অবাধ স্কুল ফি-র দিন শুরু, মহামারীর শেষে শিক্ষার অধিকার উঁচুতলাতেই থাকল?

আগামী ১ মার্চ থেকে ফের পুরমাত্রায় পড়ুয়াদের কাছ থেকে ফি গ্রহণ করতে পারবে পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি স্কুলগুলো। এমনটাই নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। পাশাপাশি এও জানানো হয়েছে যে ফি জমা দেওয়ায় অপারগ পড়ুয়াদের বিরুদ্ধে ২৫ মার্চ পর্যন্ত কোনোরকম কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। ২০২০ সালের অক্টোবরে, করোনার আবহে রাজ্যের বেসরকারি স্কুলগুলোর ফি'তে ২০ শতাংশ ছাড় দেওয়ার নির্দেশ দয়েছিল হাইকোর্ট। এমনটাও বলা হয়েছিল যে কোনও পড়ুয়া যদি বেতন দিতে না পারেন তাহলেও তাঁকে স্কুল থেকে বিতাড়িত করা যাবে না এবং পরীক্ষায় বসার সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু কোর্টের বর্তমান রায়ে ফি কাঠামোয় ২০ শতাংশ ছাড়ের আইনি নির্দেশ ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও বলা হয়েছে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের বকেয়া ৫০ শতাংশ ফি শোধ করতে হবে পড়ুয়াদের।

কোভিড আবহে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কথা মাথায় রেখে বেসরকারি স্কুলগুলির ফি গ্রহণের উপর যে আইনি রাশ টানা হয়েছিল, তা সরিয়ে নিয়ে পড়ুয়াদের একভাবে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেওয়া হলো না কি? ২০২০ সালের লকডাউনের প্রায় গোড়া থেকেই দেখা গেছে বিভিন্ন স্কুলের বিরুদ্ধে অযাচিতভাবে ফি গ্রহণের অভিযোগ এনে নানান সময় অভিভাবকরা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছেন। সে বছর  দক্ষিণ কলকাতার রাণীকুঠি অঞ্চলের একটা বেসরকারি স্কুল থেকে একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে ঘোষণা করা হয়, তার মধ্যে ফি জমা দিতে না পারলে পড়ুয়াদের অনলাইন ক্লাস করতে দেওয়া হবে না। অভিভাবকদের মেল পাঠিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ জানান নির্দিষ্ট সময়ের পর ফি জমা দিলে নেওয়া হবে লেট ফাইন। যথারীতি এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফি মকুবের দাবি নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন অভিভাবকদের একাংশ। তাঁদের অভিযোগ স্কুল থেকে ল্যাব চার্জ, এডুকেশনাল একটিভিটি চার্জের মতো বিষয়ের অজুহাত দেখিয়ে অন্যায়ভাবে অত্যাধিক ফি নেওয়া হচ্ছে। 

কোভিডে অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, এ পরিস্থিতিতে ফি গ্রহণের ক্ষেত্রে স্কুল থেকে কোনোরকম সহায়তা না করা হলে তাঁরা সমস্যায় পড়বেন, বলছেন অভিভাবকদের অনেকেই। রাণীকুঠি ছাড়াও বিক্ষোভ হয়েছিল দুর্গাপুর এবং মহেশতলার মতো এলাকায়। দু-দুটো লকডাউন এবং কোভিডের ধাক্কার পর রাজ্যের বেসরকারি স্কুলগুলোর ফি কাঠামোকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে ঠিকই,  কিন্তু সাধারণ মধ্যবিত্তের জীবনের অর্থনৈতিক স্বাভাবিকতা ফিরতে এখনো ঢের বাকি। 

'সেন্টার অফ মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি'-র (সিএমআইই) ২০২১ এর রিপোর্ট অনুযায়ী সে বছর মে মাসে ১.৫৩ কোটি ভারতীয় কর্মহীন হয়েছেন। তার মধ্যে এসে পড়ে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব। লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিতে হয় বেশ কিছু রাজ্যকে। ফলত, অর্থনীতির গতি একভাবে থমকে যায়। বিশেষজ্ঞরা সে সময়ে মনে করেছিলেন বেতনভুক চাকরি ছাড়াও মহামারীর ফলে ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে ব্যবসা এবং ছোট ব্যবসার। এ ছাড়াও লকডাউনের ফলে উপার্জনের রাস্তা কার্যত বন্ধ হয়ে যায় দিন মজুরদের। পরবর্তীতে বেতনভুক চাকরির ক্ষেত্রে কিছু উন্নতির লক্ষণ দেখা গেছে। চলতি বছরের রিপোর্টে সি এম আইই জানিয়েছে, গত ডিসেম্বরে বেকারত্বের হার ছিল ৭.৯ শতাংশ, কিন্তু ২০২২ এর জানুয়ারিতে তা কমে এসেছে ৬.৫৭ শতাংশে। এ পরিসংখ্যান কিছুটা আশার আলো জাগায় ঠিকই, কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে এখনো বেশ কিছুটা সময় লাগবে। 

মাথায় রাখতে হবে মহামারীর প্রকোপে কেবল কর্মহীনতার হারই বৃদ্ধি পায়নি। তার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বেতন ছাঁটাই বা স্যালারি কাটের সমস্যা। বড় থেকে ছোট, ভারতের অধিকাংশ বেসরকারি সংস্থাই অর্থনৈতিক মন্দার অজুহাত দেখিয়ে কর্মীদের প্রাপ্য বেতন থেকে বেশ কিছুটা করে অংশ কেটে নিয়েছে। এই স্যালারি কাটের হার কোথাও ১৫ শতাংশ, কোথাও আবার ২৫ শতাংশ। এ অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি স্কুলগুলো তাদের পুরোনো ফি কাঠামোয় ফিরে গেলে বিপুল সংখ্যক মানুষের সমস্যায় পড়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। বহু মানুষই এখনও ততটা সক্ষম নন। 

হাইকোর্টের রায় শুনে খানিক দুশ্চিন্তায় পড়েছেন মলয় জানা (নাম পরিবর্তিত)। দক্ষিণ কলকাতার এক ফটোগ্র্যাফি স্টুডিওয় নামমাত্র বেতনে চাকরি করেন তিনি। কোভিড পরিস্থিতিতে তাঁর সংস্থার যুক্তি ছিল, 'বাণিজ্য নেই, অতএব পুরো বেতন মিলবে না।' একমাত্র ছেলেকে কলকাতার নামকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করেছেন তিনি। গত দু বছর নানান সমস্যার মধ্যে দিয়ে তার ফি মেটাতে হয়েছে।হতাশার সঙ্গে তিনি বলছিলেন, ' ২০২০ থেকে এই দু বছরই সরকারি নির্দেশ সত্ত্বেও আমাদের স্কুল ফি একটুও কমানো হয়নি। এবার সরকার থেকে যে নির্দেশটা দেওয়া হচ্ছে তাতে যদি  ফি আবার বেড়ে যায় তাতে আমাদের অসুবিধাই হবে। কারণ এই দু বছর আমরা নিয়ম করে পুরো মাইনে তো দিয়ে গেছি। কিন্তু কোম্পানি আমাদের স্যালারি থেকে কিছু কিছু করে কেটে নিয়েছে।' 

স্কুলের ফি কাঠামোর উপর থেকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া মানে কি পরোক্ষভাবে তাকে ফি বৃদ্ধির ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া? প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ চলতি বছরে কোর্ট থেকে এমন কোনও সিদ্ধান্তের কথা এখনো জানানো হয়নি যার ফলে স্কুলগুলোর ফি বৃদ্ধির উপর আইনি নিষেধাজ্ঞা জারি হবে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার একটা বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন বর্ষা চৌধুরী। তাঁর স্কুলের বহু পড়ুয়ার অভিভাবকই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত।গত দু বছরে কী বিপুল প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে তাঁরা স্কুলের ফি মিটিয়েছেন তা তিনি দেখেছেন। তিনি বলছিলেন, 'হাইকোর্টের একটা রায় ছিল, ফি ক্লিয়ার না করলেও বেসরকারি স্কুলের ছেলেমেয়েদের পরীক্ষায় বসতে দিতে হবে। কিন্তু সেটা সত্ত্বেও প্রাইভেট স্কুলগুলোর ক্ষেত্রে যেটা একটা খুব রেগুলার প্র্যাকটিস ছিল সেটা হল, বাচ্চারা অনলাইনে পরীক্ষা দিত, কিন্তু ওদের রেজাল্টটা দেওয়া হত না যতক্ষণ না ওরা ফি ক্লিয়ার করছে।' হাইকোর্টের রায়ের ফলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা করছেন বর্ষা। তিনি আরও বলছিলেন, 'এই যে হাইকোর্ট থেকে পুরোনো বেতন কাঠামোয় ফিরে যাওয়ার যে রায়টা দেওয়া হল, এতে শিক্ষাক্ষেত্র সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ এতদিন অবধি যাঁরা পারছিলেন, তাঁরাও তাঁদের ছেলেমেয়েদের ছাড়িয়ে নেবেন স্কুল থেকে।'

একদিকে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বাজেটে 'অমৃত কালে'র দামামা বাজিয়ে দেশে 'ডিজিটাল ডিভাইডে'র বাতাবরণ থাকা সত্ত্বেও ঘটা করে ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ঘোষণা করছেন। শিক্ষার কর্পোরেটাইজেশানের দিকে হাঁটা হচ্ছে অহরহ। হাইকোর্টের রায়ের মধ্যে দিয়ে পশ্চিমবাংলার বেসরকারি স্কুলগুলোকে অভিভাবকদের থেকে যথেচ্ছ ফি গ্রহণের অধিকার দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ছাড়া শিক্ষাও হলো দেশের জনগণের নূন্যতম অধিকারগুলোর মধ্যে একটা, এ কথা ভুলে যাই আমরা। প্রথম তিনটে সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র দারুণ সচেষ্ট হয়েছে এ কথা জোর দিয়ে বলা চলে না, অন্তত এই মহামারী পরবর্তী সময়ে। বরং সরকারি সিদ্ধান্তের ফলে শিক্ষার উপরেও যেন বিত্তবানদের একাধিপত্যই স্বীকৃতি পাচ্ছে। 

More Articles