রাজা রজার || ২৪ বছর ধরে রচিত এক মহাকাব্য
Roger Federer: ২০০৬ সালে ফেডেরার তিনটে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছিলেন এবং চতুর্থ গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার খুব কাছে চলে এসেছিলেন। কিন্তু ফ্রেঞ্চ ওপেনে রাফায়েল নাদালের কাছে হেরে যান রজার।
দীর্ঘ ২৪ বছর একটানা চলার পর এবার থামতে চলেছে টেনিস কোর্টের রোলস রয়েস। গতকাল সমস্ত রকম পেশাদার টেনিস থেকে অবসরের কথা ঘোষণা করলেন ২০ বারের গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়ন রজার ফেডেরার। এ বছর লন্ডনের লেভার কাপই কেরিয়ারের শেষ টুর্নামেন্ট রজার ফেডেরারের জন্য। ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হতে চলা লেভার কাপ হবে তাঁর শেষ টুর্নামেন্ট। বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় রজার নিজেকে এমন এক উচ্চতায় তুলে দিয়েছেন যেখানে খুব কম মানুষই পৌঁছতে পারেন।
গতকাল সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের মাধ্যমে এই সুইস কিংবদন্তি জানিয়েছেন, তাঁর শরীর এখন আর আগের মতো সঙ্গ দিচ্ছে না। সাম্প্রতিক অতীতে হাঁটুর চোট তাঁকে ভুগিয়েছে। ফলত খেলা চালিয়ে যাওয়ার মতো ফিট তিনি আর নন। তিনি লেখেন, “আপনারা অনেকেই জানেন, গত তিন বছর আমাকে বহুবার আঘাত এবং অস্ত্রোপচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমি পেশাদার প্রতিযোগিতামূলক ফর্মে ফিরে আসার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছিলাম কিন্তু আমার শরীরের ক্ষমতা এবং সীমা আমি জানি। গত ২৪ বছরে ১৫০০ টিরও বেশি ম্যাচ খেলেছি আমি। টেনিস আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। সবাইকেই থামতে জানতে হয়। আমাকেও তাই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। লন্ডনে পরের সপ্তাহে লেভার কাপ হবে আমার শেষ এটিপি ইভেন্ট। আমি অবশ্যই ভবিষ্যতে আরও টেনিস খেলব, তবে গ্র্যান্ড স্ল্যাম বা টুর্নামেন্টে নয়।”
২৪ টা বছর ২৪ ঘণ্টার মতো লাগছে রজার ফেডেরারের। মনে হচ্ছে, এই তো র্যাকেট নিয়ে প্রথম বার কোর্টে খেলতে নামছেন তিনি। এমনই জানিয়েছেন রজার ফেডেরার। একইসঙ্গে ফেডেরার ধন্যবাদ জানিয়েছেন স্ত্রী মিরকা, সন্তানদের, নিজের দলকে, নিজের প্রতিপক্ষদের এবং সর্বোপরি নিজের অগণিত ভক্তদের।
বিগত বছরগুলোতে রজার ফেডেরার বারবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন কামব্যাক করার। কিন্তু চোটের কাছে হার মানতে হল কোর্টের ‘রাজা’ রজারকে। যদি চোট আঘাতে না ভুগতেন তাহলে হয়তো গ্র্যান্ড স্ল্যাম সংখ্যায় শিখরে থাকতেন রজারই। কিন্তু তাতে কী? গ্র্যান্ড স্ল্যাম সংখ্যা যাই বলুক, ফেডেরার সর্বকালের অন্যতম সেরা, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং সংবাদপত্রে রজার ফেডেরারকে কিংবদন্তি বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। এই কিংবদন্তি তকমা রজার ফেডেরার একদিনে অর্জন করেননি। একের পর এক সাফল্য তাঁকে করে তুলেছে লেজেন্ড বা কিংবদন্তি।
আরও পড়ুন- নাদালের যাত্রাপথ এখন টেনিস ছাড়িয়ে জীবনযুদ্ধের অনুপ্রেরণা
১৯-২০ বছর বয়সী একটি সাধারণ ছেলে বা মেয়ে যখন নিজের পড়াশোনা এবং অন্যান্য যাবতীয় কেরিয়ার নিয়ে মানসিক দোলাচলে থাকে, সেই বয়সেই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ টেনিস খেলোয়াড়কে হারিয়েছিলেন রজার ফেডেরার। ফেডেরারের উত্থান শুরু হয়েছিল ২০০১ সালের উইম্বলডনে। পুরুষদের টেনিসে তখন এক নম্বর খেলোয়াড় পিট সাম্প্রাস। টানা চার বার উইম্বলডন জিতে ফেলেছেন তিনি। সেই দুরন্ত ছন্দে থাকা সাম্প্রাসকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠেন ১৯ বছরের রজার ফেডেরার। পাঁচ সেটের সেই ম্যাচই গোটা বিশ্বকে জানান দিয়েছিল ‘রাজা’ চলে এসেছে নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে।
১৯৮১ সালের ৮ অগাস্ট সুইজারল্যান্ডের এক স্বচ্ছল পরিবারে জন্ম হয় এই ডানহাতি টেনিস তারকার। রজার ফেডেরার ছোটো থেকেই লন টেনিস খেলতে ভালোবাসতেন। মা বাবা দু’জনেই ছিলেন টেনিস প্রেমিক। তাই টেনিস খেলায় বরাবরই পরিবারের উৎসাহ পেয়েছেন রজার। ৫ বছর বয়সে প্রথম টেনিস শিখতে ভর্তি হন রজার। ৭ বছর বয়সে জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে লাইমলাইটে আসেন ফেডেরার। তখনই অনেকে মন্তব্য করেছিলেন এই ছেলে একদিন বিশ্ব শাসন করবে। ঘটনাচক্রে হলও তাই। ১৮ বছর বয়সে সমস্ত সুইস পুরুষ নাগরিকের মতো রজারকেও সুইস সশস্ত্র বাহিনীতে বাধ্যতামূলক সামরিক পরিষেবার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁকে ‘মেডিকেলি আনফিট’ ঘোষণা করে সশস্ত্র বাহিনী থেকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হয়। পরের বছরই তিনি পিট সাম্প্রাসকে হারান।
যদিও ফেডেরারের প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম জয় ২০০৩ উইম্বলডনে। সেমিফাইনালে হারান অ্যান্ডি রডিকের মতো তারকাকে। ২০ টি গ্র্যান্ড স্লাম, ৩১০ সপ্তাহ এটিপি ক্রমতালিকায় শীর্ষস্থান, এর মধ্যে টানা ২৩৭ সপ্তাহ এক নম্বরে থাকা, পাঁচ বার বছর শেষে শীর্ষে থাকা। ২০০৪ সালে ফেডেরার তাঁর কেরিয়ারে প্রথমবার তিনটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছিলেন। ১৯৮৮ সালে ম্যাট উইল্যান্ডারের পর তিনিই প্রথম যিনি এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন। তাঁর প্রথম হার্ড-কোর্ট খেতাব আসে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে মারাট সাফিনকে হারিয়ে। এর ফলে প্রথমবার তিনি বিশ্বের এক নম্বর হয়ে ওঠেন। ফেডেরার তিনটি এটিপি মাস্টার্স ইভেন্টে জয়লাভ করেছিলেন। যদিও ২০০৫ সালে প্রথম দু’টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম টুর্নামেন্টের ফাইনালে পৌঁছাতে ব্যর্থ হন তিনি। তবে রাজার মতো ফিরে আসেন ২০০৬ সালে। এই বছরই ফেডেরার ১২টি টুর্নামেন্ট জেতেন এবং ১৭টি টুর্নামেন্টের ১৬টিতেই তিনি ফাইনালে উঠেছিলেন। ২০০৬ সালে ফেডেরার তিনটে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছিলেন এবং চতুর্থ গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার খুব কাছে চলে এসেছিলেন। কিন্তু ফ্রেঞ্চ ওপেনে রাফায়েল নাদালের কাছে হেরে যান রজার ফেডেরার।
আরও পড়ুন- সাদাদের টিটকিরি আর নয়, কৃষ্ণাঙ্গ সেরেনা একাই পালটে দিয়েছেন টেনিস-দুনিয়ার ছবিটা
ফেডেরার টেনিস-জীবনে ৬ বার অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, ১ বার ফ্রেঞ্চ ওপেন, ৮ বার উইম্বলডন এবং ৫ বার ইউএস ওপেন জিতেছেন। এছাড়া ২০১৪ সালে সুইৎজারল্যান্ডের হয়ে ডেভিস কাপ জেতেন। হপম্যান কাপ জিতেছেন ৩ বার। মোট ৬ বার এটিপি ট্যুর চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তিনি। ২০০৪-১২ পর্যন্ত তিনবার অলিম্পিক্সে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন রজার ফেডেরার। ২০০৮ সালে বেজিং অলিম্পিক্সে ডাবলসে সোনা এবং ২০১২ লন্ডন অলিম্পিক্সে সিঙ্গলসে রুপো পান তিনি। ২০২০-২০২১ সালে গুরুতর চোটের কারণে রজার অনেকগুলো বড় টুর্নামেন্ট খেলতে পারেননি। এই চোটের কারণেই তাঁকে ২০২১-এর টোকিও অলিম্পিক থেকেও সরে দাঁড়াতে হয়।
টেনিসের সঙ্গে রজার ফেডেরারের সম্পর্ক কোনওদিনই শেষ হওয়ার নয়। ফেডেরারের পর পুরুষ পেশাদার টেনিস সার্কিটে ত্রিদেবের মধ্যে রইলেন দুজন- নোভাক জকোভিচ এবং রাফায়েল নাদাল। বিগত ২০-২২ বছর ধরে এই তিনজনই তো শাসন করে এসেছেন টেনিস বিশ্ব। এবার হয়তো নতুনদের উঠে আসার পালা। এই যেমন ইউএসএ ওপেনে কার্লোস আলকারাজের মতো নতুন তারকার উদয় হল। সময়ই বলবে এরা কেউ ফেডেরার, সেরেনার মতো সফল হতে পারবেন কী না তবে শুরু তো এভাবেই হয়। ঠিক যেমনভাবে বিশ্বের তৎকালীন এক নম্বর টেনিস খেলোয়াড়কে হারিয়ে নিজের কিংবদন্তি হওয়ার গল্প শুরু করেছিলেন রজার ফেডেরার।