বোমা গুলির শব্দে ঘুম ভাঙছে শিশুর, কেন ইউক্রেনকেই শত্রু বাছলেন পুতিন

রাশিয়া। বিশ্বের বৃহত্তম দেশ। রাশিয়ার চতুর্দিকে বিস্তৃত স্টেপ তুন্দ্রা এবং উষ্ণ মরুভূমি। ৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দ। রাশিয়ার বুকে শুরু হল খ্রিষ্টানদের আধিপত্য। এতদিন যে সভ্যতা চালিত হচ্ছিল পূর্ব স্ল্যাভদের হাত ধরে ভারানজিয়ানরা প্রভাব বিস্তার করায় তা রূপান্তরিত হয়ে গেল "নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান" - এ। যারা এতদিন গর্ব করতো নিজেরা "বিশ্বের বৃহত্তম দেশ" বলে, তারাই হয়ে গেল টুকরো টুকরো। বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের মূলমন্ত্র অনুধাবনে অপারগ ছিল তারা। নিজেদের সংহতি বিসর্জন দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বিভিন্ন বৈদেশিক শক্তির আক্রমণে পর্যদুস্ত হয়ে যায় রাশিয়া। সমগ্র রাশিয়া জুড়ে তখন বিরাজ করছে অন্ধকার যুগ, অরাজকতা আর রাশিয়া যেন হয়ে উঠেছে সমার্থক। পরবর্তী সময়ে গ্র্যান্ড ডিউক অনেকাংশে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সাধনে সমর্থ হন।

সাল ১৯১৭। রাশিয়ার ইতিহাসে যাকে বলে একপ্রকার ' রেড লেটার ডে।' হ্যাঁ রাশিয়ার জনগনের শিরায় ধমনীতে তখন প্রবাহিত হচ্ছে বিপ্লবী রক্ত, স্টেপ তৃণভূমি ভিজছে রক্তে, তুন্দ্রার বরফ গলছে উত্তপ্ত বুলেটের বহ্নিশিখায়। বিপ্লবের বারুদে অগ্নিদগ্ধ হয়ে সিংহাসন ছেড়েছেন দ্বিতীয় নিকোলাস, গঠিত হয়েছে বলশেভিক সরকার। এর পরবর্তী সময়ে অক্টোবর মাসে আবারও বিপ্লবের পদধ্বনি শোনা গেল রাশিয়ার মাটিতে। এবার গদি ছাড়তে বাধ্য হল পেট্রোগ্রাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অর্থাৎ একথা বলা চলে বিপ্লব আন্দোলন এবং অত্যাচারী শাসক কে প্রশ্ন করার সাহস, প্রতিস্পর্ধা রাশিয়ানদের আজকের নয়। কিন্তু এমন গৌরবময় বিপ্লবের ইতিহাসকে সঙ্গে করে চলা একটি দেশ হঠাৎই আগ্রাসন নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে উঠল কেন? নাকি পুতিনের ক্ষেত্রেও সত্যি হয়ে উঠলো " যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ" - এর মত প্রবাদ বাক্য? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আমাদের মাথায় রাখতে হবে ন্যাটো জোটের বিষয়টি একইসঙ্গে বুঝতে হবে ন্যাটো জোট নিয়ে কেন এত চিন্তিত রাশিয়া?

ন্যাটো জোট কী?

১৯৩৯ -১৯৪৫ সাল। মানব সমাজের ইতিহাসে পিছনে ফেলে আসা এই ছয় বছর ছিল একপ্রকার মারণযজ্ঞের কাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতায় আপামর পৃথিবীর জনগণ হয়ে উঠেছিল ভীত। অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, গৃহহীন হয়েছিলেন বহু। সেই সঙ্গেই ছিল অর্থনৈতিক অচলাবস্থার মত বিষয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ইউরোপের দশটি দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সমন্বয়ে ১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল গঠিত হলো নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন সংক্ষেপে যা পরিচিত ন্যাটো নামে। এই ন্যাটোর মূল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত আগ্রাসনের মোকাবিলা করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিজয়ী সোভিয়েত ইউনিয়ন পশ্চিম বার্লিনের বিরুদ্ধাচরণ শুরু করলে আমেরিকাসহ আরো এগারটি দেশ তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা ভেবে সামরিক জোট ন্যাটো গঠন করে।

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের কারণ

বর্তমান পরিস্থিতিতে রাশিয়া প্রধান পুতিন ন্যাটো জোটকে রাশিয়ার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি মনে করেছেন পশ্চিমা দেশগুলোর আক্রমণাত্মক মনোভাব রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করতে পারে। ইউক্রেন এখনও ন্যাটোর সদস্য না হলেও ভবিষ্যতে তারা ন্যাটোর সদস্যপদ গ্রহণ করতে পারে এই আশঙ্কায় রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণের অন্যতম কারণ বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞমহল।

সালটা ২০১৪। আরো একবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ইউক্রেন। ইউক্রেনের জনগণ কুশাসনের অভিযোগ তুলে পদচ্যুত করে তাদের প্রেসিডেন্টকে। আগুনে ঘি ঢাললো এই ঘটনা। এতদিন ধরে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের ক্ষেত্রে যে ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছিল তার আর দরকার হলো না। কারণ ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ছিলেন রুশপন্থী। ফলে সেই প্রেসিডেন্টের অপসারণ রাশিয়া ভালো চোখে দেখেনি। তবে এই ক্ষেত্রে ইউক্রেনকে কম মাশুল জোগাতে হয়েছিল এমন নয়। কারণ প্রেসিডেন্ট অপসারণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমগ্র ইউক্রেনে সৃষ্টি হয় গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি। মৃত্যু হয় কয়েক হাজার মানুষের। রুশপন্থী প্রেসিডেন্টের অপসারণ ছিল রাশিয়ার কাছে একটি বড় ধাক্কা। তবে রাশিয়া আজ এই প্রথমবার ইউক্রেন আক্রমণ করছে এমন নয়, এর পূর্বেও ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে কেন্দ্র করে সংঘাতে জড়িয়ে ছিল দুই পক্ষ।

নগর পুড়লে দেবালয় কি রক্ষা পায়? না, ভারতও পারেনি এই যুদ্ধের আগুন থেকে নিজেদের রক্ষা করতে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের আমেরিকা ঘনিষ্ঠতাকে ভালো চোখে দেখেনি পুতিন সরকার। আবার রাশিয়ার সঙ্গে এরইমধ্যে কয়েক কোটি টাকার সামরিক চুক্তি করে ফেলেছে মোদি সরকার। ফলে ভারতের অবস্থা এখন অনেকটা দুই নৌকায় পা দেওয়ার মতো। যুদ্ধ নিয়ে ভারতের অবস্থান জানতে আগ্রহী গোটা বিশ্ব। ভারত অবশ্য এখনো পর্যন্ত মধ্যপন্থায় অবলম্বন করেছে, তারা সরাসরি সমর্থন জানায়নি কোনো পক্ষকেই। এত কিছুর পরেও যুদ্ধের প্রভাবকে এড়াতে পারেনি ভারত, বেচাকেনা শুরু হতেই ধ্বস নেমেছে শেয়ারবাজারে। ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক বাজারে হিমালয় ছুঁয়েছে অপরিশোধিত তেলের দাম। প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম এখন ৯.৬৭ ডলার, যা সাধারণের ভাবনার বাইরে। এমনকী যুদ্ধের প্রভাব পড়তে পারে আম - আদমির রান্নাঘরেও। দামি হতে পারে রান্নার গ্যাস,কেরোসিন। দাম বাড়তে পারে পেট্রোল-ডিজেলের। ফলে নিম্নবিত্ত হোক অথবা মধ্যবিত্ত হাত যে সবার পুড়বে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এ বিশ্ব দেখেছে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ভয়াবহতা। এখন কি অপেক্ষা আরো একটা বিশ্বযুদ্ধের? আর তা যদি সত্যি হয় তবে পরমাণু অস্ত্রের প্রয়োগ অবশ্যম্ভাবী, ধ্বংস হবে ধরিত্রী। এই বিশ্ব কি পরবর্তী প্রজন্মের বাসযোগ্য থাকবে? উত্তরটা নির্ভর করছে পুতিন এবং ন্যাটো জোটের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার উপরে। ইতিমধ্যেই মুহুর্মুহু মিসাইল বর্ষণে কেঁপে উঠেছে ইউক্রেন, সে দেশের প্রেসিডেন্ট জনগণকে আহ্বান জানিয়েছেন হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার জন্য। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়তে প্রস্তুত ইউক্রেনবাসী। বোমা  আর গুলির শব্দে এখন ঘুম ভাঙছে সে দেশের প্রতিটি শিশুর। ইউক্রেন ছাড়ার জন্য উদগ্রীব অন্যান্য দেশের অধিবাসীরা। শুভবুদ্ধির উদয় হোক সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রপ্রধানের। না হলে ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।

 

More Articles