কুয়াশায় মাখা একাকী উপত্যকা, কালিম্পংয়ের কাছেই ভিড় থেকে লুকিয়ে এই আকর্ষণীয় গ্রাম

Samalbong Tourist Spot: যেখানে হোমস্টেগুলি হয়েছে, সেই বাঁক থেকে পিচ রাস্তা ছেড়ে, পাহাড়ের শিরা বরাবর শেষ প্রান্তে একটি ভিউ পয়েন্ট। সেখানে গেলেই উল্টোদিকে দুরপিন ও ডেলোপাহাড়।

পাহাড় না সমুদ্র? আহা! বিরিয়ানির সঙ্গে তো আর ইলিশ মাছের তুলনা হয় না। তবে? পাহাড় সমুদ্র নিয়ে এসব তর্ক কেন! তাই গৌরচন্দ্রিকা না করে এবার আসল গল্পে আসি। পাহাড়ের গল্পগাছা। এই গল্পে আমাদের গন্তব্য ছোট্ট পাহাড়ি বস্তি ‘সামালবং’। কালিম্পং জেলার রাইদাড়া পাহাড়ে এই সামালবং বস্তি (নেপালি ভাষায় বস্তি শব্দের অর্থ হল ছোটো জনবসতি)। উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং-কার্শিয়াং পাহাড়ের থেকে কালিম্পংয়ের চরিত্র খানিক আলাদা। দার্জিলিং ও কার্শিয়াং ব্রিটিশ ভারতের উল্লেখযোগ্য হিল স্টেশন হওয়ায় সেখানকার  সমাজ-সংস্কৃতিতে পাশ্চাত্যের প্রভাব বেশি। অপরদিকে, সমগ্র কালিম্পং জুড়ে এখনও বেশ খানিক আটপৌরে পাহাড়ি জীবনযাত্রা পরিলক্ষিত হয়। ব্রিটিশ ভারতে কালিম্পংয়ের পরিচিতি তৈরি হয় তৎকালীন ইন্দো-তিব্বতি ব্যবসার কেন্দ্র হিসাবে। এককালে সমগ্র কালিম্পং লেপচা অধ্যুষিত এলাকা ছিল। পাশাপাশি, ভুটিয়া, লিম্বু ইত্যাদি জনজাতির মানুষেরও বসবাস ছিল এখানে। তারপর নেপালি, বাঙালি ও বিহারি সহ বহু জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সমাহার ঘটেছে। ফলত, বড় জাতিগোষ্ঠীর সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মের মূল স্রোতের সঙ্গে মিশে গেছে লেপচা জনগোষ্ঠী। লেপচা সংস্কৃতির স্বকীয়তা আজ লুপ্তপ্রায়। বর্তমানে সমগ্র অঞ্চলজুড়ে একটি মিশ্র ধর্ম ও সংস্কৃতির সমাজ গড়ে উঠেছে। এইধরনের সংমিশ্রিত জনবসতি সামালবং গ্রামেও রয়েছে।

কালিম্পং জেলার উত্তর ও পশ্চিমে তিস্তা। এই জেলার মোটামুটি মাঝ বরাবর পুব থেকে পশ্চিমে বয়ে গেছে রেলি খোলা (নদীর নেপালি প্রতিশব্দ খোলা)। রেলি খোলার উৎপত্তি লাভা জঙ্গলের কাছে। এটি তিস্তায় মিশেছে রিয়াং অঞ্চলে। এই রেলি খোলার উত্তরে কালিম্পং শহর। আর তার উল্টোদিকেই রাইদাড়া। মূল কালিম্পং শহর হয়ে এখানে পৌঁছনো যায়। কালিম্পং থেকে এর দূরত্ব ২৮ কিলোমিটার। শিলিগুড়ি জংশন বাস স্ট্যান্ড থেকে শেয়ার ট্যাক্সিতে কালিম্পং এসে সেখান থেকে সামালবংয়ের শেয়ার ট্যাক্সি ধরতে হবে। কালিম্পং আসার ভাড়া জনপ্রতি গড়ে ৪০০-৫০০ টাকা। কালিম্পং থেকে সামালবংয়ের ট্যাক্সির দুপুরের পরই পাওয়া যায়। জনপ্রতি ভাড়া নেয় ৩০০-৪০০ টাকা।

সামালবং পৌঁছনোর সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা হল কালিঝোড়া ড্যামের উপর দিয়ে যে রাস্তাটি সাম্থার চলে গেছে। শিলিগুড়ি থেকে যেকোনও চারচাকা বা দু’চাকায় যাত্রা শুরু করতে হবে। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে গাড়ির  ভাড়া ৪০০০ টাকা। যদিও এই ভাড়া মরশুম অনুযায়ী ওঠানামা করে। শিলিগুড়ি থেকে সেবক রোড ধরে প্রায় ৩০ কিমি গেলেই কালিঝোড়া। এখানে তিস্তা নদীর রয়েছে ওপর রয়েছে ড্যাম। সেই ড্যামে পৌঁছে পেরোতে হবে চেকপোস্ট। আর তা পেরোলেই কালিম্পং জেলা শুরু। তারপর পাহাড়ি রাস্তা ধরে বেশ খানিকটা এলেই পনবু। এখানে বলে রাখা ভালো যে এই পনবুর রাস্তায় উৎরাই বেশি। খুব সরু ও বেশ খাড়া বাঁক রয়েছে। তাই, গাড়িচালককে দক্ষ হতে হবে। নাহলে সমস্যা হতে পারে। বেশ কয়েক বছর আগে পর্যন্ত এখানে আসার কোনও পাকা রাস্তা ছিল না। কালিঝোড়া ড্যাম তৈরিরও আগে এখানে যেতে হত তিস্তা বাজারের কাছে করোনেশন বিজ্র পেরিয়ে। তারপর বাকিটা পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে পায়ে হাঁটা পথ ছিল। এখন অবশ্য অনেক আরামেই আসা যায় এ অঞ্চলে।

আরও পড়ুন- দিঘা-পুরী-দার্জিলিং নয়, বাঙালির মনে জায়গা পাকা করছে চটকপুর

পনবুতে এসে পড়লেই প্রকৃতির রূপ একেবারে পালটে যাবে। এখানে একটি ভিউ পয়েন্ট আছে। সেখানে দাঁড়ালে সামনে দেখা যায় কালিম্পং ও কার্শিয়াঙের কতকগুলি পাহাড় স্তরে স্তরে আকাশে মিশেছে। অনেক নীচে দেখা যায় তিস্তার বেশ কয়েকটি বাঁক। আরও দেখা যায় নদীর ওপরে কালিঝোড়া ড্যামটি। পনবুতে চা বিরতি সেরে সাম্থারের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। সাম্থারের বেশ কিছুটা পরে রাস্তা দু’দিকে ভাগ হয়ে যায়। একটি রাস্তা চলে গেছে চারখোলের দিকে। আরেকটি সিঞ্জি বাজার। সিঞ্জি বাজারের রাস্তা ধরতে হবে গন্তব্যে পৌঁছতে। এই পথের দু’ধারে রয়েছে জঙ্গল। জনবসতি বেশ কম। এ যাত্রায় আপনাকে সঙ্গ দেবে বুনো গন্ধ আর ঝিঁঝিঁর ডাক। ফুলঝাড়ু গাছের দেখা মিলবে রাস্তার ধারে। পাহাড়-জঙ্গলের ফাঁক এড়িয়ে চোখে পড়তে পারে কাঞ্চনজঙ্ঘাও।

সিঞ্জি বাজারে ঢুকেই বাম হাতে যে রাস্তা উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে সেদিকে আরও কিছুটা এগিয়ে ডান দিকে একটি চার্চ ও স্কুল দেখা যাবে। ব্যস, চার্চের সামনের রাস্তা ধরে ৩ কিলোমিটার নামলেই এসে পড়া যাবে সামালবংয়ে। ট্যুরিজমের পরিভাষায় যাকে বলা যায় একেবারে অফবিট ডেস্টিনেশন। এখানে থাকা-খাওয়ার জন্য সদ্য দু’একটি হোমস্টে তৈরি হয়েছে। বেশ ছিমছাম বন্দোবস্ত। খাওয়া-দাওয়াও ভালো। চাইলেই এক দু’দিন  থেকে যাওয়া যায়। থাকা-খাওয়া সহ দৈনিক মাথা পিছু খরচ  গড়ে ১৫০০ টাকা।

জনপদটি ১৫-২০ ঘর বাসিন্দা নিয়ে ঘরে উঠেছে। পেশা মূলত চাষবাস। এখানে এলাচ, আদা, ধান, ভুট্টা ইত্যাদির চাষ হয়। আমাদের দেশের একটি অন্যতম আদা উৎপাদন কেন্দ্র হল এই কালিম্পং জেলা। স্থানীয় চাষিদের থেকে সহজেই এসব কেনা যেতে পারে। এছাড়াও এখানে নানা ফলমূল, শাক-সবজির চাষ হয়ে থাকে। মুরগি, ছাগল ও শূকরের প্রতিপালনও হয় এখানে। হেমন্তে ধান পাকার সময় এখানে এলে ধান ক্ষেতে ময়ূরের দেখা পাওয়া যেতে পারে। তবে, সব থেকে আকর্ষণীয় হল পাহাড়ের প্যানোরমিক ভিউ। যেখানে হোমস্টেগুলি হয়েছে, সেই বাঁক থেকে পিচ রাস্তা ছেড়ে, পাহাড়ের শিরা বরাবর শেষ প্রান্তে একটি ভিউ পয়েন্ট। সেখানে গেলেই উল্টোদিকে দুরপিন ও ডেলোপাহাড়। আর তার মাঝে কালিম্পং শহর।

আরও পড়ুন- দিঘা-মন্দারমণি ফেল! এই ‘গ্র‍্যান্ড ক্যানিয়ন’-ই এখন বাংলার সেরা উইকেন্ড ট্যুরিস্ট স্পট

আকাশ পরিষ্কার থাকলে কালিম্পং শহরের শিরোস্ত্রাণ হিসেবে হাজির হবে স্বয়ং কাঞ্চনজঙ্ঘা। একটু ডানদিকে তাকালে পূর্ব সিকিমের কিছু পাহাড়ও দেখা যায়। এমন দৃশ্য দেখতে দেখতে কানে আসবে জলস্রোতের শব্দ। নীচেই বয়ে চলেছে রেলিখোলা আর তার উপত্যকা থেকে একের পর পাহাড় ধাপে ধাপে উঠেছে। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় এই উপত্যকা মেঘ-কুয়াশা মিলিয়ে মায়াময় হয়ে ওঠে। একভাবে তাকিয়ে থাকলে খানিক অপার্থিব ঠাহর হয়। সামালবংয়ে মাত্র দু’টি দোকান। তার একটি এই ভিউ পয়েন্টে। সেখানে গরম গরম মোমো/ম্যাগি, চা-কফি থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসই পাওয়া যায়।  উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি গ্রামগুলিতে অবশ্য এই ধরনের দোকান আকছার চোখে পড়ে। চা-কফি ও মোমো সহযোগে সামনের পাহাড়-উপত্যকার দৃশ্য দেখতে দেখতে বিকেলগুলো দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায়।

এই ভিউ পয়েন্ট থেকে রেলি নদীর দৃশ্য ভালো দেখা গেলেও, সামালবংয়ে পৌঁছনোর মুখেই রাস্তার একটি বাঁক থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও পাহাড়ের দৃশ্য সবচেয়ে ভালো দেখা যায়। আর এই জায়গা থেকেই সন্ধ্যার পর কালিম্পং শহরকে মনে হয় হাজার হিরে খচিত নেকলেস। এ দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা অনন্য।

সামালবংয়ের উচ্চতা সমুদ্রাপৃষ্ঠ থেকে ৪০০০ ফুটের কাছাকাছি। তাই আবহাওয়া মনোরম। ঠান্ডা থাকলেও তা উপভোগ্য। বছরের যেকোনও সময় বেড়াতে আসা যায় এখানে। তবে, এখানে আসার সব থেকে ভালো সময় সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ। এই সময়কালে আকাশ পরিষ্কার থাকায় পাহাড়- উপত্যকা ভালোভাবে দৃশ্যমান হয়। গ্রামটি শান্ত- নিরিবিলি।

একেবারে নিশ্চিত করেই একথা বলা যায় যে এখানে এলে জীবনের সফেন সমুদ্রে দু’দণ্ড শান্তি পাওয়া যাবেই। গ্রামের মানুষজনও বেশ আন্তরিক। স্থানীয় বাসিন্দাদের মূল ভাষা নেপালি। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান– তিন ধরনের ধর্মীয় আচার- অনুষ্ঠানই পালিত হয় বছরভর। পায়ে হেঁটেই যাওয়া যায় রাইদাড়া চার্চ। এই চার্চের সামনেই সাপ্তাহিক হাট বসে। জঙ্গলের মধ্যে হাইকিং করার সুযোগ রয়েছে এখানে। চাইলে চারখোল, লাভা, ডেলো সহ কালিম্পং জেলার অন্যান্য জায়গায়ও ঘুরে আসা যায় এখান থেকেই।

পনবু

সেভক রোড ধরে, কালিঝোড়া থেকে আরও ১৫ কিমি পরে তিস্তা ড্যাম পেরিয়ে, ২৭ মাইল ও সুরুক হয়েও পৌঁছনো যায় সামালবং। এ রাস্তাও ভারী সুন্দর। রাস্তার ধারে শাল, সেগুনের জঙ্গল। রয়েছে সেভখোলা নদী। তবে, এ পথে শেয়ার গাড়ি নেই। শিলিগুড়ি থেকে ভাড়ার গাড়িই ভরসা। গাড়ি ভাড়া করে আসার ক্ষেত্রে, ২ রাত ৩ দিন বেড়ানোর মোট বাজেট মাথাপিছু ১২০০০ টাকা। বেশ কয়েকজন মিলে গাড়ি শেয়ার করলে বা স্ট্যান্ড থেকে শেয়ার ট্যাক্সি নিলে মাথাপিছু খরচ কমে তা হবে ৫০০০-৭০০০ টাকা। শিলিগুড়ি থেকে মাত্র ৭৫ কিমি দূরের এই গ্রামটিতে সেই অর্থে টুরিস্টের ভিড় নেই। তাই, ছুটি কাটাতে হেমন্ত-শীতের হপ্তান্তে চলে আসাই যায় সামালবং।

More Articles