রাশিয়ায় কোপ, অন্যত্র চোখে ঠুলি! ফিফার দ্বিচারিতার কারণ কী!

সব খেলার সেরা বাঙালীর তুমি ফুটবল। বিখ্যাত সেই লাইন। তবে শুধু বাঙালির না, গোটা পৃথিবীর ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। ফুটবল শুধুমাত্র একটি খেলা নয়, ফুটবল আবেগের, ভালোবাসার, প্রাণের জায়গা, ফুটবল নিজেকে প্রকাশ করার মাধ্যম, ফুটবল বিশ্ব রাজনীতির ও এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, এত বছর তা অস্বীকার করার পর যা হঠাৎ করে ফিফা এবং উয়েফাও মেনে নিয়েছে।

বিশ্ব ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা ফিফা এবং ইউরোপিয়ান ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা উয়েফা রাশিয়ার জাতীয় দল এবং সমস্ত ক্লাব দলকে সমস্ত রকম প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দিয়েছে। এর ফলে রাশিয়া আর ২০২২ বিশ্বকাপে খেলতে পারবে না, রাশিয়ার সব ক্লাব চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং ইউরোপা লিগ খেলতে পারবে না। বাকি সমস্ত খেলাতেও রাশিয়া এক রকম নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হচ্ছে, তবে এখন আলোচনা করব শুধু উয়েফা এবং ফিফা নিয়ে। কারণ অতীতে খেলায় রাজনীতির প্রবেশ নিয়ে জোর চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে এই দুই সংস্থা। তাদের অবস্থান হঠাৎ এতটা ঘুরে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই অনেকেরই ভ্রু কুঁচকেছে।

তার আগে এটা স্পষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন যে, রাশিয়ার অবস্থানকে লঘু করে দেওয়ার কোনও উদ্দেশ্য নেই, এবং এই বিষয়ে মনে হয়না কারোরই অন্য কোনো মত থাকবে যে রাশিয়ার কঠিন শাস্তি প্রাপ্য। সেই সাথে এই কথাও বলা প্রয়োজন যে খেলা কখনোই রাজনীতির বাইরে হতে পারে না, কারণ খেলোয়াড়রা উঠে আসেন আমাদের সমাজ থেকেই, এবং প্রতিনিধিত্ব করেন তাঁর সমাজের। সেই সমাজ তাকিয়ে থাকে তার প্রিয় ফুটবলারের দিকে, মন দিয়ে শোনে তার বক্তব্য এবং প্রভাবিত হয়।

লেখার আসল বক্তব্যে ঢোকার আগে ফুটবলের "সফট পাওয়ার" নিয়ে একটা অসাধারণ উদাহরণ দি। ঘটনাটা ২০০৫ সালের। বিখ্যাত ফুটবলার দিদিয়ের দ্রোগবার দেশ আইভরি কোস্টে তখন তুমুল অশান্তি, গৃহযুদ্ধ। তিনি দেশকে বিশ্বকাপে তোলেন এবং হাতজোড় করে দেশের নেতাদের কাছে শান্তির বার্তা দেন। পাঁচ বছরের জন্যে দেশে গৃহযুদ্ধ থেমে যায় এবং তার পুরো কৃতিত্ব ফুটবল ও এক ফুটবলারের।

আসি ফিফা এবং উয়েফার পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনায়। ফিফা এবং উয়েফা শুধু রুশ দলদের বাদ দেয়নি, সেই সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে রুশ তেল উত্তোলন সংস্থা গ্যাসপ্রমের সাথেও। চেলসি ক্লাবের মালিক রোমান অ্যাব্রাহিমোভিচ একপ্রকার বাধ্য হলেন তাঁর ক্লাব বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হতে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তাদের স্পন্সর রুশ বিমানসংস্থা এরোফ্লটের বিমানে উঠতে অস্বীকার করেছে। চ্যাম্পিয়ন লিগ ফাইনাল রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে সরে গেছে প্যারিসে। ফিফা এবং উয়েফা এইভাবে বার্তা দিচ্ছে, তাঁরা কোনও ভাবেই মানবতার বিরুদ্ধে এমন অন্যায় মেনে নেবেনা।

কিন্তু এই বিবেক আগে কোথায় ছিল ফিফার? এই একুশ শতকে, বা শুধু মাত্র যদি গত শতকের কথাই ধরা যায় তাহলে দেখা যাবে, শুধু ইউক্রেন নয়, আরো অনেক দেশ অন্য দেশের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, আরো অনেক জায়গায় চূড়ান্ত ভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে মানবাধিকার। কাতারে কাতারে মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, মিসাইল, বোমার আঘাতে। লক্ষ লক্ষ মানুষ হয়েছেন উদ্বাস্তু। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই এই দুই নিয়ামক সংস্থা কোনো বিবৃতি পর্যন্ত দেয়নি। পদক্ষেপ তো অনেক দূরের প্রশ্ন।  সে সৌদী আরবের ইয়েমেনের মাটিতে বোমা বর্ষণ করা হোক বা আমেরিকার সোমালিয়ার মাটিতে ড্রোন হামলা হোক, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের সময়েই ঘটা এই ঘটনা গুলি চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে গোটা বিশ্বের, ফিফাও এগুলি নিজের চোখে দেখতে অপারগ।

আমেরিকা এবং ব্রিটেন যখন ইরাকে সেনা অভিযান করে, বা সিরিয়ায় ক্রমাগত বোমা বর্ষণ চলে, তখন কোনোভাবেই এই বিষয়ে কথা বলে বিতর্কে জড়াতে চায়নি ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা। ইজরায়েল যখন প্যালেস্তাইনে আক্রমণ চালাচ্ছিল, নিরীহ মানুষের ওপর হামলা করছিল, তখন উয়েফা বা ফিফা কারোর থেকেই মানবতাকে রক্ষা করার কোনো বার্তা পাওয়া যায়নি, বরং যে ফুটবলাররা প্যালেস্তাইনের সমর্থনে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের সতর্ক করা হয়। আফগানিস্তানকেও কী করে ভুলে যাই?

এই বছরের শেষে কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। কিন্তু কাতার সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে যারা কাজ করতে গেছিলেন তাদের মানব অধিকার চূড়ান্ত ভাবে লঙ্ঘিত হয়, রিপোর্ট আসে, প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কর্মীর মৃত্যু হয়েছে ওখানে কাজ করতে গিয়ে, তাদের সুরক্ষার বিন্দুমাত্র ব্যবস্থা করা হয়নি। নরওয়ের ফুটবলাররা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন, এমনকী তারা ২০২২ বিশ্বকাপ বয়কট করার কথাও বলেন। "Human Rights- on and off the pitch" লেখা টিশার্ট পরে প্র্যাক্টিসে নামেন তাঁরা, এর ফলস্বরূপ নরওয়েকে ২০২৬ বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কার করার হুমকি দেন।

গত বছর হওয়া ২০২০ ইউরোতে জার্মানি বনাম হাঙ্গেরির ম্যাচ হয় আলিয়ানজ এরিনাতে। ওই দিন জার্মান ফেডারেশন চেয়েছিল স্টেডিয়ামকে রঙিন আলোয় সাজাতে, এলজিবিটি সম্প্রদায়ের সমর্থনে। কিন্তু হাঙ্গারীর আইনসভায় সমকামিতার বিরুদ্ধে আইন পাশ হওয়ার কারণে উয়েফা স্টেডিয়ামকে সাজাতে দেয়নি। সবক্ষেত্রেই কারণ দেখানো হয়, ফুটবল নিয়ামক সংস্থারা রাজনীতি থেকে দূরে থাকবে।

প্রশ্ন উঠছে, সৌদী রাজপরিবারকে তাহলে কোন জায়গা থেকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে দল কিনতে দেওয়া হল? যেখানে তাদের বিরুদ্ধে অনেক অপরাধ করার অভিযোগ, তারমধ্যে অন্যতম হল সাংবাদিক জামাল খাশোগীকে অন্য দেশের মাটিতে হত্যার অভিযোগ!

রাশিয়ার বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপ নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই। সমস্ত খেলা নির্বিশেষে রাশিয়াকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, এমনকি কোনো এক প্রতিযোগিতায় রুশ বিড়ালদেরও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। খেলা, বিশেষ করে ফুটবলের মত এত খেলা যার প্রভাব খেলার মাঠ ছাড়িয়ে আমাদের সমাজে, আমাদের সংস্কৃতিতে, আমাদের অর্থনীতিতে, আমাদের রাজনীতিতে প্রভাব রয়েছে, সব ধরণের বিভেদ বিভাজন ভেদ করার ক্ষমতা রাখে এই খেলা। আইভরি কোস্টের উদাহরণ আছে আমাদের সামনে। যে কারণে রুশ টেনিস তারকা আন্দ্রে রূবলেভ যখন ক্যামেরায় লেখেন no war, please,  তখন তা ভাইরাল হয়ে যায়, রুশ জনতার সমবেত আর্তি হিসেবে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরে।

বিশ্বের সব শক্তিশালী দেশ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে রাশিয়ার ওপর, ক্রীড়া ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞাও হয়েতো কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে রাশিয়ার ওপর। কিন্তু যখন এক রুশ অ্যাথলিট বলেন তাঁরা যুদ্ধ চাননি, এই যুদ্ধ তাদের নয় এবং তাদের ওপর এভাবে নিষেধাজ্ঞা চাপানো ঠিক নয় তখন তার কথাও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে যদি রাশিয়ার ওপর ক্রীড়া ক্ষেত্রে এইভাবে নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয় তাহলে এটা উদাহরণ হোক ভবিষ্যতের পৃথিবীর জন্যে।  ফুটবলের মাঠের মতো বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চেও যেন নিয়ম সবার জন্যে এক হয়।

More Articles