অসাধ্য সাধন বিজ্ঞানীদের! আলো যেখানে যায় না, সেই কৃষ্ণগহ্বরের ছবি এল প্রকাশ্যে
যে দু'টি ব্ল্যাক হোলের ছবি এখনও অবধি প্রকাশিত হয়েছে, তাদের দেখতে বিশেষ কিছু আলাদা না হলেও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে কিন্তু যথেষ্ট তফাত রয়েছে।
আজ থেকে ১০৬ বছর আগে আইনস্টাইন তাঁর জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটিতে দুনিয়াবাসীকে এক নতুন মহাজাগতিক বস্তুর ধারণা দিলেন। জানালেন যে, আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এমন কোনও অতি শক্তিশালী আন্তঃনাক্ষত্রিক অস্তিত্ব রয়েছে, যার প্রভাবে আলোও গতিপথ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়, সে বেঁকে যায়। এতটাই শক্তিশালী তার মাধ্যাকর্ষণ। তার কিছুদিন পরেই জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী শোয়ার্জসাইল্ড আইনস্টাইনের সেই তত্ত্বকে মান্যতা দিলেন। তার পর ১৯৭১ সালে আবিষ্কার হল প্রথম কৃষ্ণ গহ্বর বা ব্ল্যাক হোল। নাম সিগনাস এক্স-১। তার কিছুদিন পরেই, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪ সালে আবিষ্কার হল আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথ, বা মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির একদম কেন্দ্রে রয়েছে একটি বিশাল আকৃতির ব্ল্যাক হোল, যার নাম দেওয়া হয়েছিল 'স্যাজিটেরিয়স এ'। পরবর্তীকালে এই ব্ল্যাক হোলদের চিহ্নিত করার কাজে ব্রতী হন স্টিফেন হকিং।
ঠিক আটচল্লিশ বছর পর, ২০২২ সালের ১২ মে বিজ্ঞানীরা প্রকাশ করলেন ঐতিহাসিক এক ছবি। 'স্যাজিটেরিয়স এ'-র ছবি। যার মধ্যে প্রবেশ করলে আলোও আর বেরিয়ে আসতে পারে না, যার আলোর ছটা প্রস্ফুটিত হয় না, তার ছবি তুলে ফেলার মতো অসাধ্য কাজ করে ফেলেছেন বিজ্ঞানীরা। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন, ২০১৯ সালে প্রথম কোনও ব্ল্যাক হোলের ছবি প্রকাশিত হয়। মেসিয়ার ৮৭ গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা ব্ল্যাক হোলের ছবি তুলে ফেলেন এই বিজ্ঞানীর দল।
কারা ২০১৯ এবং ২০২২ সালে এমন অসাধ্য সাধন করলেন? তিনশো জন বিজ্ঞানীর একটি আন্তর্জাতিক দল, যাঁরা ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপে কাজ করেন। এই দলে রয়েছেন স্টিফেন হকিংয়ের ব্ল্যাক হোল সংক্রান্ত কাজের সহকর্মী এবং শিক্ষানবিশরাও। তাঁরা জানাচ্ছেন, ২০২২-এর কাজটা অনেক বেশি কঠিন ছিল তাদের কাছে। কেন? ৫৩ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে থাকা মেসিয়ার ৮৭ গ্যালাক্সির কেন্দ্রের ব্ল্যাক হোল বা এম-৮৭ আকারে অনেক বেশি বড় 'স্যাজিটেরিয়স এ'-র থেকে। সেই তুলনায় অনেক কাছে, মাত্র ২৬,০০০ আলোকবর্ষ দূরে থাকা ব্ল্যাক হোলের ছবি তুলতে অনেক বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, কারণ তার চারপাশে রয়েছে বিশাল ধোঁয়া, গ্যাসের মেঘ এবং বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তুর ধ্বংসাবশেষ, যার নাগাল ছাড়িয়ে ৪০ লক্ষ সূর্যের সমান ভর থাকা 'স্যাজিটেরিয়স এ'-র নাগাল পাওয়া অনেক কঠিন ছিল।
আরও পড়ুন: চাঁদের মাটিতে গাছ, সম্ভব চাষবাসও? অসম্ভবকে সম্ভব করলেন বিজ্ঞানীরা
এই কঠিন কাজে তাঁদের অস্ত্র ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা আটটি রেডিও ডিশ, যারা পরস্পরের সঙ্গে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সংযুক্ত ছিল। তাঁদের নেওয়া সমস্ত তথ্য এক জায়গায় এনে বিজ্ঞানীরা এই চিত্র তুলে ধরতে পেরেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হল, ব্ল্যাক হোল তো আলোকেও বাইরে আসতে দেয়না। ব্ল্যাক হোল তো দেখতে পাওয়ার কথা নয়। তাহলে তার ছবি উঠল কীভাবে?
ব্ল্যাক হোল আলোকেও গিলে নেয়, ঠিকই। কিন্তু ব্ল্যাক হোলেরও অনেক স্তর রয়েছে। সব আলো সরাসরি ব্ল্যাক হোলের ভেতরে প্রবেশ করেনা। ব্ল্যাক হোলের একটি সীমানা আছে, যাকে বলা হয় ইভেন্ট হরাইজন, যার ওপারে চলে গেলে আর ফেরত আসা সম্ভব নয় কারও পক্ষে, আলোরও নয়। তার বাইরে যখন আলো থাকে, তখন সেই আলো ব্ল্যাক হোলকে প্রচণ্ড দ্রুত গতিতে প্রদক্ষিণ করতে থাকে। আমরা যে ছবি দেখতে পাচ্ছি, সেখানেও দেখা যাবে, আলোর বৃত্তের মাঝে অন্ধকার।
যে দু'টি ব্ল্যাক হোলের ছবি এখনও অবধি প্রকাশিত হয়েছে, তাদের দেখতে বিশেষ কিছু আলাদা না হলেও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে কিন্তু যথেষ্ট তফাত রয়েছে। এম-৮৭ যেখানে অনেক বেশি তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়, স্যাজিটেরিয়স এ সেই তুলনায় অনেক শান্ত। এম-৮৭ অনেক দ্রুত তার আশপাশের সমস্ত পদার্থ গিলে ফেলছে, স্যাজিটেরিয়স এ সেই তুলনায় বিশেষ ক্ষুধার্ত নয়। সে এম-৮৭-র অনেক বেশি দ্রুত। এম-৮৭ যেখানে দু'সপ্তাহ নেয়, সেখানে স্যাজিটেরিয়স এ মাত্র কয়েক মিনিটে নিজের কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে।
এখানে যে বিষয়টা না বললেই নয়, সেটা হল বিজ্ঞানীদের অমানুষিক পরিশ্রমের কথা। এই ধরনের ছবি তুলতে প্রয়োজন এত বৃহৎ একটি ডিশের, যা প্রায় আমাদের পৃথিবীর সমান হবে। যেটি বাস্তবে সম্ভব নয়। সেই কারণে পৃথিবীর আটটি কোণে আটখানা ডিশ বসানো, যা পৃথিবীর নিজের অক্ষের ওপর ঘোরার সুযোগ নিয়ে ভার্চুয়াল একটি টেলিস্কোপ তৈরি করে। এবার এই আটটি ডিশ থেকে তাঁরা প্রায় আড়াই ট্রিলিয়ন পৃষ্ঠার তথ্য পাওয়া যায়। সহজভাবে বললে যা একশো মিলিয়ন ইনস্টাগ্রাম রিল ভিডিওর সমান। সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে এই অবিশ্বাস্য ছবি।
ভাবুন, মাত্র তিন বছর আগেও ব্ল্যাক হোলের ছবি মানে ছিল শিল্পীর কল্পনা। স্পেস-টাইম বাঁকিয়ে দেওয়া এই মহাজাগতিক বস্তুর ছবি তোলা এক প্রকার অকল্পনীয় ছিল। আজ এটা সম্ভব হল। কিছু বছরের মধ্যে আলো এবং গ্যাস কীভাবে ব্ল্যাক হোলে প্রবেশ করে তার ভিডিও-ও হয়তো প্রকাশ করে ফেলবেন এরা। বিজ্ঞানের এই অসামান্য প্রগতি খুবই আশাব্যাঞ্জক। আগামী দিনে বিশ্ব আরও যুগান্তকারী আবিষ্কারের অপেক্ষায় রইল।