এলজিবিটিকিউ আন্দোলনকে 'চরমপন্থী' ঘোষণা কেন রাশিয়ার সর্বোচ্চ আদালতের?

Homosexuality in Russia: রাশিয়ার ঐতিহ্যের জয়গানকেই শক্তিশালী করল সর্বোচ্চ আদালতের রায়। 'চরমপন্থী' খেতাবে নিষিদ্ধ হল যাবতীয় লিঙ্গসাম্যের আন্দোলন।

দ্বিতীয় বিশ্ব খেতাব হারানোর পথে আরেকটু এগোল রাশিয়া। সম্প্রতি রাশিয়ার সর্বোচ্চ আদালত এলজিবিটি আন্দোলনকে 'চরমপন্থী' রায় দিয়ে নিষিদ্ধ করেছে। নতুন আইনে, এলজিবিটি মতের প্রচারক যে কোনও ব্যক্তির জরিমানা ধার্য হয়েছে ৪০০০ থেকে ৫০০০ রুবল। ভারতীয় অর্থের নিরিখে যা প্রায় ৩৭০০ থেকে ৪৬০০ টাকার সমান। আর প্রচার যদি কোনও এনজিও, সংস্থা বা আইনি সংগঠনের পক্ষ থেকে করা হয়, সেক্ষেত্রে জরিমানা আকাশছোঁয়া। আট লক্ষ রুবল থেকে দশ লক্ষ রুবলেও ঠেকতে পারে তা। যার পরিমাণ ভারতীয় অর্থের নিরিখে প্রায় নয় লক্ষ সতেরো হাজার টাকা। আন্তর্জাল বা কোনও সংবাদমাধ্যমে প্রচার চালানো হলে জরিমানার অঙ্ক আরও ভয়ঙ্কর। বিশেষত প্রচারক যদি হন বিদেশী নাগরিক। সেক্ষেত্রে শুধু জরিমানা নয়, হতে পারে পনেরো দিনের জেল, এমনকি ফেরত পাঠানো হতে পারে ওই বিদেশি ব্যক্তিকে তাঁর নিজের দেশে। হারাতে হতে পারে রাশিয়ায় থাকার আইনি অধিকারটিও। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে, যখন গোটা বিশ্ব লিঙ্গপরিবর্তন মেনে নিচ্ছে, মেনে নিচ্ছে নানা অভিমুখের যৌনতার দাবিও, সে সময়, এমন একটি রায়ে স্তম্ভিত সমস্ত প্রায় সকলেই।

ইতিহাস ও ঐতিহ্য

লিঙ্গসাম্যের যে দাবি বিশ শতকের অন্যতম সম্পদ, দীর্ঘ দমন-পীড়নের অন্ধকার কাটিয়ে যে দাবিতে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছিলেন নানা যৌন অভিমুখের মানুষ, সেই দাবিকে ফের অস্বীকার করে আরও এক কদম অন্ধকারের বুকে এগিয়ে গেল রাশিয়া। যদিও ইতিহাস বলছে, এই অস্বীকারের ঝোঁক নতুন নয়। রাশিয়ার কম্যুনিস্ট নেতৃত্বও, বারেবারে, সেই স্ট্যালিনের আমল থেকে যৌনতার নানা অভিমুখকে 'অস্বাভাবিক' বলে দাগিয়ে এসেছে। তারপর প্রতিবিপ্লব এল। মানুষকে বলা হল, বিপ্লবকে মুছে ফেলতে পারলেই পাওয়া যাবে যাবতীয় সমস্যার সমাধান। ১৯৯৩-এ এসে উঠে গেল সেই অন্ধকার আইন। বলা হল, নানা যৌনতার চর্চা আর অপরাধ নয়। যদিও বাস্তবে তাকে মানসিক অসুখ হিসেবে দাগানো চলল আরও বছর ছয়েক।

আরও পড়ুন: সমকামিতা, উভকামিতার ইঙ্গিত ছিল গানেই, দেশের প্রথম ‘ক্যুইয়ার’ আইকন ছিলেন ফাল্গুনী পাঠক

তারপরে নতুন শতক। প্রযুক্তির শতক। দিকে দিকে মানুষের একান্ত গোপন খবরটিও জায়গা করে নিচ্ছে সামাজিক মাধ্যমের ক্ষেত্রটিতে। লিঙ্গ-বর্ণ-শ্রেনিসাম্যের আন্দোলন গড়ে নিচ্ছে নিজস্ব রাজপথ। সেই সময়, ২০১৩ সালে, ‘আধুনিক' রাশিয়ার মনে হল বড় বেশিদিন এইসব 'অস্বাভাবিক' মানুষজনদের স্বাধীনতা দেওয়া হয়ে গিয়েছে। অতএব, ফের বন্দী কর। বেআইনি হল সমকামিতা, বেআইনি হল লিঙ্গপরিবর্তন। বলা হল শিশুদের কাছে যারা 'ঐতিহ্যবিরোধী' যৌনতার 'প্রচার করে, তারা নরকের কীট। অপরাধী। ২০২২-এ সেই অপরাধের গণ্ডী আরও বাড়ানো হয়েছে। প্রকাশ্যে হোক, বই বা বিজ্ঞাপনে হোক, হোক না সিনেমার পর্দায় বা নেটের পাতায়, সরকার যদি সিদ্ধান্তে আসে তা সমকামিতার সমর্থন অথবা 'প্রচার' তবে শাস্তি হবেই হবে।

Russia tagges LGBT movements as ‘extremist’ ban posed by Supreme Court

রায় নিয়ে সংশয়

২০২৩-এ তার ষোলোকলা পূর্ণ। রাশিয়ার সর্বোচ্চ আদালত ৩০ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার, রায় দিয়েছে এলজিবিটি আন্দোলনের যে কোনও সক্রীয় কর্মীকে 'চরমপন্থী' বলে গণ্য করা হবে। বিচারক এই আন্দোলনকে 'আন্তর্জাতিক ও সামাজিক এলজিবিটি আন্দোলন' বলতেই আগ্রহী। যদিও, পুতিনের মুখপাত্র, দিমিত্রি পেসকভ সরাসরি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে এই মামলা নিয়ে সরকার আদৌ চিন্তিত নয়। তাঁরা মামলাটিতে কী হচ্ছে না হচ্ছে তার খবর পর্যন্ত রাখেননি। এবং রায়ের ব্যাপারে কোনও রকম মন্তব্য করতে আগ্রহী নন। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। পুতিনের ঐতিহ্যের রাজনীতি এখন অনেকখানিই পরিস্কার সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে। এর আগেও নানা ভাষণে পুতিন ঐতিহ্যের প্রসঙ্গ এনেছে। এমনকি ইউক্রেন আক্রমণের যুক্তি হিসেবেও তাঁর বক্তব্যে ঘুরেফিরে এসেছিল ঐতিহ্যের কথা। বিশেষত আসন্ন নির্বাচনই এই রায়ের সঙ্গে সরকারের যোগসাজসের সন্দেহ আরও দড় করছে। আগামী মার্চে ফের ছ বছরের জন্য ক্ষমতায় আসতে চাইবেন পুতিন। সেই কথা মাথায় রেখেই কি এই পদক্ষেপ? রায়ে সরকারের ভূমিকা নিয়ে সংশয় থাকছেই।

Russia tagges LGBT movements as ‘extremist’ ban posed by Supreme Court

পুতিনের দীর্ঘ শাসনকালে রাশিয়ার ভাবমূর্তিকে খুব সচেতনভাবেই গড়ে তোলা হয়েছে ঐতিহ্যের রক্ষাকর্তা হিসেবে। এবং পশ্চিমকে উপস্থাপিত করা হয়েছে বিকৃত, ভেঙে পড়া সংস্কৃতির চর্চকারী হিসেবে। এমনকি ২০২২-এও পুতিন তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, পশ্চিমের দেশগুলি গড্ডালিকা প্রবাহে এইসব উৎকট নীতিনিয়ম মানতেই পারে, গণ্ডা খানেক লিঙ্গ বা গে-প্যারেড তাদের মানায়। কিন্তু কোন অধিকারে তারা বিশ্বের সব দেশকে এ ধরনের ফালতু নিয়মরীতি মানতে বাধ্য করতে চায়? এই চর্চা রাশিয়ার এতখানি গভীরে শিকর গেঁথেছে যা রীতিমতো ভয় ধরায়। বছর বিশের এক যুবক সরাসরিই সমকামিতাকে 'অস্বাভাবিক' বলে চিহ্নিত করেন সেখানে। সাংবাদিককে এও জানান, তাঁর পরিচিত সিংহভাগ মানুষ তাঁর মতেই বিশ্বাসী। সমকামিতা সম্বন্ধে তাঁরা একই ধারণা পোষণ করেন। ফলে, সরকার একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আদালতের রায় প্রশংসনীয়।

সংশয়েই আশা?

এমন একটা দমবন্ধ পরিবেশে কেমন আছেন নানা যৌনতা অভিমুখী মানুষেরা? পরিস্থিতি ঠিক কোনদিকে এগোচ্ছে? পুতিন আবার ফিরে এলে তাদের অবস্থাই বা কী দাঁড়াবে--এই চিন্তায় গোটা বিশ্ব। সমকামী ও রূপান্তরকামীদের অধিকার আকস্মিক নয়। শিকড় ছেঁড়া আস্ফালন তো নয়ই। নয় পড়ে পাওয়া বা পুতিন উল্লিখিত গড্ডালিকা প্রবাহও। এর নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে। রয়েছে দীর্ঘ লড়াই ও রক্তের ইতিহাস। প্রান্তিকতার এই আন্দোলনের উপযুক্ত জমি তৈরি করতে পর্যন্ত খরচ হয়েছে অনেকগুলো শতাব্দী, মানুষের হাহাকার, যন্ত্রণা, পাগলাগারদের বীভৎস অত্যাচার, আর্তনাদ। 'সুস্থতা'র দোহাই দিয়ে কী পরিমাণ অসুস্থ অমানবিক কাজ মানুষ করতে পারে, লিঙ্গবৈষম্যের ক্ষেত্রটি বারবার তার নজির হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই পুতিনের মূলস্রোত ও ঐতিহ্যবাদী হুঁশিয়ারীকে স্বৈরতন্ত্রের অন্যতম পদক্ষেপ হিসেবেই দেখছেন অত্যাচারিতরা।

আরও পড়ুন: সমকামিতা এখনও কেন স্বাভাবিক হয়ে উঠল না সমাজের চোখে?

রয়টার্সের তরফ থেকে একটি সমীক্ষা করা হয়। রাশিয়ার রাজধানি মসকৌর রাস্তায় জনে জনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় পথচারীদের। দেখা যায়, ঐ তরুণ যুবকের মত যেমন রয়েছে, রয়েছে তার উলটো মতটিও। মসকৌতে এই রায় নিয়ে মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত। এবং সেইটিই আশার কথা। কারণ এই মুহূর্তে 'চরমপন্থী' অভিযোগে নিষিদ্ধ রাশিয়ার প্রায় শতাধিক সংগঠন। কেবলমাত্র আলেক্সেই নাভালনির সমর্থক হওয়ার কারণেও বহু মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এমন স্বৈরাচারী শাসকের দেশে, যখন রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লিরা নামে এক তরুণী বলে ওঠেন, তিনি এমন এক দেশের স্বপ্ন দেখেন যেখানে মানুষ কেবল মানুষকে এই মানুষ পরিচয়টুকুর জন্যেই ভালোবাসতে পারবে, কোনও বিধি-নিষেধের বাধা যেখানে থাকবে না, তখনও ভরসা পায় পৃথিবী। পৃথিবীর সেই সব মানুষেরা আবারও বাঁচতে চায়, যাদের বেঁচে থাকাটাই নিষিদ্ধ করার চক্রান্ত হয়েছিল। লিরা যখন বলেন, ভালোবাসার অধিকার হারানো বড় যন্ত্রণার, তখন ঐতিহ্যের ধামধারী স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে নীরব, নিস্তব্ধ কোথাও দানা বাঁধে মানবিক ক্ষোভ। পরতে পরতে জমা হয়ে যে ক্ষোভ নিস্তব্ধ থাকে না বেশিদিন। যাকে জন্মলগ্ন থেকে ভয় পেয়ে আসে অত্যাচারীর কেদারাটি। দিনের পর দিন অস্তিত্বের অপমানে চুপ হয়ে যান যেখানে মানুষ, যেখানে মানুষ কেবলমাত্র ভালোবাসার কারণে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন, হাসি, মজা, উপেক্ষা আর প্রশাসনের অত্যাচারে প্রতিদিন রক্তাক্ত হয় যেখানে প্রজন্ম, আমরা কি সেই রকম ভবিষ্যতের সাধনা করে আসছি? রাশিয়ার এই রায় এবং মানুষের দ্বিধা মানুষকে আবার এই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করাচ্ছে

More Articles