উইক এন্ড ট্যুর আর সস্তার হস্তশিল্প : যেভাবে বাঁচে সাধের সোনাঝুরি...

Shantiniketan Handicrafts : নব্যভদ্রবিত্তের উইক এন্ড ট্যুর, তার সস্তার সাজপোশাক, উল্লাসের আয়োজন মেটাতে অ্যাডাম স্মিথের তত্ত্ব লাগে না, লাগে সরকারি সিলমোহর।

SG

অর্থনীতির জনক অ্যাডাম স্মিথ তাঁর লেখা An enquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations (1776) গ্রন্থে মুক্ত বাজার অর্থনীতির সপক্ষে সওয়াল করেছিলেন এইভাবে- কখন একজন কসাই, একজন শুঁড়ি বা একজন রুটি প্রস্তুতকারী দয়া করে আমাদের মাংস-মদ-রুটির জোগান দেবেন সেই আশায় আমরা নৈশভোজের টেবিলে অপেক্ষা করি না। আমরা বলি, তারা নিজেদের সুখের স্বার্থেই আমাদের টেবিলে খাবারের জোগান অব্যাহত রাখবেন। তাদের সামাজিক অবদানের দিকে আমরা নজর দিই না, বরং এতে তাদের কতটা উপকার হচ্ছে আমরা সেই দিকটা তুলে ধরি; আমাদের চাহিদার কথা গোপন রেখে আলোকপাত করি তাদের প্রয়োজনের উপরে।

বড়বাজার, পার্কস্ট্রিট, চাঁদনিচক গিয়েও আমাদের সাধ মেটেনি। আমরা অন্যরকম বাজার খুঁজতে খুঁজতে একদিন খোঁজ পেয়েছিলাম শান্তিনিকেতনের সাংবাৎসরিক পৌষ উৎসবের। কয়েক দশকেই ভিড় বাড়তে বাড়তে উৎসব হয়ে উঠল আবার বড়বাজার। সেই বড়বাজারেও যেদিন স্থানসংকুলান হলো না, মানুষ ছুটে গেল তিলে তিলে গড়ে তোলা শনিবারের হাটে। তার ইউএসপি-টুকু গিলে খেয়ে তার নির্জনতা, তার মেজাজ আর প্রাকৃতিক গাম্ভীর্যের তোয়াক্কা না করে জঙ্গল কেটে খোয়াইয়ের বুকে কংক্রিটের দেওয়াল তুলে, মাটি লেপে ঢালাই ছাদের উপর চাপানো হলো খড়ের ছাউনি। শ্যামবাটি ক্যানেল থেকে বাঁদিকে চলে যাওয়া লাল মাটির সরান মুড়ে দেওয়া হল পিচে। যে হাটে বসতেন ফুলডাঙা বনেরপুকুরডাঙা বা বড়জোর বোলপুর শ্যামবাটির স্থানীয় শিল্পীরা সেখানে আজ নানুর ইলামবাজার থেকেও গাড়ি হাঁকিয়ে চলে আসেন ব্যবসায়ীরা। কলকাতার মহাজনের লগ্নি আছে অনেক দোকানেই। আজ নতুন পুরাতন সব মিলিয়ে পাঁচটা হাট এক সারিতে। অতএব প্রতি সপ্তাহেই পৌষমেলার আয়োজন, শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চটুকু নেই। বাউল, সাঁওতালি নাচ, বীজের গয়না, নকশি কাঁথা, কাঁথা স্টিচের শাড়ি, ঢেঁকি ছাঁটা চাল, মাটির বাসনপত্র, ডোকরা, বাটিকের চাদর, কাঠের কাজ, খেস, অ্যাপ্লিকের কাজ পাওয়া যায় নগদ অর্থের বিনিময়ে।

আরও পড়ুন- রবীন্দ্র-ভক্তরা তাড়াতে চেয়েছিল শান্তিনিকেতন থেকে, বলেছিলেন রামকিঙ্কর

এই নগদ অর্থের কতটুকু পৌঁছয় শ্রমিকের কাছে তাই নিয়ে কয়েক ডজন গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখা হয়ে গেছে। সেই লেখার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ‘ওমেন এম্পাওয়ারমেন্ট’, ‘স্বনির্ভরগোষ্ঠী’, ‘স্মলস্কেল ইন্ডাস্ট্রি’, ‘মুসলিম মহিলা’ ইত্যাদি শব্দবন্ধগুলি। এর একমাত্র কারণ গত দুই দশকে পশ্চিমবঙ্গে যে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান হয়েছে তাদের আকাঙ্খাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। সহস্রাব্দ ডিঙিয়ে আসা নব্যভদ্রবিত্তের আকাঙ্খায় বিশ্বভারতী জায়গা করে নিতে পারেনি তার নিজের অহংকারেই। বা বলা যায়, তাকে জনগণের থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার একটা চোরাস্রোত চলেছে ক্রমাগত। দুইয়ের টানাপড়েনে রবীন্দ্রনাথ-বিশ্বভারতী বিমুখ ট্যুরিস্টদের কেনাকাটার মতো চটজলদি আনন্দের চাহিদা অল্প দামে জোগান দিতেই এই শনিবারের হাটের বিপুল আয়োজন। স্থানীয় কর্মকর্তাদের সাপ্তাহিক কুড়ি টাকা দিয়ে প্রায় পাঁচশোর বেশি অস্থায়ী দোকান নিয়মিত বসে থাকে এখানে। গণেশ পণ্ডিত একজন মৃৎশিল্পী। শনিবারের হাটের এই পরিবর্তন দেখেছেন নিজের চোখের সামনে। আদি হাট একেবারে পিছনে থেকে যাওয়ায় ক্রেতাদের খুব সামান্য কয়েকজন পৌঁছতে পারেন ভিড় ঠেলে। হাট বেড়েছে। অতিরিক্ত লাভ কিছু হয়নি তাঁর। আবার আলপনা শিল্পী রবি বিশ্বাসের বিক্রি বেড়েছে আগের চেয়ে। বর্ধিত হাটের একজন নিয়মিত বিক্রেতা তিনি। পৌষ মেলায় বিক্রির বিষয়ে দু'জনেই একমত, সে মেলার রুচিশীল ক্রেতাই অনেকটা ভরসা জোগাত শিল্পীদের। বিকল্প পৌষমেলাকে আর পাঁচটা বড় মেলার মতোই দেখেন দু'জনে।

ট্যুরিস্টদের কাছে বোলপুর শান্তিনিকেতনের হাতের কাজের চাহিদা নতুন নয়। চাহিদা অনুযায়ী শুধু কাঁথা স্টিচ আর সেলাইয়ের কাজের জোগান দিতে স্থানীয় ইলামবাজার, লাভপুর, নানুর, মঙ্গলকোটের হাজার মহিলা কাজ করে চলেন সারা বছর। গত তিরিশ বছর সারাদিনের কাজের শেষে কাঁথা স্টিচের কাজ করছেন নানুর থানার ডোংরা গ্রামের বাসন্তী পাল। জানেন এগুফোঁড়, চেন সেলাই, ভাতগুটি, কাটা, চেলির কাজ। একটা শাড়ি কাঁথা স্টিচের কাজে ভরাতে সময় লাগে প্রায় তিনমাস। চুড়িদার লাগে এক সপ্তাহ। পনের দিন অন্তর বারোটা ব্লাউজ জমা দিতে পারেন এখনও। স্বামী রানসেলাই দিয়ে দেন, সুতো রেডি করে দেন। তিনি ভরাট করেন। বাসন্তীদি জানালেন, ‘কাপড় ডিজাইন সুতো সব মহাজনের। আগে একটা শাড়ি বুনলে বারোশো টাকা বাণী দিত। এখন কমে হয়েছে আটশো টাকা। ব্লাউজ পিসে দেয় কুড়ি টাকা। চুড়িদার বুনলে পাই ষাট টাকা। চাদর বুনলে পাই একশো পনের টাকা। আমার মাসে ইনকাম বলতে গড়ে পাঁচশো টাকা। বাণী কমে গেছে এখন। কারণ অনেকেই চলে এসেছে এই কাজে। আমি না করলে অন্যজনা করবে।’

আরও পড়ুন- শরৎচন্দ্র থেকে গান্ধীজি, সকলেই শিকার হয়েছিলেন রসিকতার, আসলে কেমন মানুষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ?

ডোংরা গ্রামের প্রতিবেশী গ্রাম বড়া। এই গ্রামের সান্ত্বনা বৈরাগ্য গ্রামের হাইস্কুলে ভোকেশনাল কোর্সে শিখেছিলেন সেলাই বুননের কাজ। লকডাউনের কঠিন সময় কোনওমতে পেরিয়েছেন, স্বামী সন্ধান দিলেন নতুন কাজের। মুলুক কলোনিতে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল ব্যাগ সেলাইয়ের কাজে লোক নেওয়া হচ্ছে। সেই ঠিকানায় যোগাযোগ করে বছর আড়াই আগে কাজ শুরু করলেন। মেশিন নিজের। ছিট, সুতা, চামড়া, প্যারাসুট কাপড় মহাজনের। ‘একটা ব্যাগ সেলাই করে আমি পাই পাঁচ টাকা থেকে বারো টাকা। প্রচুর পরিশ্রম। এক এক সপ্তায় পাঁচশো-ছশো ব্যাগ করতে হয়। আমার স্বামী মেয়ে দু'জনেই আমায় সাহায্য করে। মাসে আট থেকে দশ হাজার টাকা হয়। নিজেরা যে ব্যবসা শুরু করব সেই মূলধন নেই। তবে ইচ্ছা আছে। আমরা প্রায় পঁচিশ জন আছি এক মহাজনের কাছে। আমাদের কাজ শুধু বোলপুর নয়, চলে যায় দিঘা, মুর্শিদাবাদ, বিষ্ণুপুর পর্যন্ত।’ নানুর থানার কুলিয়া তন্তুবায় সমিতির প্রতিষ্ঠাতা আফরুন্নেসা বেগম এই কাজে যুক্ত আছেন চার দশক। সংসারের হাল ফেরাতে নটকনা, বিড়ি বাঁধা, বিড়ির ব্যবসা করেও যখন হাল ফেরাতে পারলেন না শুরু করলেন কাঁথা স্টিচের কাজ। আজ তাঁর সমিতি এবং খাদি গ্রামোদ্যোগ একযোগে প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনা করেন। এই আবাসিক ট্রেনিং সেন্টারে স্থানীয় এলাকার মেয়েদের অনেকেই কাজ শিখে স্বনির্ভর হয়েছেন। ‘আমি নিজেও একদিন বাইক চালিয়ে মেয়েদের কাজ নিয়ে হাটে গিয়েছি। এখন আর বয়সের কারণে পারি না। মেলায় যায় আমার লোকেরা। এই কাজটা করে অনেকেই সংসার চালায়। ছেলে মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালায়। এই অফিসের জমিটা আমি কিনে খাদিকে দিয়েছিলাম। খাদি এখানে অফিস বানিয়ে দিয়েছে। নিচে আমাদের একটা দোকানও আছে। এখন আর পৌষ মেলার অপেক্ষায় আমরা থাকি না। আমাদের কলকাতা, দিল্লি, হায়দরাবাদ আমেরিকা সব জায়গায় যায়। সব ফোনে অর্ডার দিয়ে দেয়।’ আনন্দে চোখের কোণায় জল চিকচিক করে দিদির।

ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প দপ্তরের কল্যাণে বোলপুর শান্তিনিকেতনে এখন অনেকগুলি হাট। ‘বিশ্ব বাংলা হাট’, ‘গীতবিতান’, ‘কর্মতীর্থ’— গ্রামীণ হস্তশিল্পীদের অনেকেই সেখানে জায়গা পেয়েছেন। জায়গা দেওয়া হয়েছে সোনাঝুরির জঙ্গলকে কলুষমুক্ত করতে। কিন্তু পরিস্থিতির বদল হয়নি। দূরত্ব ও পরিবেশের কারণেই ক্রেতারা মুখ ফিরিয়েছেন সেসব হাট থেকে। একদিনের বোলপুর ভ্রমণে এসে কেনই বা শহুরে সেটিং দেখতে যাওয়া! সেখানে জঙ্গল কোথায়, গ্রাম কোথায়, চাঁদনি রাতে হুল্লোড়ে মাতার মতো জ্যোৎস্না কোথায়? বদল হয়নি স্বল্পমূল্যে শ্রম কেনাবেচাও। বছর তিনেক আগে সোনাঝুরি হাট বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে একটা সভা হয়েছিল, হাটের ভিড়ের অত্যাচারে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ, নষ্ট হচ্ছে সাঁওতালদের সংস্কৃতি, ছোট ছেলেমেয়েদের দেখা গেছে শহুরে বাবুদের কাছে ভিক্ষা চাইতে। যে রাজনৈতিক দাদার ছত্রছায়ায় কেউ হাটে নতুন চট পেতে বসে সে বুঝি তোয়াক্কা করে এসবের? লোভ আর লাভ এই নিয়েই তো মুক্ত বাজার অর্থনীতি। হাটেও তাই ক্রমাগত প্রচার চলে উন্নয়নের নামে। নব্যভদ্রবিত্তের উইক এন্ড ট্যুর, তার সস্তার সাজপোশাক, উল্লাসের আয়োজন মেটাতে অ্যাডাম স্মিথের তত্ত্ব লাগে না, লাগে সরকারি সিলমোহর। পুলিশি প্রহরা, স্ট্রিট লাইট আর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে মুড়ে দিয়ে চালু থাকে এই শীত গ্রীষ্মের পৌষ মেলা।

More Articles