সৌদি আরবের ড্রেসিংরুমে ঠিক কী বলেছিলেন কোচ হার্ভে রেনার্ড?
FIFA World Cup 2022: প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনার সামনে নিঃস্পৃহ ছিল সৌদি আরব। তারপর ড্রেসিংরুমেই ঘটল সেই আশ্চর্য ঘটনা...
“সত্তর মিনিট। স্রিফ সত্তর মিনিট হ্যায় তুমহারে পাস। শায়েদ তুমহারি জিন্দেগি কে সবসে খাস সত্তর মিনিট।” সিনেমার পর্দায় তখন মহিলাদের হকি বিশ্বকাপের ফাইনাল। ময়দানে নামবে ভারতীয় হকি টিম। তার আগে কোচের ভূমিকায় শাহরুখ খানের এই দীর্ঘ ডায়লগ অনেক সিনেপ্রেমীর মনে আজও জ্বলজ্বলে। কিংবা, মনে পড়বে বাংলা সিনেমায় ‘ক্ষিদ্দা’র কথা। কোনির উদ্দেশ্যে বারবার চেঁচিয়ে ওঠা, গলার শির ফুলিয়ে চেঁচিয়ে ওঠা “ফাইট, কোনি, ফাইট!” রিল থেকে রিয়েলে এলেও ছবিটা একই থাকে। খেলার মাঠে কোচদের এমন ভূমিকা সবসময় খেলোয়াড়দের মধ্যে উদ্দীপনা জাগায়। আর যদি সেই মঞ্চটা বিশ্বকাপ ফুটবলের হয়, তাহলে তো কথাই নেই।
আরও পড়ুন : পরকীয়া, অবাধ যৌনতা! মেসিদের হারের নেপথ্যনায়ক হার্ভে রেনার্ডের জীবন নিয়ে তোলপাড়
বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল, কাতারে শুরু হয়েছে ফুটবল মহারণ। দু’দলের মোট ২২ জন খেলোয়াড়, সঙ্গে একটি ফুটবল। বিশ্ব ফুটবলের এই সেরা মঞ্চে লড়াই চলে সেয়ানে সেয়ানে। আর এই মঞ্চেই দেখা গেল এক কোচের হার না মানা মনোভাব। তিনি সৌদি আরবের কোচ হার্ভে রেনার্ড। সম্প্রতি তাঁরই একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে দিকে ঘুরছে। তখন ছিল আর্জেন্টিনা বনাম সৌদি আরবের ম্যাচ। গ্রুপ লিগের প্রথম খেলা, প্রথমবারের জন্য মুখোমুখি দুই দল। এদিকে প্রথমার্ধেই লিওনেল মেসির পেনাল্টির সুবাদে এক গোলে পিছিয়ে যায় আরব্য রজনীর দেশের খেলোয়াড়রা। তারপরই ড্রেসিংরুমে গিয়ে তাঁদের সামনে দাঁড়ান কোচ হার্ভে রেনার্ড।
এখান থেকেই শুরু ভিডিওটার। সেখানে দেখা যাচ্ছে, কোচ হার্ভে অত্যন্ত উত্তেজিত ভঙ্গিতে তাঁর খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলছেন। শুধু ভাষায় নয়, শরীরী ভঙ্গিতেও সেই উত্তেজনা প্রকাশ পাচ্ছে। আরও আক্রমণাত্মক খেলার কথা বলছেন তিনি। নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে খেলার জন্য বলছেন। তাঁর একটাই বক্তব্য, “আমরা মাঠে ঠিক কী করছি? আদৌ কি চাপ বাড়াচ্ছি? মেসির পায়ে বল এলে তোমরা রক্ষণে নেমে যাচ্ছ। কিন্তু ও তো মাঝমাথে খেলছে। সেখানে কেন ওকে আটকাচ্ছ না?” প্রতিটা শব্দ বলার সময় হার্ভে রেনার্ডের ভেতেওর জেগে উঠছিল অনমনীয় এক মনোভাব। জিততে হবে, জেতার জন্য খেলা, এটাই তো হবে একটা টিমের মানসিকতা। সেই কথাটাই বারবার বলে চলেছেন কোচ।
আরও পড়ুন : মেসির জারিজুরি শেষ তাঁর সামনে! সৌদির গোলকিপারকে চেনেন?
আর লিওনেল মেসি? সেই প্রসঙ্গও এড়াননি হার্ভে রেনার্ড। খেলোয়াড়দের বারবার বলছেন, “তোমরা কি মেসির সঙ্গে ছবি তুলতে এসেছ? তাহলে নিজেদের ফোন নাও। আর গিয়ে ছবি তোলো।” বারবার মেসিকে আটকানোর কথা বলছেন তিনি। শিখিয়ে দিচ্ছেন তার নীল নকশা। ম্যাচে তাঁরা অবশ্যই ফিরতে পারবেন, অবশ্যই জিততে পারবেন, এই ধারণা শুরু থেকেই ছিল কোচ হার্ভে রেনার্ডের মধ্যে। তিনি চান, তাঁর খেলোয়াড়রাও এই ভঙ্গিতেই ময়দানে নামুক। উল্লেখ্য, গোটা ব্যাপারটাই ইংরেজিতে বলছিলেন হার্ভে রেনার্ড। তাঁর পাশেই ছিলেন এক দোভাষী। কিন্তু রেনার্ডের শরীরী ভাষাটাই যেন অনেকটা বলে দিচ্ছিল। এটা যে আন্তর্জাতিক ফ্রেন্ডলি নয়, বিশ্বকাপের মতো মহামঞ্চ, সেটাও বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি।
এর পরের গল্পটা তো আমরা সকলেই জানি। গত মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর ২০২২-এর দিনটি সৌদি আরবের খেলোয়াড়রা হয়তো কখনই ভুলতে পারবেন না। মাঠের মধ্যে ১১ জনের লড়াইয়ের সামনে হার মানতে বাধ্য হয়েছিল মেসি-ডি মারিয়ার মতো তারকাখচিত আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনার জালে দু’বার বল জড়ানোই শুধু নয়, দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে মেসিদের আক্রমণও রুখেছে সৌদি আরব। গোলরক্ষক, ডিফেন্ডার থেকে স্ট্রাইকার – প্রত্যেকেই লড়েছেন। লড়াই করেছেন; আসলে এই লড়াইটাই তো দেখতে চাইছিলেন কোচ হার্ভে রেনার্ড। পৃথিবীর প্রতিটি কোচ, প্রতিটি দর্শক ও খেলোয়াড়রা এই লড়াইয়ের আমেজটা চান। ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী’ – এটাই তো খেলার মাঠের মন্ত্র। ২২ নভেম্বর সেই স্পর্ধাই বারবার দেখা গিয়েছে সৌদি আরবের খেলোয়াড়দের মধ্যে। আর সবকিছুর নেপথ্যে ছিলেন কোচ হার্ভে রেনার্ড এবং তাঁর সেই ভাইরাল বক্তব্য। একবাক্যে সেই কথা স্বীকার করে নিয়েছেন খেলোয়াড়রাও। কোচের সেই উদ্দীপনাময় বক্তব্য শুনে প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলেন আল-মালকির মতো কয়েকজন। একে তো কাতারের মাটিতে বিশ্বকাপ, আন্তর্জাতিক খবরাখবর দেখলেই বোঝা যায়, কাতার ও সৌদি আরবের তিক্ত সম্পর্কের কথা। সেখানে সেই দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে আর্জেন্টিনাকে হারানো, অবশ্যই বড়ো একটি ঘটনা।
আরও পড়ুন : এই বিশ্বকাপটা মেসির চাই-ই, কিন্তু…
এরপর পোল্যান্ডের সঙ্গেও লড়েছে সৌদি আরব। সেখানে অবশ্য কাঙ্খিত জয় আসেনি; কিন্তু ম্যাচের পরিসংখ্যানে লড়াইয়ের ছাপ কিন্তু স্পষ্ট। গোটা ম্যাচে সৌদি আরবের বল পজেশনিং ছিল ৬৪ শতাংশ। ১৬টি শট নিয়েছেন খেলোয়াড়রা। নিজেদের মধ্যে পাস খেলেছেন ৫৩৭ টি। আর উল্টোদিকে পোল্যান্ড সেই পরিসংখ্যানের দিক থেকে বেশ খানিকটা পিছিয়ে। তবুও, ফলাফলের ভিত্তিতে দুই গোলে জেতেন লিওয়ানডস্কিরা। কিন্তু লড়াইয়ের ময়দান ছাড়েনি সৌদি আরব।
লিখতে লিখতেই মনে পড়ছিল ২০১১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের কথা। পাকিস্তানকে হারিয়ে মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ের ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট দল। তারপর ড্রেসিংরুমেও ছোট্ট একটি ভাষণ দিয়েছিলেন তৎকালীন জাতীয় দলের কোচ গ্যারি কার্স্টেন। বারবার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, এখনও একটি পর্যায় বাকি। বিশ্রাম নাও, তারপর ফের লেগে পড়ো মাঠে। ফাইনাল যেটা তখনও বাকি। বাস্তবের ‘ক্ষিদ্দা’রা বারবার এভাবেই সাহস জুগিয়ে যান খেলোয়াড়দের। হয়তো বারবার মনে পড়বে হার্ভে রেনার্ডের সেই শরীরী ভাষা, চিৎকার, শব্দগুলো। যা একটা ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।