সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ! ছাঁটাইয়ের পর অফিসের সামনেই পোহা বিক্রি করছেন রিপোর্টার

Journalist Selling Poha: সাংবাদিক হয়ে দেশ বদলানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন দাদন। আর এখন পোহা বিক্রি করছেন দেশের অন্যতম বড় সংবাদ সংস্থার অফিসের সামনেই।

দেশ বদলাবেন। মানুষকে সত্যি কথা বলবেন, চারদিকে ঘিনঘিনে মিথ্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে জোর গলায় প্রশ্ন তুলবেন, সমাজ বদলাবেন। এই ইচ্ছা আর স্বপ্ন নিয়ে আনকোরা ছাত্রছাত্রীরা এসে পৌঁছন ইন্টারভিউ দিতে। বুক কাঁপে, তবু নিজেকে নিংড়ে রেখে দেন সাংবাদিকতার তাবড় সব মাথাদের সামনে থাকা বৃদ্ধ টেবিলে। সাংবাদিকতা চাকরি নয়, সাংবাদিকতা নেশা। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের ভার বইতে গেলে কী কী হতে হয় আর কী কী করতে হয় এই পাঠ চলবে দিন কয়েক। তারপর খবর খোঁজার দৌড়। সে সত্য খোঁজার লড়াইয়ের থেকেও বেশি দৌড়, একেবারে পড়ি কি মরি করে সবার আগে, প্রথম, ব্রেকিং হওয়ার দৌড়! তারপর একদিন, "তোমায় বাতিল করা হলো" শুনতে হতে পারে। শুনতে হচ্ছে, শুনতে হবে। গণতন্ত্রের স্তম্ভের ভার কীভাবে সামলাবেন বেকার সাংবাদিক? হাত পাতবেন? "একটা চাকরি দেবেন" বলতে বলতে মুখে রক্ত তুলে ফেলবেন? নাকি প্রাক্তন অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ঠেলাগাড়িতে চা-পকোড়া বা জিলিপি বিক্রি করবেন? প্রথম দুই পথে আজকাল বরফ গলে না। চাচারা সকলেই নিজেদের প্রাণ ও চাকরি বাঁচাতে ব্যস্ত! অতএব, ভুখা পেটের সাংবাদিক দেশ বদলাতে গিয়ে নিজেকেই বদলে ফেলেন। সাংবাদিক থেকে হয়ে ওঠেন ঠেলাওয়ালা। যেমন হয়েছেন দাদন বিশ্বকর্মা। দেশের অন্যতম বিখ্যাত সংবাদ সংস্থা থেকে ছাঁটাই হয়ে যাওয়ার পর শেষমেশ পোহার দোকান খুলেছেন দাদন।

২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে জি নিউজে ব্যাপক পরিমাণে কর্মী ছাঁটাই হয়। সেই ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের মধ্যেই ছিলেন সাংবাদিক দাদন বিশ্বকর্মা। পায়ের তলা থেকে রাতারাতি জমি সরে যায় তাঁর। এক রাতের মধ্যে সমস্ত জীবন, পরিকল্পনা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ছাঁটাইয়ের পর টানা ৩ মাস তিনি চাকরি খুঁজতে থাকেন। সকলের কাছে চাকরি চেয়েছেন, যেখানে পেরেছেন নিজের অবস্থার কথা জানিয়েছেন। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়, সহকর্মী- সকলেই জানতেন কী অবস্থার মধ্যে পড়েছেন এই সাংবাদিক। তবু, সাহায্য করেননি কেউই। হয়তো সাহায্য করার মতো ক্ষমতাও ছিল না কারও।

"কাজ তো খারাপ করতাম না। যারা আছেন এখন সেখানে, সবাই জানেন। যারা বাইরে আমার কাজ দেখেছেন তারাও জানেন আমি কাজ কেমন করতাম। কিন্তু ছাঁটাই হয়ে গেল। বলা হলো, টাকাপয়সার সঙ্কট চলছে সংস্থার। আসলে আমি জানি, অফিসের ভেতরে চলা রাজনীতির শিকার হয়েছি আমি," জানিয়েছেন দাদন। ২-৩ মাস যে কী অনিশ্চয়তায় কাটিয়েছেন, তিনিই জানেন। টাকা পয়সার প্রচণ্ড দরকার পড়ে। বাড়িতে হঠাৎ চিকিৎসাজনিত সমস্যা দেখা দেয় দাদনের। যে সময় ছাঁটাই হয়েছেন, স্ত্রী সেই সময় গর্ভবতী। নরমাল ডেলিভারির বদলে অস্ত্রোপচার করতে হলো। টাকা না দিলে হাসপাতাল থেকে ছুটি মিলবে না। গভীর রাতে ১ লাখ টাকা জমা করতে বলা হলো দাদনকে। কীভাবে ১ লাখ টাকা জোগাড় করেছিলেন সেই রাত্তিরে, ভাবলে আজও অস্থির হয়ে যান সাংবাদিক থেকে পোহা বিক্রেতা হয়ে ওঠা দাদন।

আরও পড়ুন- সত্যি বললেই বন্দি! ভারতে জেলে পচছেন কত সাংবাদিক, শিউরে উঠতে হবে যে তথ্যে

কম্পিউটার সায়েন্সে বিএসসি পাশ করার পরেও সেই দিকে না গিয়ে সাংবাদিকতায় চলে আসেন দাদন। স্কুলে এক স্যার বলেছিলেন, এমন কিছু করো যাতে দেশ বদলায়। ব্যাস! সাংবাদিক হয়ে দেশ বদলানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন দাদন। আর এখন পোহা বিক্রি করছেন দেশের অন্যতম বড় সংবাদ সংস্থার অফিসের সামনেই। ঠেলার নাম দিয়েছেন, পত্রকার পোহাওয়ালা। পত্রকার থেকে পোহাওয়ালা হয়ে ওঠা দাদন জানিয়েছেন, একে সাংবাদিকের দোকান বললে ভুল হবে। আসলে পরিস্থিতির চাপে পড়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এক মানুষের শেষ আশ্রয় এই দোকান। এই মানুষটি আর ১৩ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সাংবাদিক নয়। সে ক্লান্ত এক হেরে যাওয়া মানুষ। পকেটে টাকা আর পেটে খাবার না থাকলে সাংবাদিকের কলমও চলে না, এটাই সত্য। তাই বাধ্য হয়ে পোহা আর জিলিপির দোকান দিয়েছেন আজতকের অফিসের ঠিক সামনেই।

দাদন বিশ্বকর্মা ২০১১ সালে দেশের অন্যতম বিখ্যাত সাংবাদিকতা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান আইআইএমসি থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। পাশ করার পরেই ইন্দোরে চাকরি পান। ইন্দোরের চাকরি ছেড়ে চলে আসেন দিল্লিতে। তারপর আম্বালায় দৈনিক ভাস্করে চাকরিতে যোগ দেন। ২০১১ থেকে ২০১৪ অবধি ছিলেন দৈনিক ভাস্করে। তারপর ২০১৬ অবধি চাকরি করেন নবভারত টাইমসে। সেখানকার চাকরি ছেড়ে যোগ দেন ইন্ডিয়া টুডের ফুড ওয়েবসাইটে। বছর চার ধরে সেখানেই কর্মরত ছিলেন তিনি। তারপর জি নিউজে যোগ দেন। বলতে গেলে, দেশের সমস্ত বিখ্যাত সংবাদ সংস্থায় কাজ করেছেন দাদন। দৈনিক জাগরণ, নবভারত টাইমস আজতক এবং জি নিউজ- অথচ ছাঁটাইয়ের পর কোথাও কোনও চাকরি জোটেনি দাদনের।

আরও পড়ুন- জাহাজ-খালাসি থেকে সাংবাদিক! গৌরকিশোর ঘোষের বিয়েতে অতিথিদের টিকিট কাটতে হয়েছিল

তাই, নিজের আর পরিবারের পেট চালাতে পোহার দোকান। সম্পাদকের পোহা আর সাংবাদিকের পোহা। মূলত দুই ধরনের পোহা পাওয়া যায় তাঁর দোকানে। সম্পাদকের পোহা ৮০ টাকা প্লেট, তাতে দাদন পনীর দেন, বেদানা দেন। ইউটিউবার স্টার সেনসেশনাল পোহাও আছে। আর সাধারণ সাংবাদিক পোহাও আছে। সব পোহার সঙ্গে জিলিপি ফ্রি। বিএসসি করার পরে ভালো চাকরির সম্ভাবনা ছেড়ে সাংবাদিকতায় আসা। সেসব ছেড়ে এখন পোহা বিক্রি! এই তবে সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ? সাংবাদিকতার তাগিদ এখনও রয়েছে দাদনের অন্দরে। বন্ধুদের সঙ্গে মিলে একটি ইউটিউব চ্যানেলও চালান তিনি। সেই চ্যানেলকে ধীরে ধীরে দাঁড় করাতে চান। তবে আগে পেটের খিদে মেটাতে হবে। তাই বাঁচতে হবে, লড়তে হবে। আম্বেদকরের চিন্তা এখনও ভাবায় দাদনকে, হাল ছাড়তে নারাজ এই সাংবাদিক। মানুষকে স্বপ্ন দেখতে বলেন দাদন। লোকে কী বলবে, তাতে কান না দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতোই চলতে বলেন মানুষকে। আর পোহা বিক্রি করেন। দেশ বদলাতে গেলে আগে পেট চালাতে হয়। পেট চালাতে গেলে ঠিক কী কী করতে হয়, এই শিক্ষা সাংবাদিকতার মাথারা কি শেখান যুবক যুবতীদের?

 

 

তথ্য সৌজন্যে- Newslaundry Youtube Channel

More Articles