উৎসবের আলোর ভিড়ে বঞ্চনার অন্ধকারে ডুবে রইলেন ডেলিভারি শ্রমিকরা

Durgapuja 2022: কেমন কাটল ডেলিভারি শ্রমিকদের দুর্গাপুজো? খোঁজ নিল ইনস্ক্রিপ্ট।

হাজারো রানার ছোটে শহরের পথেঘাটে,
আজ তাঁরা ডেলিভারি বয়...!

সৌমিক দাস

রানার ছুটছে! রানার মরছে! রানার প্রতিনিয়ত বলেই চলেছে! কিন্তু শুনবে কে! কে বলবে রানারের ভালো থাকার কথা! পুজোর মরশুমে, আলোকের ঝর্নাধারায় কে ধুইয়ে দেবে ওঁদের! প্রশ্ন আর কঠিন লড়াইয়ের দোদ্যুল্যমানতায় ওঁরা আজও অনেকের মতোই যেন অসহায়। আজ ওঁরা আমার-আপনার সুপরিচিত ডেলিভারি বয় বা ডেলিভারি শ্রমিক!

তথ্য বলছে, দেশের অর্থনীতি এবং সামগ্রিক শিক্ষিত বেকারের হারবৃদ্ধি, ক্রমশ এক শ্রেণির যুবসমাজকে বানিয়ে দিয়েছে রানার! প্রত্যেক মুহূর্তে ভালো অথবা মন্দের চাকায় ভর করে ইচ্ছাপূরণ, স্বপ্নপূরণ করছেন ওঁরা। শহরের বুক চিরে ছুটে চলেছেন নিরন্তর।

অ্যামাজন-ফ্লিপকার্ট-সুইগি বা জোম্যাটো,
ব্যাগে ভরে দরজায় আসে,
রেটিংটা যদি স্যর দিয়ে দেন ভালো হয়, এই বলে অমলিন হাসে!

সৌমিক দাস

কিন্তু এই অমলিন হাসির মাঝেই লুকিয়ে থাকে কত কিছু! উৎসব-আনন্দ আর অনলাইন ভরসার যুগে একবারও কি ভেবে দেখি কেমন আছেন ওঁরা? সমাজের সমস্ত স্তরের ভালো অথবা খারাপ থাকার আবহে সত্যিই কি ভালো থাকেন ওঁরা?

ইনস্ক্রিপ্ট খোঁজ নিয়েছিল ওঁদের। পুজোর মধ্যেই ছুটেছিল এইসব রানারদের সঙ্গে। সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে, কী অবস্থায় রয়েছেন বর্তমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পেশার এই মানুষেরা! আমরা বারাসত থেকে রাজারহাট, কথা বলি ডেলিভারি পেশার সঙ্গে জড়িত একাধিকের সঙ্গে। কিন্তু তাঁরা যা জানালেন, সেই তথ্য ভয়ানক!

মোবাইল ফোন থেকে অন্তর্বাস। টিভি থেকে ওয়াশিং মেশিন। আবার শাড়ি থেকে গয়না। এমনকি মাছ, সবজি অথবা মশলা। সব ক্ষেত্রেই একটা বহু অংশের মানুষ জড়িত অনলাইন পরিষেবার সঙ্গে। আর এই কাজ করেন ডেলিভারি বয়েরা। যাঁরা কোনও কোনও অনলাইন কোম্পানির সঙ্গে সরাসরি চুক্তিবদ্ধ। আবার কেউ কেউ কোনও থার্ডপার্টি অথবা ভেন্ডারের হয়ে কাজ করেন। আর প্রত্যেকের ক্ষেত্র প্রায় একই। কীরকম?

একটি অ্যাপনির্ভর আন্তর্জাতিক সংস্থা, যারা মূলত খাবারের অনলাইন অর্ডার ডেলিভারি করে, তাদের কর্মী রজত মিত্র। প্রায় ৫ বছর ধরে শুধুমাত্র এই কাজ করছেন তিনি। বর্তমানে একটি মোটরসাইকেল কিনেছেন। সেটাই তাঁর মূল ভরসা। রজত বলছেন, এক-একটি খাবারের অর্ডার ডেলিভারি করলে নূন্যতম ২০ টাকা দেওয়া হয়। এর সঙ্গে কিলোমিটার প্রতি একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু খুব সামান্য। অর্থাৎ আপনি যে খাবারটি পাচ্ছেন তা নির্দিষ্ট রেস্তোরাঁ থেকে গ্রাহক পর্যন্ত ডেলিভারি করতে যদি ১ থেকে ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে হয়, তাহলে সব মিলিয়ে ওই ২০ টাকা রোজগার। এর বেশি হলে কিলোমিটার প্রতি খুব সামান্য টাকা বৃদ্ধি হয়। জ্বালানির প্রবল দাম বৃদ্ধিতে এর তেমন কোনও হেরফের হয়নি বলেই দাবি। এদিকে একই অর্ডার বাই-সাইকেলে ডেলিভারি করলে আরও কম পাওয়া যায় টাকা।

অনলাইনে খাবার ডেলিভারি করে এমন আর একটি জনপ্রিয় সংস্থায় কাজ করেন অমিত কুমার দাস (নাম পরিবর্তিত)। তিনি বলেন, ''একটি কোম্পানির গ্রাহক বকশিস দিলে সেটি সরাসরি নির্দিষ্ট ওই ডেলিভারি বয়ের অ্যাকাউন্টে পৌঁছে গেলেও আমাদের এই কোম্পানির ক্ষেত্রে সেই নিয়ম নেই। আবার টাকার ক্ষেত্রেও রয়েছে মারাত্মক সমস্যা।'' তিনি অভিযোগের সুরে জানান, "হয়তো কোনও খাবার ডেলিভারি করতে আমার ৭ কিলোমিটার পথ যেতে হল, সেখানেও কোম্পানি মাঝে মধ্যেই কারচুপি করে কিলোমিটার কম দেখায়, যাতে আমার পাওনা সহজেই কমে যায়।"

মাত্র ৬ মাস হয়েছে সাইকেলে খাবার ডেলিভারির কাজ শুরু করেছেন করোনা-কালে কাজ হারানো অসিত গায়েন (নাম পরিবর্তিত)। ২০২০ সাল পর্যন্ত একটি বেসরকারি বীমা কোম্পানির অস্থায়ী কর্মী ছিলেন তিনি। অসিত বলেন, "সারাদিন ধরে একটা চাপ থাকে, যত বেশি অর্ডার আমি পাব, টাকাও আয় হবে, কমবেশি মিলিয়ে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে সেটাও আসে না। সংসারের চিন্তা থাকে রোজ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনলাইন থাকি। যদি একটু আয় বেশি হয়! কিন্তু আর হয় কই!"

বেশি আয়ের আশায় গুজরাতে গিয়ে এই একই কাজ করেছিলেন রজত। তাঁর দাবি, গুজরাতের মতো রাজ্যে অর্ডারের হার অনেক বেশি। তাই খানিকটা পুষিয়ে যায়। তবে চিন্তা থাকে সব জায়গাতেই, কীভাবে সংসার চলবে ভাবতেই হয়!

তাহলে কেন করছেন এই কাজ? এই প্রশ্নের উত্তরে সকলেই প্রায় জানান তাঁদের অপারগতার কথা। আসলে একটা সময় অন্য কাজ বা ব্যবসা করতেন ওঁরা। করোনা, আবার নানা কারণে সেই কাজ আজ আর নেই বা চলে গিয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই তাঁরা করে চলেছেন এই কাজ।

ঠিক এই প্রসঙ্গেই একটি জনপ্রিয় অনলাইন শপিং সংস্থার ডেলিভারি বয় সঞ্জিৎ সাহা (নাম পরিবর্তিত) বলেন, "আমাদের আবার অন্য ব্যাপার। এখানে ভেন্ডার সিস্টেমে ডেলিভারি করি। অর্থাৎ সরাসরি কোম্পানি আমাদের টাকা দেয় না। তারা ভেন্ডারকে যে পরিমাণ টাকা দেয়, সেটার তুলনায় অনেক কম জোটে আমাদের ভাগ্যে। তবুও কাজটা ছাড়তে পারিনি, কারণ বিকল্প নেই! অথবা এখনও বিকল্প পাইনি।''

তাঁরা কাজ করেন। অনেকেই বলেন, নাকি চাকরি করেন ওঁরা! কিন্তু কী কী সুবিধা বা অসুবিধা রয়েছে এই ডেলিভারি বয়দের জন্য।

কর্পোরেটের পুঁজি...
এরাই তো তিমি মাছ চারাপোনা গিলে নেবে, ঢেঁকুরের নেইকো বালাই!

সৌমিক দাস

মূলত, কোম্পানি অনুযায়ী খানিকটা হেরফের হয় সুবিধার। তবে সবার ক্ষেত্রেই প্রায় একই থাকে সবটা।

প্রথমত, চাকরি বা এই কাজের কোনও নিশ্চয়তা নেই অন্যান্য অনেক বেসরকারি চাকরির মতোই।

দ্বিতীয়ত, সাপ্তাহিক কোনও ছুটি অথবা শরীর খারাপ হলে টাকা পাওয়ার ব্যাপার এখানে নেই। সবক্ষেত্রে রয়েছে কাজ করলে কমিশন না করলে কিছুই নয়।

তৃতীয়ত, ছুটি বা উৎসবের কোনও বোনাস অথবা বিশেষ সুবিধা এখানে নেই। কয়েকটি কোম্পানিতে উৎসবে খাবার পৌঁছে দিলে রয়েছে একটু অতিরিক্ত টাকা।

চতুর্থত, কয়েকটি কোম্পানিতে কাজ করতে করতে দুর্ঘটনায় কোনও ডেলিভারি বয়ের মৃত্যু হলে বিমার ব্যবস্থা থাকলেও তিনি যখন অফলাইন অর্থাৎ ডেলিভারি করছেন না, সেই সময়ে কিছু হলে দায় নেবে না কোম্পানি। অর্থাৎ যতক্ষণ কাজ ততক্ষণ বীমা। আবার এই সুবিধাটুকুও নেই একাধিক কোম্পানির হয়ে কাজের ক্ষেত্রে।

পঞ্চমত, অনেক ক্ষেত্রেই ডেলিভারি করতে নানা কারণে দেরি হলে টাকা কাটা যাওয়া, গ্রাহকের অভিযোগে অসুবিধার সম্মুখীন হওয়ার মতো ভয় রয়েছে এই পেশার ক্ষেত্রে।

ষষ্ঠত, খাবার পৌঁছে দিয়েও রয়েছে গঞ্জনা। বহু গ্রাহকের কাছে জোটে তিরস্কার। আবার অনেক জায়গাতেই রেস্তোরাঁ বা গ্রাহকের কাছে শারীরিক হেনস্থার শিকার হতে হয় ডেলিভারি বয়দের অনেককেই! এর সঙ্গেই রয়েছে বেশি রাতে পুলিশি ঝামেলাও।

সপ্তমত, তাড়াতাড়ি এবং সময়ে ডেলিভারির তাগিদে রাস্তায় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়ে।

তবুও কাজ করেন ওঁরা। উৎসবের সময় বেশি কাজ করেন খানিকটা অতিরিক্তের আশায়। তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র সল্টলেক সেক্টর ফাইভে অন্যান্য পেশায় কাজ করেন এমন কেউ কেউ ডেলিভারি পেশার সঙ্গেও জড়িত। এমনই একজনের সঙ্গে কথা বলি আমরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি বলেন, ''প্রায় ৯ বছর ধরে মাসিক ৬ হাজার তারপর সব কেটে ৮ হাজার টাকা বেতনে সল্টলেকের ডিএলএফের কাছের একটি আবাসনে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করছি। অনেকটা দূর থেকে আসি। থাকা-খাওয়ার জন্য টাকা চলে যায় অনেকটা। দুটো বাচ্চা। স্ত্রী। সংসার চালাতে ছুটির সময়ে খাবার ডেলিভারি করি সাইকেলে। আমার মোটর সাইকেল নেই। খুব সামান্য আয় হয়। তবুও কাজটা করি। কোনও বিশেষ সুবিধা নেই এখানেও। কিন্তু খারাপ লাগে তখন, যখন দেখি যাঁকে খাবার দিলাম, তিনিই পান থেকে চুন খসলেই অশালীন মন্তব্য করেন আমাদের দেখে।''

পুজোয় বাড়ি যাবেন? "নাহ্, পুজোয় বাড়ি গেলে অতিরিক্ত আয় হবে না। এমনিতেই সব সামলে কাজটা করি। বাড়িতে বলেছি, অপেক্ষা করতে, মেয়ের জন্য পিৎজা নিয়ে যাব। ও খুব ভালো খায়!''

ডেলিভারি পেশায় জড়িতদের নিয়ে ২০২০ সালে 'আভাজ ২৪' নামের একটি নিউজ সাইট প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখিত একটি পরিসংখ্যান বলছে, শুধুমাত্র এদেশেই প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ ডেলিভারি পেশার সঙ্গে যুক্ত। এদের মধ্যে অশিক্ষিত প্রায় নেই। অর্থাৎ দেশের একটা বড় অংশের শিক্ষিত বেকার এই পেশা বেছে নিয়েছেন। যা ২০১৮-২০১৯ সাল নাগাদ এর প্রায় অর্ধেক থাকলেও করোনা এবং বাড়িতেই সব পাওয়ার তীব্র চাহিদায় বেড়েছে তরতরিয়ে। আর এর সঙ্গেই যোগ হয়েছে চাকরি যাওয়া। প্রায় কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। হাজার হাজার কোম্পানি কর্মী ছাঁটাই করেছে। কাজ হারিয়েছেন কোটি কোটি। অনেকেই বিকল্প পেশা বেছে নিয়েছেন। আবার আত্মহত্যা করেছেন কেউ কেউ। ঠিক এই পরিস্থিতিতেই ডেলিভারি পেশার সঙ্গে জড়িয়েছেন বহু মানুষ। যাঁদের হাতে অন্য কোনও কাজ নেই তাঁরা। এই পরিস্থিতি আর ফের কর্পোরেটের জাঁতাকলে পিষেছেন এইসব ডেলিভারি বয়েরাও। করোনা কমলেও খুব একটা বদল হয়নি অর্থনীতির। চাকরির সুযোগ বাড়েনি আর। তাই প্রায় সুযোগের অভাবে এই কাজে মন দিয়েছেন অনেকেই। ঠিক এই প্রেক্ষাপটে এমএ পাশ বিপুল মণ্ডল, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার সৌভিক দত্তও বেছে নিয়েছেন এই পেশা!

আভাজ ২৪-এর ওই প্রতিবেদনের পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে, এই ডেলিভারি পেশার সঙ্গে জড়িতদের ১৮ শতাংশ দিনের প্রায় ১৫ ঘণ্টা কাজ করেন। আবার দিনের ১২ ঘণ্টা কাজ করেন প্রায় ৪৭ শতাংশ ডেলিভারি বয়। এদিকে এই পেশায় নিয়োজিত ৭০ শতাংশই ১৮-৩০ বছররের গোষ্ঠীর। অর্থাৎ যুব সমাজের একটা বড় অংশ ডেলিভারির সঙ্গে জড়িত। কাজের অভাবেই তাঁরা বেছে নিয়েছেন এই প্রবল অনিশ্চিত পেশা, বলছেন অনেকেই।

এদিকে মাসিক স্বল্প আয়ের মধ্যেই রয়েছে একাধিক কোম্পানির জরিমানা অর্থাৎ পেনাল্টির নিয়ম। যেখানে ধরা যাক, কোনও ডেলিভারি বয় সপ্তাহজুড়ে ৫টি অর্ডার নিলেন না, ক্যান্সেল করলেন। সেক্ষেত্রে অনেক সময় তাঁর প্রাপ্য থেকে কাটা যেতে পারে ৫০০ টাকা পর্যন্ত! আবার গ্রাহকের রেটিং এবং অভিযোগের উপরেও খানিকটা নির্ভর করে এঁদের ভাগ্য।

কী ভাবছে সরকার?

ভোট আসে ভোট যায়, সরকার ক্ষীর খায়,
ওঠে শুধু সিবিআই ঢেউ!

সৌমিক দাস

২০১৯ সালের অগাস্টে শ্রমিক সংগঠন সিটু এবং একটি অ্যাপ নির্ভর খাবার ডেলিভারি সংস্থার কর্মীরা দাবি করেন, নতুন শ্রম আইনের আওতায় আনা হোক তাঁদের। সুযোগ-সুবিধা নিয়েও ভাবা হোক। কিন্তু সেই বিষয়ে খুব একটা এগোয়নি কোনও কিছুই।

ন্যায্য মাইনেটুকু ওদেরও প্রাপ্য দাবি, এই কথা বলে না তো কেউ!

সৌমিক দাস

যদিও মাঝে মাঝেই ডেলিভারি বয়দের নিয়ে সরব হয়েছেন কেউ কেউ। উপরন্তু, পরবর্তীতে অভিযোগ উঠেছে, টাকা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনে অংশ নিলেই সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে কাজ যাওয়ার, সেই সম্ভাবনা তৈরি করছে কোম্পানিগুলো!

অভিযোগ ওঠে কয়েকটি ক্ষেত্রে ভেন্ডারদের মাধ্যমে ডেলিভারি নিয়েও। দাবি, অনেক সময় বকেয়া টাকা দেন না ভেন্ডাররা। নির্দিষ্ট কোম্পানি প্রাপ্য মিটিয়ে দিলেও গড়িমসি করতে থাকেন তাঁরা। অর্থাৎ কাঁটার পথের কাজ আবার সেখানেও অতিরিক্ত বিপদের সম্মুখীন হতে হয় তাঁদের। অনেকসময় ক্যাশ অন ডেলিভারি করতে গিয়েও সমস্যায় পড়েন ওঁরা। কিছু গ্রাহক অর্ডার দেওয়া দ্রব্যের সঙ্গে ডেলিভারি বয়ের কোনও সম্পর্ক না থাকলেও টাকা নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি করতে থাকেন। এর সঙ্গেই রয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির একাধিক নির্দেশ। নিয়মাবলী। যা পর্যাপ্ত অর্থ ছাড়া সবই প্রকাশ করে বারবার।

এই বঞ্চনা নিয়ে কী বলছেন অধ্যাপক এবং সমাজকর্মী মীরাতুন নাহার। ইনস্ক্রিপ্ট-কে তিনি বলেন, ''এঁরা বঞ্চিত শুধু নন, মর্মান্তিকভাবে বঞ্চিত। আর এর জন্য দায়ী, কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের অপরিকল্পিত, অবাস্তব পদক্ষেপ। করোনা রুখতে লকডাউন। কিছু না ভেবেই বিদেশের অনুকরণ করতে গিয়ে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির ক্ষতি যেমন হয়েছে, তেমনই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। নিম্নআয়ের সঙ্গে জড়িত শ্রেণী। এই ডেলিভারি বয়েরা হয়ত তারই শিকার।'' তাঁর বক্তব্য, ''একজন মানুষ শ্রম দেওয়ার পরেও কেন কাজ হারাবেন, কেন তাঁকে বিকল্প পথ বাছতে হবে। এই ব্যর্থতা তো সরকারেরই। শিক্ষিত শুধু নয়, যাঁরা দৈহিক শ্রমেও রোজগার করতেন তাঁদেরও ক্ষতি হয়েছে। যে ক্ষতির মাশুল দিতে আজ অপারগ রাষ্ট্র।''

যদিও এই বঞ্চনার প্রতিবাদ শুরু হয়েছে এই সমস্ত ক্ষেত্রের কর্মীদের একাংশের মধ্যে। বেনামে গত অগাস্টে ধর্মঘটের ডাক দেয় সুইগি-সহ একাধিক সংস্থার ডেলিভারি বয়েরা। ফের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ধর্মঘটে নামেন বেঙ্গালুরু, মুম্বই, কলকাতার রাজারহাট, সোদপুর-সহ একাধিক এলাকার ডেলিভারি বয়েরা। অর্ডার প্রতি নূন্যতম ৩৫ টাকা কমিশনের দাবিতে সরব হন তাঁদের একাংশ। পুজোর মুখে এই ধর্মঘটে অস্বস্তিতে পড়ে সুইগি। ধর্মঘটিদের দাবি, "দিনের পর দিন আমাদের বঞ্চিত করে চলেছে কোম্পানিগুলো, কোনও সুরাহা নেই। তাই উৎসবের মুখেই এই পথ বেছে নেওয়া।''

এদিকে গড়িয়াহাট, বালিগঞ্জ, কসবা, যাদবপুর, ভিআইপি বাজার, বেহালা, নেতাজিনগর, পার্ক স্ট্রিট, শ্যামবাজার-সহ কলকাতার একাধিক এলাকায় পুজোর মুখেই ধর্মঘটের ডাক দেন অনলাইন গ্রসারি ডেলিভারি সংস্থা ব্লিঙ্কিট-এর ডেলিভারি বয়েরা। তাঁদের দাবি, ''মানুষের ঘরে অনলাইন অর্ডারজাত দ্রব্য পৌঁছে দিলেও বঞ্চিত হচ্ছি আমরা, তাই এই প্রতিবাদ।''

Blinkit strike

ব্লিংকইট কর্মীদের ধর্মঘট

বঞ্চনার অতলে পুজোহীন ছিলেন ওঁরা। আনন্দ ছিল না উৎসবেও। ছিল আয়ের সঙ্গেই বয়ে চলা হতাশা। ভালো না থাকার চলন্ত নদী। ছুটি ছিল। তবে ছিল না টাকা। তাই যেন, আয়-হীন ছুটিতে আর মজেননি ওঁরা। প্রত্যেক মুহূর্তে চেষ্টা করেছেন, যদি একটু বেশি কিছু আসে। খানকিটা ভালো থাকা যায় আবার। রাস্তার ধারের ঝালমুড়িওয়ালা অথবা ট্রেনের বাদাম বিক্রেতা, মেলায় মেলায় খেলনা বেচা বৃদ্ধ; সকলের মতোই তীব্র লড়াইয়ে ভালো থাকার রসদ খুঁজতে থাকেন ওঁরা। না পাওয়া আর হতাশার দোলাচলে স্বপ্ন দেখেন রোজ। রানারের মতোই ছুটে চলে হতাশা, বেদনা আর ভালো থাকার মিশ্রিত মেঘ, যা পুজোর গন্ধ ঢেকে দেয় এক অমলিন নিঃশব্দ চিৎকারে। সমস্ত বঞ্চনার সঙ্গেই যেন ওঁরা বলে ওঠেন, ''আমরা যে শুধুই ডেলিভারি বয়!''

More Articles