২৩৭ সপ্তাহ ১ নম্বর থাকা আর নিরহং হাসি, ফেডেরার যা রেখে গেলেন

Roger Federer: এই সহস্রাব্দে যখন বিশ্বায়নের খোয়াব চুরচুর হয়ে চারিপাশে নেমে আসছে সর্বগ্রাসী অবক্ষয়, তখনও কোথাও গিয়ে যেন রজার ফেডেরার – দ্য ক্ল্যাসিক্যাল।

বিমূর্ত। ভালোবাসা, স্বপ্ন, কবিতা আর সৌন্দর্যের মতই ফেডেরার বিমূর্ত। আবার মূর্তও। গ্রীক ভাস্কর্যের মতো মুখশ্রী, সাদা হেডব্যান্ড আর ওই অপাপবিদ্ধ হাসিতে একান্ত মূর্ত। তিনি একইসঙ্গে তারার গুঁড়ো দিয়ে তৈরি মায়া আর হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে ফেলবার মতো মহাতারকা। তিনি একদিকে ইতিহাসের অন্যতম সফল টেনিস প্লেয়ার, অন্যদিকে রেকর্ড-বইকে অপাংক্তেয় করে দেওয়া সেরার সেরা শিল্পী। কবি আর গদ্যকারেরা তাঁর খেলায় খুঁজে পায় চিরন্তন সব জটিল দ্যোতনা। আবার, ছোট্ট একটা ছেলে তাঁকে প্রেস কনফারেন্সে অনুরোধ করতে পারে সে বড় হওয়া অব্দি যেন ফেডেরার খেলা চালিয়ে যান। তাতে ফেডেরার উত্তর দেন ভালোবাসায় ভরা একজন আত্মীয়ের মতো। রজার ফেডেরার টেনিস খেলোয়াড় ছিলেন না। তিনি মিস্টার টেনিস।

উইম্বলডনের সেন্টারকোর্ট রাজকীয় এই খেলার সবচাইতে অভিজাত রাজসভার মতো। সেখানেই বারবার সিংহাসনে আসীন হয়েছেন রজার ফেডেরার। ঝলমল করে উঠেছে সভাকক্ষ। রাজা রজারের ছটায় আলোকিত হয়ে গর্বিত হয়ে উঠেছে স্বয়ং সিংহাসনই। রজার ফেডেরার ভালোবাসা কুড়িয়েছেন। রজার ফেডেরার ভালোবাসা ছড়িয়েছেন।

ফেডেরার চব্বিশ বছর ধরে একটা চলমান ঘটনার নাম। যে ঘটনা টেনিসের পৃথিবীকে এক ঝটকায় উল্টে দিয়েছে। ওয়ানডে ক্রিকেটের ধুমধাড়াক্কার মধ্যেই সাদা পোশাকে সচিনের ব্যাটিং দেখে রিচি বেনো বলেছিলেন যে, তিনি টেস্ট ক্রিকেটের কাছে জীবনের চুম্বন রূপে দেখা দিয়েছেন। হার্ডরক গানের রমরমার যুগে, পরিশ্রমী পেশাদারিত্ব, শারীরিক ফিটনেস আর দমের ওপর নির্ভরশীল পাওয়ার-টেনিস যখন নব্বইয়ের দশকে আলগা আভিজাত্যে মোড়া এই খেলাটাকে আর পাঁচটা অ্যাথলেটিক স্পোর্টসের মতো বানিয়ে ফেলছিল, তখনই যেন ঐতিহ্যবাহী শিল্পের প্রতিভূ রূপে দেবদূত ফেডেরারের মর্ত্যে আগমন – শেক্সপিয়রীয় সনেটের শেষ কাপ্লেটের মতই অমোঘ, সুন্দর এবং চূড়ান্ত।

বিখ্যাত মার্কিন টেনিস খেলোয়াড় জিমি কনর্স বলেছিলেন যে স্পেশালাইজেশনের যুগে কাউকে হয় গ্রাস কিংবা হার্ড বা ক্লে কোর্টে বিশেষভাবে সফল হওয়ার দিকে মন দিতে হবে, নয়তো রজার ফেডেরার হতে হবে। এই ভার্সেটিলিটি রজারকে এনে দিয়েছে হার্ড কোর্টে ছ'টা অস্ট্রেলিয়ান ওপেন আর পাঁচটা ইউএস ওপেন, ক্লে-কোর্টে একটা ফরাসি ওপেন, আর একান্ত তাঁরই যে প্রতিযোগিতা, ঘাসের সারফেসে সেই উইম্বলডন জিতেছেন ৮বার। তবে কয়েকবার তিনি সেন্টার কোর্টে জেতেননিও বটে। ২০১৯ সালের সেই মহাকাব্যিক দ্বৈরথে পাঁচ ঘণ্টার যুদ্ধের শেষে যখন জকোভিচের কাছে ফেডেরার হারলেন, তখন মনে হচ্ছিল ফেডেরার জিতলে রোমান্স বিষয়টাই মরে যাবে। কে না জানে রোমান্স বেঁচে থাকে অপূর্ণতার মাধুর্যে। যন্ত্রবৎ মহা-অ্যাথলিটের কাছে অতক্ষণ ধরে যুঝেও নন্দনের কাঙাল স্রষ্টার হারটা যেন ভিক্টোরিয়ান কবিদের, কলকারখানার ধোঁয়ায় প্রকৃতির নিখাদ রূপ নষ্ট হওয়ার, সেই কষ্টে ধরা আছে, ধরা আছে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী নগরসভ্যতার বিজয়রথে বিচলিত হয়ে তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি ফেরত আনবার আকুতিতে। সেই আকুতি এবং কষ্টের ছত্রে ছত্রে অনিরুদ্ধ বিধুরতা। প্রাণঢালা ভালোবাসার ধারায় কোনও অনুপম শিল্পকর্মকে আপাদমস্তক সিক্ত করে তুলতে ওইটুকু বেদনালীন বিধুরতা লাগে।

আরও পড়ুন-গরিমা হারাবে রজার পরবর্তী টেনিস! অবসরের খবরে কী বলছেন সানিয়া, সচিন, মেসিরা?

ফেডেরারের খেলায় সাম্প্রাসোচিত সার্ভ ছিল না বলে অনেক বিশুদ্ধবাদি দাবি করেছেন। কিন্তু যে খেলোয়াড় ফোরহ্যান্ড মারেন সাক্ষাৎ অলৌকিক মহাপুরুষের মতো আর ব্যাকহ্যান্ড মারেন অতিমানবীয় ছলাকলার ম্যাজিক দেখিয়ে, তাঁকে সার্ভ নিয়ে বেশি চিন্তা করতে হবেই বা কেন। সমালোচকেরা তুল্যমূল্য বিচার-টিচার করুন না হয়, আমার মতো মুগ্ধ দর্শকের চোখে, সাদা হেডব্যান্ডের ওপর এসে পড়া চুল সরিয়ে, বার দুই টেনিস-বলটা ড্রপ করিয়ে শরীরকে একটা বিশেষ বিভঙ্গে ভাঁজ করে যখন ফেডেরার সপাটে বলটা মেরে দিতেন বিপক্ষের কোর্টে, তখন সেই সপাট মারে চাবুকের ঘায়ের মতো কোনও বিষাক্ত দ্বেষ, ঘৃণা বা রাগ থাকত না, থাকত পাকা লক্ষ্যভেদীর শরনিক্ষেপের সাবলীল নির্ভুলতা। সেই শরসন্ধানের উদ্দেশ্য হত্যা নয়, নেহাতই চাঁদমারির কেন্দ্রস্থল বিদ্ধ করে শ্রেষ্ঠত্ব দর্শান।

কোথাও একটা পড়েছিলাম, চ্যাম্পিয়ন সাঁতারুরা যেভাবে পুলের জলে আলোর আলোড়ন তুলে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যান, ঠিক সেইভাবেই সাদা জামা পরা ফেডেরার উইম্বলডনের সবুজ কোর্ট কভার করেন। ওই চোখ-ধাঁধানো আলোকচ্ছটায় মনে হয় সাঁতারু যেন মিশে গেছেন জলের মধ্যে একটা তরঙ্গ হয়ে, ফেডেরারের ব্যাপারেও তেমনই মনে হতো, যেন তিনি কোর্টেরই এক উপাদান। তাঁর প্রতিপক্ষদের তো মনে হবেই যে তাঁরা খেলছেন সাক্ষাৎ টেনিসেরই বিরুদ্ধে। যে কারণে এত স্বতঃসিদ্ধ মনে হতো ফেডেরারের জয়।

ফেডেরার তাই বলে অপরাজেয় ছিলেন, এমনটাও না। সে তিনি যতই একটানা পাঁচটা করে ইউএস ওপেন আর উইম্বলডন জিতে নিন, মাঝেমাঝে তাঁর খেলা দেখে বোঝা যেত যে তিনি রাশ আলগা করছেন। ফেডেরার কোনওদিন শরীরের আর ষষ্ঠেন্দ্রিয়র সিগন্যাল অগ্রাহ্য করে, মনের জোরে ম্যাচ টানার চেষ্টা করেননি। যেন ওসব করলে তাঁর রাজকীয় গরিমায় দাগ লেগে যাবে। তিনি জিতলে সম্রাটোচিত মেজাজেই জিতবেন, জেতার জন্য নিছক শ্রমজীবী পথের আশ্রয় তিনি নেননি। দরকারও হয়নি।

দরকার হবেই বা কেন! ফেডেরার যে, অন্য সবকিছুর আগে ভয়ংকর অনায়াস। হাসতে হাসতে ফেডেরার সাঁইত্রিশ বছর বয়সে গ্র্যান্ডস্ল্যাম জিততে পারেন। অক্লেশে একাদিক্রমে ২৩৭ সপ্তাহ জুড়ে থাকতে পারেন পয়লা র‍্যাঙ্কে। গেমপয়েন্টের মুখোমুখি হয়ে মারতে পারেন এক একটা মাখনের মতো স্লাইস। অনায়াসেই আবার ব্যালে নাচের ভঙ্গিমায় ছুটে নেটের কাছে এসে সরলমতি শিশুর নির্দোষ দুষ্টমির মতো বলটা প্লেস করে দিতে পারেন ক্লান্ত প্রতিপক্ষের নাগালের জাস্ট একটু বাইরে। এসব করে আবার হাসতেন। বিদ্রুপের হাসি নয়। দর্পের হাসি নয়। এমনকি মহানতার প্রশান্ত হাসিও নয়। দুষ্টু-মিষ্টি অনাবিল হাসি। ফেডেরারের কাছে গোটাটাই যেন তরল কৌতুক, অনায়াসে। সেই অনায়াস ভঙ্গিতে যন্ত্রের ক্লকওয়ার্ক নেই, আছে সত্যেন দত্তের স্বতস্ফূর্ত ছন্দ।

এই ঐশ্বরিক কৌতুকের ছোঁয়াই যেন দেখা যায় তাঁর অনেক বিখ্যাত শটে। ১২৫১টা সিঙ্গলস ম্যাচ জেতার কথা সবাই ভুলে যেতে পারে, কিন্তু বড় ম্যাচে টানটান চাপের মুখে ওইসব কাব্যিক হিট ভোলে কার সাধ্য। জকোর বিরুদ্ধে সেই ইউএস ওপেন ম্যাচে টুইনার মারার আগে তিনি দৌড়ে বলের পিছু নিতে নিতে হঠাৎ গতিটা কমিয়েছিলেন। যেন বুঝতে পেরেছিলেন আর কষ্ট করার দরকার নেই। হাতের নাগালে পেলেই হবে। হয়েওছিল। দুপায়ের ফাঁক দিয়ে পেছন দিকে ঘুরে, রক অ্যান্ড রোল ড্রামারের ক্র্যাশ সিম্ব্যালে কাঠি মারার কায়দায় করা ওই রিটার্নটা জকোকে ব্যোমকে দিয়েছিল ওই অচিন্তনীয় প্লেসমেন্টে। পয়েন্ট জিতে নেন ফেডেরার। আরেকটা দেখবার মতো শট তাঁর দৌড়তে দৌড়তে করা ব্যাকহ্যান্ড ফ্লিক। তাতে হাত ধরাধরি করে চলে সৃষ্টির চুম্বন আর ধ্বংসের মত্ততা। কব্জির ওই মোচড়টার সঙ্গে তুলনীয় রেঁমব্রোর ছোট স্ট্রোকে আঁকা অনচ্ছ আলোর রেখা।

একটা সময়ে বলা হতো আগাসি ফেডেরারের থেকে বেশি সক্ষম সব প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু দাবিটা ধোপে টেকেনি। নাদাল আর জকোভিচের মতো দুইজন খেলোয়াড় তাঁর কেরিয়ারের সিংহভাগ জুড়ে যে টেনিসটা খেলেছেন তাতে তাঁরাও সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ উপাধি লাভ করার দাবিদার। নাদাল পাওয়ার-টেনিসের পোস্টার-বয়। ফরাসি ওপেনের তুলনাহীন চির-চ্যাম্পিয়ন। জকোভিচ ব্যকরণের নিয়ম মেনে কম্পিউটার সিম্যুলেশনের মতো ক্লান্তি-সুপ্তিহীন। ফেডেরারের প্রথম গ্র্যান্ডস্ল্যাম আর অবসরের মাঝে এই দু'জন মিলে জিতেছেন অচিন্তনীয় ৪৩টা গ্র্যান্ডস্ল্যাম। কিন্তু কী আশ্চর্য! ফেডেরার তাঁদের থেকে অঙ্কের হিসেবে সামান্য কম সফল হয়েও এই দু'জনকে নামিয়ে দিয়েছেন আন্ডারডগের পর্যায়ে। এই দু'জনের জয়ের স্ক্রিপ্ট যেন তাঁদের বিজয়গাথা নয়, বরং ফেডেরারের অচিন্তনীয় ব্যর্থতা। ঈশ্বরের পদস্খলন। নাদাল ওঁকে লাল সুরকির কোর্টে ষোলোবার খেলে চোদ্দোবার হারিয়েছেন। জকোভিচ আর ফেডেরারের ক্লে-কোর্টের দ্বন্দ্ব ৪-৪ ড্র হলেও, হার্ড সারফেসে আর ঘাসে বেশিবার জিতেছেন জকোই। তবু বিগ থ্রির মধ্যে সন্দেহাতীত পয়লা নম্বর কে, এই প্রশ্নের জবাবে টেনিস পৃথিবী মোটেই ত্রিধাবিভক্ত হয়ে নেই। মোটামুটি সবাই ঐকমত্য যে ফেডেরার সবার সেরা। গ্র্যাফাইটের র‍্যাকেটে খেলা আর কোনও প্লেয়ারকে ফেডেরারের পাশে বসালে টেনিসের রসিকমহল রীতিমত রে-রে করে উঠবে। কাঠের র‍্যাকেটে খেলে যাওয়া কিংবদন্তি রড লেভার একমাত্র প্লেয়ার যাঁকে হয়তো ফেডেরারের সঙ্গে সিংহাসন ভাগ করার সুযোগ দেওয়া যায়। পুরুষদের টেনিসে স্বপ্নের ফাইনাল লেভার আর রজারেরই। সেই ম্যাচের সমীকরণ বেশ সরল – কাঠের র‍্যাকেটে খেলা হলে জিতবেন লেভার। গ্র্যাফাইটের র‍্যাকেটে জিতবেন ফেডেরার।

আমার পছন্দের এক ক্রীড়াসাংবাদিকের একবার সাক্ষাৎকার নিতে পেরেছিলাম। নাদাল তখন সদ্য একুশতম গ্র্যান্ডস্ল্যাম জিতে ফেডেরারকে টপকে গেছেন। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম এবার নাদালই কি তবে সর্বশ্রেষ্ঠ! উত্তর এসেছিল - নাদাল হলেন দ্য গ্রেটেস্ট চ্যালেঞ্জার। ফেডেরার জাদু এমনই যে নাদালের মতো অপ্রতিরোধ্য তেজকেও চরম ও পরম না হয়ে হতে হয় নেহাতই প্রতিস্পর্ধী - অ্যান্টিহিরো। ওই সাংবাদিককেই একবার লিখতে দেখেছিলাম– ফেডেরার গ্রেটেস্ট প্লেয়ার আর নাদাল গ্রেটেস্ট প্লেয়ার অফ ফেডেরার। ফেডেরার আর নাদালের যুদ্ধ আমার কাছে দৈবী অবশ্যম্ভাবিতার বিরুদ্ধে মানুষী প্রতিজ্ঞার লড়াই। নাদাল চির-প্রমিথিউস। ঈশ্বরের নিশ্চিদ্র প্রহরা ভেদ করে তাঁকে ছিনিয়ে আনতে হয় আগুনের দু'টো-চারটে ফুলকি। প্রফেশনাল স্পোর্টের চূড়োয় দাঁড়িয়ে তাঁরা যেভাবে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধানম্র, তাতে অবাক হয়ে যেতে হয়। স্বতঃসিদ্ধ চ্যাম্পিয়ন ও চ্যালেঞ্জার যেন এই মহানাট্যে পরস্পরের ভূমিকা সন্বন্ধে ওয়াকিবহাল। রেবেল নাদালও সেই ললাটলিপি খণ্ডন করার বৃথা চেষ্টা করেননা। ফেডেরারও স্বীকৃতি দেন নাছোড় নাদালের পেশী এবং প্রত্যয়কে।

বিগ-থ্রির বাইরেও ফেডেরারকে মহড়া নিতে হয়েছে মারে, হিউইট আর আগাসির। ফেডেরার যাঁকে সরিয়ে প্রথমবার একনম্বর র‍্যাঙ্ক হাসিল করেছিলেন, সেই রডিককে এতো একপেশেভাবে বারবার হারিয়েছেন গোটা কেরিয়ার জুড়ে, যে রডিক নিজেই বলেছেন, মিডিয়া যতই বলুক, ওটা মোটেই কোনও সিরিয়াস 'রাইভালরি' নয়। আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী, স্বদেশবাসী ওয়ারিওয়াঙ্কার সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্বযুদ্ধ যত উপভোগ্য হয়েছে তার থেকে ঢের বেশি জমেছে তাঁদের ডাবলস জুটি। একসঙ্গে ওঁরা সোনার পদক জিতেছিলেন বেইজিং অলিম্পিকসের মেন্স ডাবলস ইভেন্টে।

আরও পড়ুন- রাজা রজার || ২৪ বছর ধরে রচিত এক মহাকাব্য

নয়াদিল্লিতে একবার একটা অনুষ্ঠানে ফেডেরারকে প্রথম সারিতে বসা এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন মিস্টার নাদাল বলে অভিহিত করে। ফেডেরার তাতেও অবিচলিতভাবে হেসে উত্তর দিয়েছিলেন। অন্য যে কেউ হয়তো মেজাজ হারাত, অন্তত যারপরনাই বিরক্তি প্রকাশ করে ফেলত। রজার অন্য ধাতুতে গড়া। বৈশ্বিক রাজনীতিতে সুইজারল্যান্ড যেমন কারুর সঙ্গে ঝগড়ায় জড়ায়না, এই সুইস তারকাও যেন একইভাবে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলেন। ফেডেরারকে কোর্টে মেজাজ হারাতে আদৌ দেখা গেছে কিনা সেটা রীতিমত বিতর্কের বিষয় হতে পারে। একবার-দু'বার আম্পায়ারকে গালাগাল করে ফেলেছেন ঠিকই, কিন্তু যত দিন গেছে তত পরিমিত, বিনয়ী এবং মার্জিত হয়েছে তাঁর চালচলন। খেলোয়াড় হিসেবেও তাঁর যে আর্টিস্টিক টাচ, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অন্তত মধ্য-ত্রিশ অব্দি সেটির মাধুর্য বেড়েছেই শুধু। তাই বলে ফেডেরার কিছু কম অ্যাথলেটিক নন। সবচেয়ে বেশি বয়সে এটিপি র‍্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর হয়েছিলেন তিনি। সাঁইত্রিশ ছুঁইছুঁই বয়সে জিতেছেন গ্র্যান্ড স্ল্যাম। উনত্রিশতম জন্মদিনের কয়েক মাস আগে চার ঘণ্টা সাতান্ন মিনিটের ফাইনালে মরণপণ লড়াই করেছেন। অদ্ভুত শারীরিক এবং মানসিক কাঠিন্য ছাড়া এসব একান্তই অসম্ভব। ফেডেরারের মুনশিয়ানা এখানেই যে তিনি তাঁর সব পেশাদারি বাস্তব গুণাবলীকে প্রতিভার মায়াবী ছটায় ঢেকে যখন নিজেকে মেলে ধরেন তখন খালি মনে হয় তিনি বিশুদ্ধ ইন্দ্রজাল।

যেকোনও শিল্পধারার ভক্তরা ফেলে আসা একটা সময়কেই রোমান্টিসাইজ করে স্বর্ণালী যুগ বলে অভিহিত করেন। সেই সময়টা যাঁরা চোখে দেখেননি, তাঁরাও নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হন খানিক স্পষ্ট, খানিক অস্পষ্ট অতীতের রঙে-রূপে। অথচ পুরুষদের টেনিসে সোনালি যুগেই আমরা টেনিস দেখেছি গত কুড়ি বছরে। এই ডেটা বিপ্লবের যুগেও, অন্তর্জালের খুল্লামখুল্লা ২৪×৭ স্ক্রুটিনির কালেও, একটা শটে ভুল শতবার টুইট হয়ে বিশ্বজুড়ে কয়েক মুহূর্তে পল্লবিত হওয়ার সময়েও, সহজলভ্য স্ট্যাটিসটিক্সের হাত ধরে নিষ্ঠুর সমালোচনা আর ট্রোলিংয়ের দুনিয়াতেও, হাইরেস ক্যামেরা আর প্রযুক্তির জোয়ারে ছায়ামায়াময় রহস্যকে বলি দিয়ে ফেলা দুর্দিনেও টেনিসের শরীরে যে লেগে আছে সোনালি যুগের চাকচিক্য, তার পেছনে আধিদৈবিক মায়াময় শিল্পী ফেডেরারের অবদানই সর্বাধিক। তিনি এই পুনর্জাগরণে যুগপৎ ভিঞ্চির অনিবার্য সাফল্য আর মাইকেলেঞ্জেলোর বিশ্লেষণাতীত সৌন্দর্য। রজার ফেডেরার এমনি এমনিই ওই মহাসিংহাসনের একক অধিকারী নন।

একটানা দশটি মেজর ফাইনালে খেলার বিরল নজির করায়ত্ব করা ফেডেরারের চাইতে নিখুঁত মডেল পেশাদার কম পাওয়া যায়। পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি, বিতর্কের থেকে সহস্রযোজন দূরত্ব, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে অপরিসীম বিনয় আর ভদ্র সমাহিত শরীরী ভাষা তাঁকে করে তুলেছে একমেবাদ্বিতীয়ম অনুপ্রেরণা। কুন্দশুভ্র তাঁর পোশাকের মতই মিস্টার টেনিসের পাবলিক প্রোফাইলে এতটুকু কালো দাগ নেই। শতাব্দীর একপাদ জুড়ে খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করেও যাঁর মাথা ঘুরে যায়না, তাঁর অবিশ্বাস্য বিনম্রতা সত্যিই তুলনারহিত। তাঁর এই ইমেজে আরও যুক্ত হয়েছে তাঁর সমাজকর্মী সত্ত্বার নানান উপকারী কার্যক্রম। প্রান্তিক ও দরিদ্র শিশুদের জন্যে তাঁর "রজার ফেডেরার ফাউন্ডেশন" আজ দুই দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছে। বন্যা বা ভূমিকম্পের পরে ত্রাণ তোলার জন্য বহুবার তিনি র‍্যাকেট হাতে নেমে পড়েছেন কোর্টে।

ফেডেরার একটা আস্ত প্রজন্ম। অনেকের শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য-যৌবন জুড়ে ছড়ি ঘুরিয়ে পৃথিবীকে অবাক করে দিয়ে গেছেন এই মহাতারকা। এই সহস্রাব্দে যখন বিশ্বায়নের খোয়াব চুরচুর হয়ে চারিপাশে নেমে আসছে সর্বগ্রাসী অবক্ষয়, তখনও কোথাও গিয়ে যেন রজার ফেডেরার – দ্য ক্ল্যাসিক্যাল। চিরকালীন মূল্যবোধগুলো পরম যত্নে লালন করে, তিনি যেন খেলার শাশ্বত আত্মা। অবসর ঘোষণার চিঠির শেষ লাইনে ফেডেরার লিখেছেন - "সবশেষে, টেনিসকে জানাই: আমি তোমায় ভালোবাসি আর কোনওদিন তোমাকে ছেড়ে যাব না" (ফাইনালি, টু দ্য গেম অফ টেনিস: আই লাভ ইউ অ্যান্ড উইল নেভার লিভ ইউ")। টেনিস আর তিনি অবিচ্ছেদ্য। অবসর তাঁর যাত্রার অবশ্যম্ভাবী একটা টার্মিনাস, কিন্তু অমৃত অভিলাষী মিস্টার টেনিস, দেবত্বে উত্তীর্ণ হয়ে, অমর।

More Articles