খলনায়ক হয়েও পূজিত! এই দেশেই রয়েছে শকুনির মন্দির! কোথায়?

Shakuni Temple of Kerala: এই মন্দিরে স্থাপিত রয়েছে একটি গ্রানাইট। শকুনি এই গ্রানাইট শিলাকেই তাঁর তপস্যার জন্য ব্যবহার করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়।

তিনি না চাইলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হতো না। তিনি না চাইলেই সারা ভারত ভাইয়ে-ভাইয়ে খাওয়াখাওয়ি না দেখে মনে রাখত সৌভ্রাতৃত্বের আখ্যান। পাণ্ডব আর কৌরবদের মধ্যেকার এই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের নেপথ্যে যিনি রয়েছেন, সন্দেহ আর ঘৃণার বীজ হয়ে বেঁচে রয়েছেন তিনি ভারতের মহাকাব্যিক দর্শনে। রয়েছেন নেতিবাচকতার এক মূর্ত প্রতীক হয়ে। কিন্তু ভারতবর্ষ তো বিচিত্র দেশ, এখানে ঈশ্বরের সঙ্গেই পূজিত অসুর। অসুরকে খলনায়ক নয়, বরং অভিজাত বর্ণের নিপীড়নের শিকার হিসেবে দেখা হয়েছে, কোথাও আবার অসুরের পাণ্ডিত্য পূজিত হয়েছে। মহাকাব্য কে লিখছেন, তাঁর দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে নিরন্তর। তাই এই ভারতেই পূজিত হয় শকুনি মামাও! হ্যাঁ, মহাভারতের অন্যতম বিতর্কিত খলনায়কের মন্দির রয়েছে দেশে। 

কেরলে এমন একটি মন্দির রয়েছে যা মহাভারতের 'দুষ্ট' চরিত্র শকুনির স্মৃতিতে নির্মিত। অবাক হলেও এর নেপথ্যে রয়েছে বিশ্বাসীদের যুক্তি! খলনায়ক পুজোর এমন উদাহরণ সম্ভবত শুধুমাত্র ভারতেই খুঁজে পাওয়া যায়। শকুনির মন্দির স্থাপনের পিছনে তাই থাকে নির্দিষ্ট কারণ। লোককথা অনুসারে, শকুনি শিবকে খুশি করার জন্য এই স্থানেই তপস্যা করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে মোক্ষ লাভ করেছিলেন।

কেরালের কোল্লাম জেলার কোত্তারাক্কার কাছে পবিত্রেশ্বরমের (আগে পাকুথেশ্বরম নামে পরিচিত) মায়ামকোট্টু মালাঞ্চরুভু মালানাড় মন্দিরটি শকুনির মন্দির। কেরলকে বলা হয় 'ঈশ্বরের নিজস্ব দেশ'। সেই ঈশ্বরের দেশে 'অশুভ'-এর পুজো, শকুনিকে উৎসর্গ করে আস্ত এক মন্দির! কী আছে এই মন্দিরের অন্দরে?

আরও পড়ুন- কৌরবদের জব্দ করতেই পাশা খেলা! শকুনির সঙ্গে মর্মান্তিক অবিচারের যে কাহিনি অজানাই

এই মন্দিরে স্থাপিত রয়েছে একটি গ্রানাইট। শকুনি এই গ্রানাইট শিলাকেই তাঁর তপস্যার জন্য ব্যবহার করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়। লোকমুখে শোনা কাহিনি বলছে, কৌরবরা এই স্থানে তাদের অস্ত্র নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিলেন। পাণ্ডবদের খোঁজে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়ে কৌরব ভাইয়েরা এখানেই নাকি আশ্রয় নিয়েছিল।

তবে এখানেই শেষ না। গল্পে রয়েছে অন্য ট্যুইস্ট! স্থানীয় একটি সম্প্রদায়ের মানুষদের এক আশ্চর্য বিশ্বাস হলো, তারা নাকি কৌরবদের বংশধর! তাই মামা শকুনির দৃঢ়সংকল্প, অধ্যবসায় এবং তাঁর লক্ষ্যের প্রতি অবিচল আবেগের পুজো করেন সেই সম্প্রদায়ের মানুষ।

শকুনি ছিলেন গান্ধারের (অধুনা আফগানিস্তানের একটি স্থান) যুবরাজ। তাঁর বোন গান্ধারী। হস্তিনাপুরের দৃষ্টিহীন রাজপুত্র ধৃতরাষ্ট্রের কাছ থেকে তাঁর বোন গান্ধারীর জন্য যে বিয়ের প্রস্তাব আসে, সেই বিষয়ে মোটেই রাজি ছিলেন না শকুনি। তবে গান্ধারী মনে করলেন, এমন প্রস্তাব তো আশীর্বাদসম! আরও বিরক্ত হলেন শকুনি। বিয়ে অবধি তো ঠিক ছিল, গান্ধারী ঠিক করলেন ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্বকে স্বীকার করে তিনিও আজীবন চোখ বেঁধে রইবেন। এই সিদ্ধান্তে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন শকুনি। বোনের সঙ্গে চলে যান হস্তিনাপুরে।

শকুনি মনে করতেন তাঁর বোনের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। সেই অন্যায়কে একটিই উপায়ে সামাল দেওয়া সম্ভব, গান্ধারীপুত্র দুর্যোধনকে হস্তিনাপুরের রাজা করতে চেয়েছিলেন শকুনি। দুর্যোধনের পক্ষে সিংহাসন রক্ষা করা সহজ নয় বুঝেই তিনি তাঁকে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে উস্কানি দেন। ধীরে ধীরে, পাণ্ডবদের প্রতি দুর্যোধনের অপছন্দ ঘৃণায় পর্যবসিত হয়, ঘৃণা থেকে জন্ম নেয় প্রতিশোধ! ফলাফল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। কিংবদন্তি অনুসারে, শকুনি যুদ্ধক্ষেত্রে পাণ্ডব সহদেবের হাতে নিহত হন। উপরে উল্লিখিত স্থানে শকুনি আদৌ মোক্ষ লাভ করেছিলেন কিনা তা অবশ্যই বিতর্কের বিষয়। তবে শকুনির নেপথ্যে রয়েছে আরেকটি গল্প। 

আরও পড়ুন- মহাভারতের ‘ঘৃণ্য’ চরিত্র পূজিত হন ভারতে! দুর্যোধন মন্দিরের যে কাহিনি অবাক করবেই

পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে আসলে শকুনির কোনও বিদ্বেষ ছিল না, শকুনির প্রধান শত্রু ছিলেন ভীষ্ম। গান্ধারীর বিয়ের অনেক পরে নাকি ভীষ্ম জানতে পারেন গান্ধারী বিয়ের আগে বিধবা ছিলেন। জানা যায়, গান্ধার রাজ সুবলকে রাজজ্যোতিষী বলেছিলেন, গান্ধারীর প্রথম পতির আয়ু সীমিত, কিন্তু দ্বিতীয় পতির আয়ু বেশি হবে। তাই একটি ছাগলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে সেই দোষ স্খলন করেছিলেন সুবল। ছাগলটি কিছু পরেই মারা যায়। তার কিছুকাল পরেই ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে গান্ধারীর বিবাহ প্রস্তাব নিয়ে গান্ধার রাজ্যে যান। 

এই কথা পরে জানতে পেরে ভীষ্ম প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন। ভীষ্ম শকুনির পরিবারকে ভোজনের আমন্ত্রণ জানিয়েও সামান্য খাবার দিয়ে বন্দি করে রেখে দেন। রাজা সুবল সিদ্ধান্ত নেন ভীষ্মের এই আচরণের জন্য কুরু পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতেই হবে। তাই তাঁর পরিবারের একজন সদস্যকে যে কোনও মূল্যে বাঁচতেই হবে। তাই কনিষ্ঠ এবং চতুর পুত্র শকুনিকেই সবার খাবার দিয়ে দেওয়া হয় যাতে তিনি বেঁচে থাকেন এবং প্রতিশোধ নিতে পারেন। সুবল রাজাই মৃত্যুর আগে শকুনির পায়ে ছুরিকাঘাত করেন। বলেন, আজীবন শকুনি খুঁড়িয়ে হাঁটবেন আর প্রতিবার তাঁর মনে পড়বে কৌরবদের অন্যায়ের কথা। তাই শকুনির এই আচরণের কারণ ও যুক্তি সহজেই বিশ্লেষণ করা যায়।

মন্দিরে শকুনিকে উৎসর্গ করে একটি স্মারক রয়েছে। স্মারক একটি সত্যের প্রতিরূপ। যে কোনও মানুষের মধ্যেই ভালো এবং মন্দ দুই-ই আছে। তাঁর আদর্শই ঠিক করে, তারা পূজিত হবেন কিনা।

More Articles