চাঁদের মাটিতে গাছ, সম্ভব চাষবাসও? অসম্ভবকে সম্ভব করলেন বিজ্ঞানীরা
এই অংশে জলের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হলে, পরবর্তীকালে চাঁদে পৌঁছে গবেষণা করা যাবে, সরাসরি চাঁদের মাটিতে চাষ করা যাচ্ছে কি না। কিংবা চাষের উপযুক্ত পরিবেশ চাঁদে আদৌ আছে কি না।
মহাজগতে পাড়ি দেওয়ার প্রথমদিকের দিনগুলিতেই অ্যাপোলো মিশনে অংশগ্রহণকারী মহাকাশচারীরা পরিকল্পনা করেছিলেন চাঁদ থেকে মাটি সংগ্রহ করে পৃথিবীতে আনবেন। চাঁদের মাটিকে বলে 'রেগোলিথ'। যদিও মাটির নমুনা সংগ্রহের সময় তাঁরা কেউই জানতেন না, ঠিক কী ধরনের গবেষণা করবেন সেই মাটি দিয়ে। অ্যাপোলো মিশনের প্রারম্ভ সেই ১৯৬১ সালে, এবং এই মিশন জারি ছিল টানা দশ বছর। অর্থাৎ ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। উদ্দ্যেশ্য ছিল মহাকাশচারীদের নিয়ে চাঁদে পাড়ি দেওয়া।
অ্যাপোলো মিশনের পঞ্চাশ বছর পরে, যখন আর্টেমিস যুগ চলছে, ঠিক তখনই চাঁদ থেকে সংগ্রহ করা মাটি অর্থাৎ রেগোলিথে বীজ রোপণ করলেন ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। আর সেই মাটিতে জন্ম নিল চারা গাছ।
অ্যাপোলো মিশনে অংশগ্রহণকারী মহাকাশচারীরা সত্যি-ই নিজেদের দূরদর্শিতা দেখিয়েছিলেন এই মাটি সংগ্রহ করে। কারণ, সংগ্রহ করা এই মাটিতে চারাগাছ জন্ম নেওয়ার ঘটনা যেন ইঙ্গিত দিল, চাঁদের মাটিতেও গাছ জন্মানো সম্ভব। চাঁদের জমি কতটা বাসযোগ্য, সেই উত্তর ভবিষ্যতের গবেষণাই বলে দেবে। কিন্তু চাঁদের জমি যে চাষযোগ্য, তা প্রমাণ করে দিলেন ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা তাঁদের সাম্প্রতিকতম গবেষণার মাধ্যমে।
আরও পড়ুন: আর দেড় ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়লেই সমূহ সর্বনাশ! কী আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা?
ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষক, অ্যানা লিসা পল এবং রব ফার্লের তত্ত্বাবধানে গবেষণাটি করা হয়েছে। তার আগে এই জাতীয় গবেষণামূলক কাজের জন্য ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিল নাসা। নাসার পরিচালক বিল নেলসন জানাচ্ছেন, এই গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাসার মহাকাশ-বিষয়ক ভবিষ্যৎ প্রকল্পগুলির জন্য। এই প্রকল্পগুলিতে মহাকাশচারীদের আবার চন্দ্রাভিযানে পাঠানো হবে আরও বিশদে চাঁদ সম্পর্কে গবেষণা করতে। শুরু হবে মঙ্গল অভিযানও। তাই তার আগেই চাঁদ এবং মঙ্গলের মাটিতে পাওয়া প্রাকৃতিক সম্পদ পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখতে হবে, তা আদৌ মানুষের ব্যবহারের যোগ্য কিনা। এমনটাই জানাচ্ছেন বিল নেলসন।
এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত রবার্ট ফার্ল, ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্যানপালনবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক। তিনি জানাচ্ছেন, গবেষণা শুরুর সময়ে আমাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল আদৌ কি রেগোলিথ অর্থাৎ চাঁদের মাটিতে গাছ জন্মাবে? আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, এই গবেষণা কি চাঁদের ভবিষ্যৎ বাসিন্দাদের কোনও উপকারে আদৌ আসবে?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর তো পেয়েই গেছেন গবেষকরা। কিন্তু মুশকিল হল, চাঁদের মাটিতে জন্মানো গাছগুলি, পৃথিবীর বুকে জন্মানো গাছের মতো এত শক্তপোক্ত নয়। এমনকী, আগ্নেয়গিরির মাটিতে জন্মানো গাছও, এর থেকে অনেক বেশি সুস্থ ও শক্তপোক্ত। কিন্তু চাঁদের মাটিতে জন্মানো গাছগুলি দুর্বল হলেও, অন্তত তারা জন্মেছে চাঁদের মাটিতে। বিজ্ঞানীরা একপ্রকার অসম্ভব এবং অভাবনীয়কে সত্যি-ই সম্ভব করে তুলেছেন গবেষণাগারে বসে।
এদিকে নাসার আর্টেমিস মিশনের চিফ এক্সপ্লোরেশন সায়েন্টিস্ট জেকব ব্লিচারের মতে, মহাকাশচারীদের যথাসম্ভব পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে যেতে হবে যাতে চাঁদের মাটিতে উপস্থিত যাবতীয় প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে চাঁদের মাটিতে বসবাসের ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা না হয়। তিনি আরও জানাচ্ছেন, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে রোবট পাঠানো হচ্ছে, ওই অংশ পর্যবেক্ষণের জন্য। কারণ মহাকাশ-গবেষকদের ধারণা, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে জল আছে। পরবর্তী ধাপে চাঁদে মহাকাশচারীদের পাঠানোর আগে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে জল আছে কি না, নিশ্চিত হতে চান গবেষকরা। তাহলে সেই জল চাঁদের বুকে বসবাসকারী ভবিষ্যৎ মহাকাশচারীরা ব্যবহার করতে পারবেন।
তিনি আরও জানাচ্ছেন, এই অংশে জলের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হলে, পরবর্তীকালে চাঁদে পৌঁছে গবেষণা করা যাবে, সরাসরি চাঁদের মাটিতে চাষ করা যাচ্ছে কি না। কিংবা চাষের উপযুক্ত পরিবেশ চাঁদে আদৌ আছে কি না।
এবার জেনে নেওয়া যাক, কীভাবে চাঁদের মাটিতে গাছ লাগানো হল।
অ্যাপোলো মিশনের সময়ে চাঁদ থেকে মাটির তিনটি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল অ্যাপোলো ১১, ১২ এবং ১৭ মিশনে। সেই মাটিতে অ্যারাবিডপসিস থ্যালিয়ানা নামের একটি গাছের বীজ বোনা হয়। অ্যারাবিডপসিস থ্যালিয়ানা আসলে সরষে, ফুলকপি, বাঁধাকপি কিংবা ব্রকোলিরই আত্মীয়। অ্যারাবিডপসিস বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয় বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে। কারণ এদের জিনের সম্পূর্ণ গঠন বিজ্ঞানীদের নখদর্পণে। ফলে এই গাছটির দেহে কোন পরিস্থিতিতে কী পরিবর্তন আসতে পারে, বা কোন পরিস্থিতিতে এর জিন কীরকম আচরণ করতে পারে, সেই সম্পর্কে সম্যক ধারণা বিজ্ঞানদের আছে। তাই এই গবেষণাতেও অ্যারাবিডপসিস থ্যালিয়ানাই ব্যবহার করা হয়।
প্রতি চারাপিছু মাত্র এক গ্রাম করে রেগোলিথ বরাদ্দ ছিল। গাছ লাগানোর জন্য ব্যবহার করা হত বিশেষ ট্রে, যাতে সিলিন্ডার-আকৃতির খোপ কাটা থাকত। সেই খোপ ভরাট করা হতো এক গ্রাম রেগোলিথ দিয়ে। বীজ বোনার আগে, রেগোলিথে জল মেশাতেন গবেষকরা। তারপর ভেজা রেগোলিথে বীজ দিয়ে, জীবানুমুক্ত ঘরে একটি টেরারিয়াম বাক্সে সেই ট্রে রাখতে হত। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই ধরনের ঘরকে বলে ক্লিন রুম। ক্লিন রুম জীবাণুমুক্ত রাখতে হয় তো বটেই, এখানে ধুলো-বালির প্রবেশ রোধ করার জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
প্রতিদিন সেই মাটিতে পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ তরল বা নিউট্রিয়েন্ট সলিউশন মেশাতেন গবেষকরা। এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত অ্যানা লিসা পল জানাচ্ছেন, বীজ রোপণের দুই দিনের মাথায় অঙ্কুর বেরতে শুরু করে সবক'টি বীজ থেকে। একটি বীজও বাদ যায়নি।
তবে ড. পল জানাচ্ছেন, ষষ্ঠ দিনের মাথায় তাঁরা স্পষ্ট বুঝতে পারেন, রেগোলিথে জন্মানো গাছগুলি বেশ দূর্বল এবং এদের বেড়ে ওঠার ধরণ সম্পূর্ণ আলাদা। শুধু তাই নয়, রেগোলিথে জন্মানো গাছগুলি বাড়ছেও ধীর গতিতে। এদের শিকড়গুলির দৈর্ঘ্যও স্বাভাবিকের থেকে তুলনামূলকভাবে কম। রেগোলিথে জন্মানো কিছু কিছু গাছের পাতায় লাল লাল ছোপও নজরে আসে বিজ্ঞানীদের। স্বাভাবিক অবস্থায় যা কিন্তু দেখা যায় না।
এই গবেষণা আপাতভাবে সফল হলেও, একাধিক প্রশ্নের সামনে আনছে গবেষকদের। যেমন চাঁদের জমিতে জন্মানোর উপযুক্ত হতে গেলে গাছগুলির জিনে কীরকম বিবর্তন ঘটা উচিত, কোন জিনেই বা দরকার সেই পরিবর্তন। চাঁদের বিভিন্ন অঞ্চলের মাটি কি ভিন্ন? চাঁদের মাটিতে ভিন্নতা দেখা গেলে কি গাছগুলির সেখানে বেড়ে ওঠার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে? চাঁদের মাটি সম্পর্কিত গবেষণা কি আমাদের সাহায্য করবে মঙ্গলের মাটি সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে? তার থেকেও বড় কথা, চাঁদের মাটিতে গাছ লাগানো গেলে কি মঙ্গলের মাটিতেও সম্ভব হবে গাছ লাগানো? তারা কি বড় হবে মঙ্গলের মাটিতেও?
আশা করা যায়, খুব শীঘ্রই এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেবে নিকট ভবিষ্যতের গবেষণা।
দিন কুড়ি বাদে যখন প্রতিটি গাছেই ফুল ফুটতে শুরু করে, তখন সেই গাছ থেকে আরএনএ বা রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড সংগ্রহ করেন বিজ্ঞানীরা।
আরএনএ থেকে তৈরি হওয়া প্রোটিনই জানিয়ে দেয় গাছগুলি বিরূপ বৃদ্ধির জন্যে উপযুক্ত যে পরিবেশ, তা তারা পাচ্ছে না। সোজা কথায় রেগোলিথে গাছ জন্মালেও, সুষ্ঠুভাবে গাছের বৃদ্ধির জন্য তারা উপযুক্ত নয়। কারণ হয রেগোলিথে অতিরিক্ত হাতে লবণের উপস্থিতি চোখে পড়েছে, নয়তো ভারী ধাতুর খোঁজ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।