বাংলা ছবির গান থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় রামধনুর মতো ছড়িয়ে সুরের আকাশে

'ঘুম ঘুম চাঁদ, ঝিকিমিকি তারা, এই মাধবী রাত, আসেনি তো বুঝি আর , জীবনে আমার,' এ গানের শ্রোতার জীবনে আর নেমে আসবে না চাঁদনী রাতের আলো। কারণ লক্ষ লক্ষ অনুরাগীকে ছায়াছবির যুগে ফেলে রেখে চাঁদের কাছাকাছি একাই পাড়ি দিয়েছেন গায়িকা, গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সাম্প্রতিককালে কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া 'পদ্মশ্রী' পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি। মনে খানিকটা অভিমান নিয়েই জানিয়েছিলেন, এত বছর ধরে গাইছেন, অথচ,  নব্বইয়ের কোঠায় এসে তাঁকে পুরস্কার দেওয়া হল।  ফলত, এ খেতাব গ্রহণে তিনি অপারগ। তাঁর অধিকাংশ সহ গায়ক গায়িকা প্রয়াত হয়েছেন আগেই। বাংলা  ছায়াছবির জৌলুসের দিনকালের যে অল্প কয়েকজন সাক্ষী আজ জীবিত, তাঁদের মধ্যে ছিলেন মান্না দে। তিনিও চলে গেলেন ২০১৩ সালে। তারপর একলা নাবিকের পালা। প্রায় ন' বছর বিশ শতকের বাংলা গানের অসংখ্য স্মৃতি একা আঁকড়ে রেখে অবশেষে প্রয়াত হলেন 'অগ্নিপরীক্ষা'-র মতো অসংখ্য ছবির সুপারহিট গায়িকা। 

সে ছিল ১৯৩১ সালের এক শরতের এক দিন। ঢাকুরিয়ার মুখুজ্জে বাড়িতে জন্ম নিলেন এক মেয়ে। বাবা মা তাঁর নাম রাখলেন 'সন্ধ্যা'। তিন ভাই আর তিন বোন নিয়ে তাঁর পরিবার নেহাত ছোট নয়। বাবা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় চাকরি করেন রেলে। দিন চলে যায় ভালোভাবেই। কিন্তু অল্পবয়সেই সন্ধ্যার জীবনে  বিষণ্ণতার ছায়া ঘনিয়ে এলো। মারা গেলেন তাঁর এক ভাই এবং বোন। কিন্তু যাত্রাপথ তো আর থেমে থাকে না। শৈশব থেকেই গানের তালিম নিতে আরম্ভ করলেন তিনি। শাস্ত্রীয় সংগীত শিখতে শুরু করলেন সন্তোষকুমার বসুর কাছে। তাঁর কন্ঠস্বরের মাধুর্য প্রকাশিত হল অল্প সময়ের মধ্যেই। 

সন্ধ্যার বয়স তখন ১৭। 'গীতশ্রী'র পরীক্ষা দিতে গেছেন তিনি। ভয় তো কিছুটা রয়েছেই। এমনিতেই তিনি গাইবার আগে খানিক নার্ভাস হয়ে পড়েন। তা যাই হোক, যথাসময়ে তিনি পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছলেন। পৌঁছে দেখেন সর্বনাশ, বিচারকের আসনে বসে আছেন স্বয়ং আলাউদ্দিন খাঁ,  মহম্মদ দবীর খাঁ এবং রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এমন সব গুণীজনের সামনে কী গাইবেন তিনি? কিন্তু গাইতে তো তাঁকে হবেই। ফেরবার পথ নেই। সন্ধ্যা গাইলেন, সময় মতো ফলাফলও প্রকাশিত হল। তিনি দেখলেন তালিকার প্রথমেই তাঁর নাম।অর্থাৎ  'গীতশ্রী'র পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন তিনি। তাঁর মনে সেদিন আনন্দ আর ধরে না। 

কঠোর পরিশ্রম আর সাধনার মধ্যে দিয়েই সন্ধ্যার জীবনে এসেছিল এক মহারথীর কাছে গান শেখার সুযোগ। নাম তাঁর উস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খাঁ। বিংশ শতাব্দীর তানসেন তিনি। সংগীত জগতের হিমালয়ের সামনে বসে যিনি দিনের পর দিন তালিম পেয়েছেন তাঁর কণ্ঠে যে অচিরেই বাগদেবী এসে বাসা বাঁধবেন এ আর আশ্চর্য কী? বড়ে গুলাম আলী খাঁ সাহেবের পরেও পাতিয়ালা ঘরানার তালিম তিনি নিয়েছিলেন তাঁর পুত্র উস্তাদ মুনব্বর আলী খাঁ'র কাছে। এ ছাড়াও ছিল কিরানা ঘরানার তালিম। সে তালিম পেয়েছিলেন পন্ডিত এ কাননের তত্ত্বাবধানে। আধুনিক বাংলা গানের সঙ্গে সঙ্গে শাস্ত্রীয় সংগীতের ভিত যে সন্ধ্যাদেবীর কী পরিমাণে পাকাপোক্ত ছিল তার প্রমাণ মেলে মালকোষ রাগে তাঁর গাওয়া দ্রুত খেয়ালের রেকর্ডিংয়ে। 

সাম্প্রতিককালে মৃত্যু হয়েছে 'ভারতের নাইটেঙ্গেল' লতা মঙ্গেশকরের। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও লতা মঙ্গেশকর, গানের জগতের এই দুই প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে নানান সময় উঠে এসেছে বিতর্ক। দুজনের নাকি ছিল ঘোর শত্রুতা। তবে তথ্য কিন্তু খানিক অন্য কথাই বলে। শচীন দেববর্মণের আমন্ত্রণে সন্ধ্যা বোম্বে গেছিলেন নানা দ্বিধা দ্বন্দ সত্ত্বেও। সেখানে গিয়ে তিনি প্রথম গান করেন অনিল বিশ্বাসের 'তারানা' নামক এক ছবিতে। এই গানের মধ্যে দিয়েই লতার সঙ্গে তাঁর আলাপ। দু'জনের ডুয়েটে গড়ে উঠেছিল অভিনেত্রী মধুবালা এবং শ্যামার অসামান্য অভিনয়। সেখান থেকেই মিতায়নের সূত্রপাত।  একে অপরের বাড়িতে দুই বান্ধবীর যাতায়াত চলত ঘন ঘন। সন্ধ্যার মায়ের হাতের পায়েস অত্যন্ত পছন্দ করতেন লতা। 

সারা জীবন দাপটের সঙ্গে গান করেও শেষ বয়সে এসে কোকিলকন্ঠীর সন্ধ্যার  বিনয় এক চুল টলেনি। একবার সায়েন্স সিটিতে গাইবেন তিনি এবং মান্না দে। শ্রোতার ভিড় আর ধরে না। অসামান্য অনুষ্ঠানের পর গ্রীনরুমে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন সংগীত শিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য। গিয়ে দেখলেন এক অডিটোরিয়াম দর্শকের মধ্যে জয়জয়কার ফেলে দিয়ে সন্ধ্যা পরম শান্তিতে টিফিন বাক্স খুলে চিঁড়ের পোলাও খাচ্ছেন।।শ্রীকান্তবাবুকে দেখে তাঁর প্রথম প্রশ্ন 'কী মনে হল, ভালই হয়েছে, না?' আসলে আমরা ভুলে যাই, বড়ে গোলাম আলি খাঁ নামক যে মহীরুহের কাছে তিনি তালিম নিয়েছিলেন, তিনি নিজে সদা সর্বদা সুরের কাছে নতমস্তক হয়ে থাকতেন।

ষাটের দশকের কথা। খাঁ সাহেবের খ্যাতি তখন তুঙ্গে। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ডিক্সন লেনের বাড়ির মেহফিলে তিনি ছায়ানট গাইবেন। গাওয়ার আগে নিখুঁত সুরে সুরমণ্ডলখানা মেলালেন, তারপর ঘোষণা করলেন, 'ডর লগতা হ্যায়, লয় অউর সুর সে। ইয়ে বহুত বড়ি চিজ হ্যায়। হম ইসকে পূজারী হ্যায়।' খাঁ সাহেবের গান শোনার আগে শুধু তাঁর বিনয় দেখেই সেদিন  শ্রোতাদের গলা থেকে বেরিয়ে এসছিল, 'আহা'। 


তথ্যসূত্র: 
কখনও মা কখনও বালিকা: শ্রীকান্ত আচার্য

লতা-সন্ধ্যা সুখ-দুঃখের গল্পে মাততেন সময় হলেই! দ্বৈরথ-তিক্ততার জলাঞ্জলি দুই 'সরস্বতী'র: সঞ্জয় ঘোষাল

More Articles