছর লেগেছিল যে ভারতের, মাত্র আড়াই দশকে সেই ভারতকে ফের দাসত্ব স্বীকারে বাধ্য করে ফেলেছে এই আন্তর্জাল। তাতে বই বা খবরের কাগজের পাতা উল্টে জানার অভ্যাস ঘুচেছে ভারতবাসীর। বাজার দোকানে ঘুরে, দরদাম করে খাঁটি জিনিস কেনার অভ্যাস গিয়েছে। ফোনে আঙুল চালানো রপ্ত করে মিতভাষী হয়ে পড়েছেন মানুষ। তাই এককালের অভিন্নহৃদয় সম্পর্ক বন্দি হয়ে গিয়েছে হাই-হ্যালোর শব্দবন্ধে। মিটারে যাওয়া নিয়ে ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে তর্কাতর্কি চেয়ে বেশি টাকায় ওলা, উবের ডেকে নেওয়া শ্রেয় বলে মনে হয় আজকাল।
এত প্রকার ঝক্কি থেকে মানুষকে নিস্তার দিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের মান্যিগন্যি না করে যান কোথায় সাধারণ মানুষ! কিন্তু তাতে যে ক্রমশ নজরদারির পুঁজিবাদ তাঁদের গ্রাস করে ফেলছে, তা বোঝেন কমজনই। ইতিহাস থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, পুঁজিবাদ কথাটির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে বার বার।। কিন্তু আন্তর্জালের মাধ্যমে নজরদারি পুঁজিবাদের রমরমা বেড়েছে বিগত কয়েক বছরে। আন্তর্জালের ওপর ভর করে টিকে রয়েছে এই নজরদারির পুঁজিবাদ। এর আওতায় প্রলোভনের ফাঁদ পেতে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে নিরন্তর। কারা হাতিয়ে নিচ্ছে এই তথ্য? গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিন, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম, এমনকী, অ্যাপ ক্যাব এবং বাড়ির দরজায় খাবার সরবরাহকারী সংস্থাও।
সার্চ ইঞ্জিন বা সোশ্যাল মি়ডিয়া প্ল্যাটফর্মে কে, কী খুঁজছেন, কী দেখছেন, কী লিখছেন, তার ওপর সারাক্ষণ নজর রয়েছে এই সংস্থাগুলির। সেই অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দ, কোথায় আনাগোনা, তাঁর পরিবারের সদস্য কারা, বন্ধুবান্ধবই বা কারা, সব জেনে নিচ্ছে তাঁরা। সেই অনুযায়ী ব্যক্তিবিশেষের ডেটাবেস তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যে কারণে একবার যদি সাদা শার্ট কিনতে অনলাইন ঢুঁ মারা হয়, তারপর থেকে মোবাইল বা কম্পিউটারের স্ক্রিনে আরও শার্ট কেনার লোভনীয় অফার চোখে পড়ে। কোনও বিকেলে হয়তো অনলাইন থেকে মোমো অর্ডার করে খাওয়া হয়েছে, পরদিন আর কী খাওয়া যেতে পারে, তার ফিরিস্তি আসতে শুরু করে। তারপরেও অর্ডার না দিলে, প্রিয়জন যেমন ফোন করে খাবার কথা মনে করিয়ে দেন, ঠিক তেমনভাবে মেসেজ ঢুকতে শুরু করে। দ্বিতীয়বার অর্ডার না পেয়ে যে বুক ফেটে যাচ্ছে রেস্তোরাঁর মালিকের, বোঝানো হয়।
পুঁজিবাদ বলতে আমরা বুঝি এমন এক সমাজব্যবস্থা, যেখানে শিল্প-কারখানা, সম্পত্তি-সহ অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর সামগ্রিক মালিকানা মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ কুক্ষিগত করে রাখেন। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে লিপ্ত জনসাধারণকে নিজেদের সুবিধেমতো পরিচালনা করেন তাঁরা। আন্তর্জালকে ব্যবহার করে বর্তমানে ডানা মেলেছে নজরদারি পুঁজিবাদ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের অনলাইন আচরণ-বিচরণ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেই তথ্য পণ্য বিক্রয়কারী বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলিকে মোটা টাকায় বিক্রি করা হয়। ব্যক্তি এবং বাকস্বাধীনতার অধিকার নিয়ে সাধারণ মানুষ যতটাও বা সচেতন, গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার নিয়ে সেভাবে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি এখনও। তাই অনেকই বলে থাকেন, তাঁদের কিছু লুকনোর নেই। কিন্তু তা অজ্ঞতা বই কিছু নয়।
এর প্রমাণস্বরূপ কয়েক বছর আগে ভাইরাসের আকার ধারণ করা ‘পোকেমন গো’ গেম উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে। ওই গেমটির প্রতি আসক্তি জন্মে ছিল যাঁদের, পোকেমন ধরতে তাঁদের দূর-দূরান্তে পাড়ি দেওয়ার নজির রয়েছে। নেহাত স্বতঃস্ফূর্ত গেম ছিল না ‘পোকেমন গো’। কোন পর্যায়ে কতদূর টেনে নিয়ে যাওয়া যায় গ্রাহককে, রীতিমতো অঙ্ক কষে তৈরি রাখা হয়েছিল সবকিছু। ফলে পোকেমন কিনতে যাঁরা রেস্তরাঁ, পানশালায় পর্যন্ত ঢুকে পড়েছেন, সেখানে কিছু কিনতে হয়েছে তাঁদের। বিমান ভাড়া করে এক জায়গা থেকে অন্যত্র উড়ে গিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের মোটা টাকা গচ্ছা গিয়েছে। অর্থাৎ, খেলার ছলে শুধু দূর-দূরান্তে টেনেই নিয়ে যাওয়া হয়নি মানুষকে, অপ্রয়োজনীয় জিনিসও কিনতেও বাধ্য করা হয়েছে। আর তার দৌলতে ‘পোকেমন গো’ বিশ্বের তৃতীয় সর্বাধিক জনপ্রিয় ভিডিও গেম হয়ে ওঠে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২-এর জুন মাসের হিসেবে এখনও প্রতি মাসে ৮ কোটি মানুষ ‘পোকেমন গো’ খেলেন। ১০০ কোটির বেশি মানুষ ভিডিও গেমটি মোবাইলে ডাউনলোড করে খেলেছেন। এই বিপুল পরিমাণ ফুটফল (গ্রাহক সংখ্যা) দেখিয়ে বিপুল মুনাফা অর্জন করেছে ‘পোকেমন গো’-র স্রষ্টা, জাপানের ‘নিনটেন্ডো’ সংস্থা। ওই ভিডিও গেমটিকে নির্ভর করে তৈরি হয়েছে অ্যানিমে সিরিজ, পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছায়াছবি, খেলনা এবং অন্য পণ্যসামগ্রী। শুধুমাত্র ‘পোকেমন গো’ ভিডিও গেম তৈরি করেই ৬০০ কোটি ডলার উপার্জন করেছে ‘নিন্তেন্দো’। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে লাভবান হয়েছে ওই সংস্থা।
নজরদারির এই পুঁজিবাদকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে ফেসবুক কর্ণধার মার্ক জাকারবার্গ। নয়া ‘মেটাভার্স’ জগতের সূচনা করেছেন তিনি, যার মাধ্যমে হেডসেট এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে একেবারে ভার্চুয়াল দুনিয়ার সঙ্গে মিশে যাবেন মানুষ। যা কিছু কল্পনা করবেন মানুষ, প্রায় সবকিছুর বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। এর ফলে ভৌগোলিকভাবে দূরে থাকলেও ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বন্ধুবান্ধব থেকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেই রয়েছেন বলে মনে হবে। ভিডিও বার্তা পাঠালে মনে হবে, সামনে বসেই কথা বলছেন প্রিয়জন। জুমকল শুধুমাত্র কম্পিউটার ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা মুখ হয়ে থাকবে না, মনে হবে এক টেবিল ঘিরে পরস্পরের পাশে বসে কথা হচ্ছে। গেম খেলার সময় মনে হবে, কম্পিউটারের স্ক্রিনে চোখ নেই, ওই জগতের মধ্যেই ঢুকে পড়া গিয়েছে। অর্থাৎ, শুধু ফোন বা কম্পিউটারের স্ক্রিনেই আর মানুষকে বেঁধে রাখবে না আন্তর্জাল, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মতোই ইচ্ছামতো পরিচালনাও করা যাবে।
এর আগে, ২০২০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ সামনে আসে ফেসবুকের বিরুদ্ধে। জানা যায়, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা নামের একটি সংস্থার হাতে আমেরিকার সাধারণ নাগরিকদের সম্পর্কে বিপুল তথ্য তুলে দেয় জাকারবার্গের সংস্থা। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা সংস্থার সঙ্গে আবার রিপাবলিকানদের গভীর সংযোগ ছিল। রিপাবলিকান শিবিরেরই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফেসবুকের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করে তাই রিপাবলিকানদের তরফে ট্রাম্পের প্রতিপক্ষ, ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়ো তথ্য পরিবেশন করা হয় বলে অভিযোগ। সেই নিয়ে আমেরিকার কংগ্রেসে হাজিরাও দিতে হয় জাকারবার্গকে। ব্রেক্সিট নিয়েও ফেসবুকের ভূমিকার কথা সামেন এসেছে। আবার ভারতের নির্বাচনেও বিজেপি-র প্রতি ফেসবুকের নরম অবস্থান নিয়ে কম টানাপোড়েন হয়নি।
তাই হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের অধ্যাপিকা শোহশানা জাবফ আন্তর্জাল মাধ্যমের এই ব্যবসাকে নজরদারি পুঁজিবাদের গোত্রে ফেলেছেন। নিজের লেখা বই ‘দ্য এজ অফ সার্ভেইল্যান্স ক্যাপিটালিজম’-এ স্পষ্ট জানিয়েছেন, সিলিকন ভ্যালির তাবড় মুখ এবং কর্পোরেট সংস্থাগুলি সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য এবং অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কার্যত ট্যাঁকশাল খুলে ফেলেছেন। নজরদারি পুঁজিবাদের এতটাই ব্যাপ্তি ঘটেছে যে, সামগ্রিকভাবে নয়, ব্যক্তিবিশেষকে এক এক করে চিহ্নিত করা শুরু হয়েছে। তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের লেনদেন থেকে ব্যক্তিগত কথোপকথন, অনলাইন বিচরণ, কেনাকাটা, লোকেশন ট্র্যাকের মাধ্যমে গতিবিধি, সবকিছুর উপরই নজরদারি চালানো হচ্ছে। বিশ্বের তাবড় গণতান্ত্রিক দেশের সরকারও এই তথ্য আদানপ্রদানে যুক্ত।
নয়া তথ্য-প্রযুক্তি আইনের আওতায় সোশ্যাল মিডিয়ার মেসেজ বক্সে কী কথা চালাচালি হচ্ছে, কে তা চালাচালি করছে, সেই তথ্য খোলসা করতে হবে বলে নিদান দিয়েছে ভারত সরকার। সেই নিয়ে টানাপোড়েন চলছে আজও। সেই পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট নাগরিকদের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারের কথা জানিয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের নাগরিকদের কত শতাংশ নিজেদের সেই অধিকার সম্পর্কে অবগত। অনলাইন মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য বেহাত হওয়া নিয়ে স্বাধীনতার ৭৫ বছরেও কোনও নির্দিষ্ট আইন তৈরি হলো না কেন, প্রশ্ন নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখা গিয়েছে গুটিকয়েক মানুষকেই। আর তাতেই ডালপালা মেলে আরও চারিয়ে বসছে নজরদারি পুঁজিবাদ। তাই তেরঙ্গা উড়িয়ে, জাতীয় সংগীত গেয়ে যতই স্বাধীনতার অমৃতকাল পালন করা হোক না কেন, দাসত্বের শৃঙ্খলে আজও বাঁধা পড়ে ভারত।