সাদাদের টিটকিরি আর নয়, কৃষ্ণাঙ্গ সেরেনা একাই পালটে দিয়েছেন টেনিস-দুনিয়ার ছবিটা
টেনিস-দর্শকের হৃদয়-সিংহাসনে কায়েমি হয়ে সেরেনা বসে পড়েছেন চিরকালের জন্য।
ভেনাস ততদিনে মোটামুটি নাম করে ফেলেছেন। তাঁর বোনও যে টেনিসটা ভালোই খেলেন, তাও ওয়াকিবহাল মহল খানিক জানে। উইলিয়ামস পরিবারকে ইন্টারভিউ করতে আসা এক ব্রিটিশ সাংবাদিক ভেনাস আর বাবা রিচার্ডকে প্রশ্ন করার এক ফাঁকে এগারো বছরের সেরেনাকে হালকা চালে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "আচ্ছা, তুমিও তো টেনিস খেলো... তা তুমি বড় হয়ে কোন খেলোয়াড়ের মতো হতে চাও?" বিন্দুমাত্র নার্ভাস না হয়ে ছোট ছোট বিনুনিতে বাঁধা চুল নাচিয়ে খুব সপ্রতিভভাবে হাসিমুখে সেরেনা বলেছিল, "আমি এমন কিছু হব, যাতে সব খেলোয়াড়ই আমার মতো হতে চাইবে।"
কী বলা যায় একে? কিশোর বয়সের খোয়াব, না কি নিশ্ছিদ্র প্রতিজ্ঞার থেকে প্রসূত আত্মবিশ্বাস? পরের তিরিশ বছরের ঘটনাক্রম বুঝিয়ে দেবে যে, ওটা আত্মবিশ্বাস। যে আত্মবিশ্বাসে ভর করে সেরেনা উইলিয়ামস মা হওয়ার এক বছরের মধ্যে গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনাল খেলতে নামেন, যে আত্মবিশ্বাসে সেরেনা শেষ সেটের নির্ণায়ক মুহূর্তে মারতে পারেন নিখুঁত এস। সেরেনার সাফল্যের রেসিপিতে এক্স ফ্যাক্টর ওই আত্মবিশ্বাসটাই।
রিচার্ড উইলিয়ামস আর অরাসিন প্রাইস- দু'জনেই তাঁদের দুই মেয়েকে গড়েপিটে নেওয়ার জন্য সর্বস্ব পণ করে নেমেছিলেন। অরাসিন টেনিস শিখেছিলেন মেয়েদের ট্রেনিং দেওয়ার জন্য। তাছাড়া সেরেনা আর ভেনাসের স্নায়ুর কাঠিন্যের পিছনে মূল কারণ অরাসিনের অনুপ্রেরণা। অরাসিন একবার বলেছিলেন যে, প্রেশার বলে আদতে কিছু নেইই, কারণ আমেরিকায় একজন অশ্বেতকায় মানুষ হিসেবে থাকাটাই যেখানে নিরন্তর একটা চাপ, সেখানে ওটা তো জীবনের আরেকটা নামমাত্র। রিচার্ডস উইলিয়ামস খুব রংদার এবং কৌতূহল-উদ্রেককারী চরিত্র। তাঁর জীবনীমূলক সিনেমায় তাঁর ভূমিকায় অভিনয় করে প্রখ্যাত অভিনেতা উইল স্মিথ অস্কার জিতেছেন। টিভিতে ভার্জিনিয়া রুজিচির খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে রিচার্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, মেয়েদের টেনিস খেলোয়াড় করেই ছাড়বেন। পঁচাশি পাতার একটা বিরাট প্ল্যান লিখে নিয়ে তিনি ট্রেনিং শুরু করান। পরে রিক ম্যাসি-র অ্যাকাডেমিতে ঢুকলেও, সেরেনার যখন দশ বছর বয়স, তখন রিচার্ড সেরেনাকে সেই অ্যাকাডেমি থেকে সরিয়ে আনেন। জুনিয়র টুর্নামেন্টের মাঠে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খেলাতেও গ্যালারি থেকে সাদা চামড়ার অনেক বাবা-মায়েদের তরফ থেকে ভেসে আসত বিষাক্ত, বর্ণবাদী টিপ্পনী। তার থেকে মেয়েকে আড়াল করার ব্যাপার তো ছিলই, তাছাড়া জুনিয়র টেনিসের প্রাত্যহিক চাপে যাতে মেয়ের টেনিসের প্রতি ভালবাসা মরে না যায়, এবং কোনওভাবেই যেন বার্ন আউটের সম্ভাবনা না দেখা যায়, তা নিয়েও সচেতন ছিলেন রিচার্ড। যখন সেরেনার জুনিয়র টুর্নামেন্ট খেলা তিনি বন্ধ করেন, তখন রাজ্যের সমস্ত অনূর্ধ্ব-দশ খেলোয়াড়ের তালিকায় সেরেনার র্যাঙ্ক প্রথম। তাক-লাগানো রেকর্ড ছিল তাঁর সেই পর্যায়ের টেনিসে। কিন্তু ১৬ বছর বয়সের আগে সেরেনাকে পেশাদার কোর্টে নামাতে রাজি হবেন না রিচার্ড। স্বামী-স্ত্রী মিলে এই সময়টায় মেয়েদের কোচ করতেন। এই অভিজ্ঞতা তাঁদের কাছে এমন কিছু নতুন নয়। টেনিসের প্রাথমিক ট্রেনিং দেওয়ার পাশাপাশি দুই মেয়েকেই একটা বয়স অবধি হোম স্কুল করেছিলেন উইলিয়ামস দম্পতি।
আরও পড়ুন: শ্রমিকের কান্নায় ভেজা স্টেডিয়ামের মাটি, কাতার বিশ্বকাপ দাসব্যবস্থার স্মৃতি ফেরাবে
টেনিসের যে আভিজাত্যর অভিমান টেনিসকে অন্য সব খেলার থেকে অনেকটা বেশি আত্মগত করে রেখেছে, সেই আভিজাত্যর ফলে সম্ভাবনার পাল্লা তাদের দিকেই ঝুঁকে যায়, যারা অন্ততপক্ষে উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মে ক্লাবে, রিসর্টে বা টেনিস অ্যাকাডেমিতে খেলার সুযোগ পায়। সেরেনা যে চিরাচরিত প্রথা ভাঙতেই এসেছেন, সেটা আরও সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়, বাড়িতে প্র্যাকটিস করে তৈরি ভিতের ওপরে তাঁর এতকালের রাজ্যপাট দেখলে।
অবশ্য বাড়িতে প্র্যাকটিস করে বড় খেলোয়াড় হয়ে ওঠা হতো না, যদি দিদি ভেনাসও অমন অসাধারণ টেনিস প্লেয়ার না হতেন। সেরেনা বারবার বলেছেন যে, তিনি যেটুকু হতে পেরেছেন, তার পিছনে দিদির প্রভাব অনস্বীকার্য। দু'জনে জুটি বেঁধে সতেরো বছরের মধ্যে চোদ্দোটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনাল খেলেছেন। চোদ্দোটাই জিতেছেন। অলিম্পিকের উইমেনস ডাবলস ইভেন্টে এই জুটি জিতেছে তিন-তিনটে সোনার পদক। অচিন্ত্যনীয় সব রেকর্ড!
রেকর্ডের কথা বলতে বসলে অবিশ্যি মহাভারত হয়ে যাবে। ওপেন যুগে সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছেন সেরেনা। তেইশখানা। ডাবলস আর মিক্সড ডাবলস জুড়ে দিলে সেই সংখ্যা পৌঁছে যায় ৩৯-এ। ঊনচল্লিশটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম আরেক খেলোয়াড়েরও ছিল। তিনি একবার একটা ক্লিনিকে গিয়ে সেখানে সেরেনাকে খেলতে দেখেছিলেন। যে সার্ভ নিয়ে তিনি ভবিষ্যতে নিঃসন্দেহ হয়ে বলবেন যে, সেরেনার করা সার্ভ ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ, সেই সার্ভের একটি সম্ভাবনাময় ঝলক তাঁর চোখে পড়েছিল। ছ'বছরের বাচ্চা মেয়েটা যে একদিন রীতিমত নাম করবে, সেটা তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন। সেই বিশ্ববিনন্দিত টেনিস খেলোয়াড়ের নাম বিলি জিন কিং।
বিলি জিন কিং এক হিসেবে সেরেনার সুযোগ্য পূর্বসূরি। বিলি জিন কিংয়ের আগে কোনও তারকা খেলোয়াড় নিজের সমকামী পরিচিতিকে প্রকাশ্যে এনেছেন, এমনটা জানা যায় না। পোশাক-আশাকে রক্ষণশীল নিয়মকানুনগুলো খণ্ডবিখণ্ড করার পাশাপাশি কিং দাবি করেছেন, খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিকে লিঙ্গসাম্য। সেরেনা আওয়াজ তুলেছেন অশ্বেতকায় মহিলাদের জন্য আমেরিকায় মাতৃত্বকালীন পরিষেবার দুরবস্থা নিয়ে। আওয়াজ তুলেছেন ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার্সের স্বপক্ষেও। নারীবাদী হিসেবে অনেক ইস্যুতেই তাঁকে মুখর হতে দেখেছি আমরা। পোশাক নিয়ে তাঁকেও কম হয়রান হতে হয়নি। খেলার সময়ে রক্ত জমাট যাতে না বাঁধে, সেই কথা ভেবে বিশেষভাবে তৈরি ক্যাটস্যুট পরে সেরেনাকে ফ্রেঞ্চ ওপেনে নামতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ। সেই পোশাককে অসম্মানসূচক বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এসব অপমান নেহাতই ছোটখাটো মনে হয়, যখন খেয়াল হয় যে, কুড়ি বছরের সেরেনাকে ইন্ডিয়ান ওয়েলসের কোর্টে যাচ্ছেতাইভাবে বর্ণবিদ্বেষী অপমান করেন দর্শকরা। চোদ্দো বছর ইন্ডিয়ান ওয়েলসে খেলতে নামেননি সেরেনা। সেরেনার চুলের কায়দা আর তাঁর পেশিবহুল শরীর আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে বারংবার। তাঁর খেলাকে নামিয়ে আনা হয়েছে আসুরিক শক্তির জয়ের ন্যারেটিভে। যত অপমান ধেয়ে এসেছে, যত বৈষম্য তাড়া করেছে, ততই সেরেনা নিজের জাতিসত্তার সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন। তাঁর দেহসৌষ্ঠব সম্বন্ধে আরও বেশি প্রত্যয়ী হয়েছেন।
মেয়েদের পাওয়ার-টেনিসে বিপ্লব এনে দেওয়া সেরেনা কিন্তু নিছকই প্রচণ্ড বলশালী একজন মেশিন নন। বেসলাইন ধরে তাঁর আগ্রাসী এবং হাই রিস্ক খেলার স্টাইল, কোর্ট কভার করায় তাঁর ক্ষিপ্রতা, প্রচণ্ড জোরালো ফোরহ্যান্ড আর শরীরী ভারসাম্য সুচারুভাবে ব্যবহার করে হিট করা ব্যাকহ্যান্ডের মার যে-কোনও সুরসিকের প্রশংসা আকর্ষন করে নেবে। তবে আলাদা করে আলোচনার দাবি রাখে সেরেনার সার্ভ। পোয়েট্রি ইন মোশন কথাটা বহু ব্যবহারে জীর্ণ, কিন্তু একবার একটু ঝুঁকে তারপর বলটা আকাশে ছুড়ে শরীরটা ধনুকের ছিলার মতো টানটান করে নিয়ে, তারপর ছন্দোবদ্ধ নির্ভুলতায় র্যাকেটের সুনিশ্চিত লক্ষ্যভেদী মারে বলটাকে উল্টোদিকে পাঠাতে যাঁরা দেখেছেন সেরেনাকে, তাঁরা 'পোয়েট্রি ইন মোশন' কথাটায় আপত্তি করবেন না বোধহয়। সেই সার্ভে শিং উঁচিয়ে ছুটন্ত ষাঁড়ের শক্তির চাইতেও আমার চোখে বেশি পড়তো ওঁৎ পেতে থাকা বাঘের শিকার ধরার লাফের অবশ্যম্ভাবিতা।
এই সার্ভ সেরেনাকে ম্যাচে তফাৎ গড়ে দিতে সাহায্য করেছে বহুবার। বিশ্বের এক নম্বরকে হারিয়ে নিজের পহেলা গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতা থেকে শুরু করে দু'বার ক্যালেন্ডার স্ল্যাম নিশ্চিত করা বা হিঙ্গিস-ক্যাপ্রিয়াটি-শারাপোভা-হেনিন-আজারেঙ্কার মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের সফলভাবে মহড়া নেওয়া, সর্বত্রই এই সার্ভ সেরেনার অস্ত্রাগারের মহামূল্যবান আয়ুধ। তবে খেলোয়াড়ি স্কিল সেটের চাইতে সেই অস্ত্রাগারে বেশি গুরুত্ব চিরকাল পেয়ে এসেছে মনস্তাত্ত্বিক নানা প্রস্তুতি। তার মধ্যে অন্যতম সেরেনার অটল আত্মপ্রত্যয় আর দুর্জয় সাহস।
যে সাহস নিয়ে সেরেনা ম্যাচ পয়েন্টের মুখোমুখি হয়েও কোর্টের কোণ ঘেঁষে পাঠিয়েছেন একেকটা বিষধর রিটার্ন, তার চাইতেও ঢের বেশি সাহস দেখিয়ে সেরেনা আলিঙ্গন করেছেন মাতৃত্বকে। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কুড়ি সপ্তাহ পরও জিতেছেন অস্ট্রেলিয়ান ওপেন। সন্তানের জন্মের সময়ে মা এবং মেয়ে, দু'জনেরই শারীরিক নানান অসুবিধে হয়েছিল। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে পালমোনারি এম্বলিজম বলে, তার ধাক্কায় দেড়মাস শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল সেরেনাকে। এরপরে তাঁকে চেপে ধরে মানসিক নৈরাশ্য এবং হতাশা, যাকে বলা হয় পোস্টপার্টাম ডিপ্রেসন। তবু সেসব জয় করে সন্তানজন্মের দশ মাসের ভেতর সেরেনা উইম্বলডনের ফাইনালে উঠেছিলেন। অ্যাঞ্জেলিক কার্বেরকে হারাতে না পারলেও, একটা অ-সেরেনাসুলভ রেকর্ড তাঁর হস্তগত হয়। অনেকদিন খেলার থেকে দূরে থাকায় তাঁর র্যাঙ্কিং দাঁড়িয়েছিল ১৮১। তিনি এই টুর্নামেন্টে হয়ে ওঠেন উইম্বলডনের শেষ চারে ওঠা ইতিহাসের সবচেয়ে লো-র্যাঙ্কড খেলোয়াড়।
এর পরের বছর হাঁটুর চোট কাটিয়ে উঠে ৩৮ বছরের সেরেনা ওপেন যুগের সবচেয়ে বয়স্ক ফাইনালিস্ট হিসেবে উইম্বলডনের ফাইনাল খেলতে নামেন। কিন্তু এবার তাঁকে সিমোনা হালেপ একপেশেভাবে হারিয়ে দ্যান। তেইশটা গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালকিনের চোখের সামনে ছিল চব্বিশতম খেতাব জিতে মার্গারেট কোর্টকে ছুঁয়ে ফেলার অচিন্ত্যনীয় স্বপ্ন সফল করার হাতছানি। সেই আলেয়ার পিছু ছোটা ছেড়ে দিতে তাঁর সময় লেগেছে। খেলার ধার কমে গেছে এর মধ্যে। অবসর শব্দটা সেরেনার অপছন্দ। আর তাই ভগ-এর ইন্টারভিউতে তিনি বলেছেন যে তিনি টেনিসের মায়া কাটিয়ে জীবনের স্বাভাবিক বিবর্তন মেনেই তিনি এগিয়ে যেতে চাইছেন। পরিবারের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার, আরেকবার মা হওয়ার ইচ্ছে ধীরে ধীরে সেরেনাকে ঢের বেশি চিন্তামুক্ত একটা জীবনের দিকে টেনেছে। সেরেনা সেই টান অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু চল্লিশ পেরনোর পর তাঁর শরীর এবং রিফ্লেক্স বিদ্রোহ করেছে। আগের সেরেনার ছায়াকে যাঁরা কোভিড-পরবর্তী টুর্নামেন্টগুলোতে দেখেছেন, তাঁরা সবাই চাইছিলেন, শেষটা যেন সুষমামণ্ডিত এবং মর্যাদাব্যঞ্জক হয়। আঘাত পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে যেভাবে সাধের উইম্বলডন ছেড়ে যেতে হয়েছিল, সেভাবে যেন নিজের শেষ ম্যাচে না বেরোতে হয়। মাথা উঁচু করেই টেনিসকে বিদায় জানান সম্রাজ্ঞী, সবাই সেটাই চেয়েছিল।
সেটা পেরেছেন সেরেনা। দু'নম্বর বাছাইকে হারিয়ে উঠে তমলিয়ানোভিচের বিরুদ্ধে তৃতীয় রাউন্ডে পরাভূত হন সেরেনা, কিন্তু লড়াই কাকে বলে ফের একবার দেখিয়ে গিয়ে, তবেই ময়দান ছেড়েছেন তিনি। একটা ম্যাচ পয়েন্ট যখন ফোরহ্যান্ডের উইনারে বাঁচালেন সেরেনা, ভরা আর্থার অ্যাশ একযোগে সুর করে চিৎকার করছিল "নট ইয়েট! নট ইয়েট!" থার্ড সেটে ৫-১এ এগিয়ে গেছিলেন তমলিয়ানোভিচ। গেমটা জিতছিলেন ৪০-৩০-এ। সেই অবস্থায় তিনি সার্ভ করতে শুরু করার পর একাদিক্রমে ম্যাচ পয়েন্ট বাঁচিয়ে যাচ্ছিলেন সেরেনা। একটা-দুটো-তিনটে-চারটে... ষষ্ঠ গেমটা তিনি কিছুতেই জিততে দেবেন না তাঁর তরুণ প্রতিদ্বন্দ্বীকে। কিন্তু অবশেষে তিন ঘণ্টার যুদ্ধের শেষে তাকে গ্রাস করে নিল ক্লান্তি। লম্বা লম্বা র্যালি আর ন'খানা ডিউজের এই যুদ্ধে জিতে গেলেন তমলিয়ানোভিচ। জেতার পর আনন্দে মাততে পারেননি তিনি। সেরেনা টুর্নামেন্ট চলাকালীনই বলেছিলেন যে নিজের কাঁধের থেকে সেই বিরাট ওজনটা সরিয়ে দিয়ে, প্রত্যাশার চাপ থেকে নিজেকে পুরোপুরি মুক্তি দিয়ে এই টুর্নামেন্টটা তিনি খেলছেন টেনিসেকে স্রেফ উপভোগ করার জন্যেই। আর তাই জিতেছেন তিনিই। শ্রদ্ধা আর শুভেচ্ছাবার্তায় মাখামাখি সেরেনার কাছে ম্যাচ হারাটা আর কোনও ব্যাপারই নয়। দর্শকের হৃদয়-সিংহাসনে কায়েমি হয়ে তিনি বসে পড়েছেন চিরকালের জন্য।
সহজ ছিল না এই সিংহাসন জিতে নেওয়া। টেনিসের নাক উঁচু বনেদি দুনিয়ায় তিনি প্রথম থেকেই এক বহিরাগতর মতো। তাঁর সুঠাম পেশির বজ্রকাঠিন্যর কারণে আর চিরাচরিত সৌন্দর্যর মাপকাঠিতে না আঁটার দুঃসাহসের কারণে মিডিয়া তাঁকে সুনজরে দেখেনি প্রথমে। আদৌ কতটা 'বিপনণযোগ্য' তিনি, সেই নিয়ে কানাঘুষো চলেছে বাণিজ্যিক দুনিয়ায়। সেইখান থেকে লড়ে সেরেনা হয়ে উঠেছেন সবচেয়ে ধনী মহিলা ক্রীড়াবিদ। বড় বড় ব্র্যান্ড তাঁকে দিয়েছে অচিন্ত্যনীয় সব ডিল। এর আগে জিনা গ্যারিসনের মতো অ্যাফ্রো-আমেরিকানকে দেখেছে টেনিস-বিশ্ব। তিনিও বহিরাগত ছিলেন, কিন্তু লড়াই করেও শেষ অবধি তাই রয়ে গিয়েছিলেন। সেরেনা মূল স্রোতকে খালি চ্যালেঞ্জই করেননি, সেটার গতিপথ আমূল পাল্টে দিয়েছেন। ঠিক করে দেওয়া রীতি-নীতির বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে অ্যান্টি-হিরো হয়েছেন। রেফারির সঙ্গে ঝগড়া করেছেন, আগ্রাসন দেখিয়েছেন, পুরুষ খেলোয়াড়দের ব্যাড বয় ইমেজ পূজিত হয়, অথচ নারী খেলোয়াড়েরা সেটাই করলে সমালোচিত হন- এই ভন্ডামি সকলের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে সেজেছেন টেনিসের একমাত্র ব্যাড গার্ল। বার্বির পুতুলের মতো দেখতে খেলোয়াড়দেরই শুধু আদিখ্যেতা করে টেনিস-সুন্দরী বলে ডাকে যে মিডিয়া, সেই মিডিয়াকে তাঁর সামনে প্রণত হতে বাধ্য করেছেন একমেবদ্বিতীয়ম সেরেনা উইলিয়ামস। আর তাই প্রচলিত রীতি-নীতির বিরোধিতা করাতেই সীমাবদ্ধ নয় রেবেল সেরেনার প্রতিবাদ, তিনি দুনিয়াকে দস্তুরমতো বাধ্য করেছেন তাঁর প্রবর্তিত নিয়ম মেনে নিতে। প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার উর্ধ্বে উঠে তিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। বিশুদ্ধবাদীরা নাহয় তুলাদণ্ড বাগিয়ে মাপতে বসুন, কে সর্বশ্রেষ্ঠ। স্বপ্নের কাঙাল নাওমি ওসাকারা জানেন, কে আসলে মূর্তিমতী প্রেরণা!