যুদ্ধ কেড়েছে ঘর, সন্তানদের দূরে পাঠিয়ে গাজায় জেগে একা সাংবাদিক

Gaza-Israel Conflict: খাওলা আল-খলিদি, গাজার আরও অনেক সাংবাদিকের মতোই ঠাঁই নিয়েছে আল আকসা শহীদ হাসপাতালে। আপাতত ওই হাসপাতালই হয়ে উঠেছে তাঁদের অস্থায়ী ব্যুরো।

চাকরির প্রয়োজনে পরিবারের থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হন অনেকেই। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে, যেখানে পরিবারের হাত ধরে দেশ ছাড়তে চাইছেন সবাই, সেখানে পরিবারকে ছেড়ে, প্রিয় সন্তান-স্বজনকে ছেড়ে শুধু কাজের জন্য গুলিবোমা বন্দুকের মুখে দাঁড়িয়ে থাকার লড়াইটা ঠিক কেমন? বিশেষত সেই যুদ্ধক্ষেত্রটা যদি হয় গাজা স্ট্রিপ হয়।

প্রায় চল্লিশ দিনেরও বেশি সময় ধরে গাজার উপর আগ্রাসন জারি রেখেছে ইজরায়েল। অন্তত এগারো হাজার নিরপরাধ ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে ইতিমধ্যেই। তার মধ্যে অর্ধেকই শিশু। গত ৭ অক্টোবর অতর্কিতে গাজায় আক্রমণ করেছিল সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী হামাস। তার পরেই গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে দেয় হামাস। তার পর থেকে শুধু রক্ত আর মৃত্যুস্রোত দেখছে গাজা। প্রতিমুহূর্তে হামলার মাত্রা বাড়িয়ে গিয়েছে ইজরায়েলি সেনা। বারবার নিশানা করে হয়েছে গাজার হাসপাতালগুলিকে। বাদ নেই শরণার্থী শিবিরগুলোও।

আরও পড়ুন: ওষুধ নেই, কেমোথেরাপি নেই! যেভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে এগোচ্ছেন গাজার ক্যান্সার আক্রান্তরা

সারা শহর জুড়ে নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। ইচ্ছা করে রকেট হামলা করে করে সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে গাজার সমস্ত যোগাযোগ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে থেকেই যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার খবরাখবর বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে কোনও কসুর বাকি রাখছেন না সেখানকার সাংবাদিকেরা। খাওলা আল-খলিদি, গাজার আরও অনেক সাংবাদিকের মতোই ঠাঁই নিয়েছে আল আকসা শহীদ হাসপাতালে। আপাতত ওই হাসপাতালই হয়ে উঠেছে তাঁদের অস্থায়ী ব্যুরো। কারণ একমাত্র ওই হাসপাতালেই বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। সচল রয়েছে ইন্টারনেট। ফোন-ল্যাপটপ চার্জ করা হোক বা খবর পাবলিশ,ভরসা ওই হাসপাতাল।

সাংবাদিকতাকে ভালোবেসেই এই পেশায় এসেছিলেন আলখলিদি। দেখতে দেখতে ১১ বছর হয়ে গেল এখানেই। প্যালেস্টাইন টিভি-র একটি সকালের শোয়ের উপস্থাপক হিসেবে কাজ করতেন তিনি। তবে যুদ্ধ লাগার পর কাজের ধরণ অনেকটাই পাল্টেছে। আরও অনেক দায়িত্ব এসে উঠেছে মাথায় বলা যায়। আপাতত প্যালেস্টাইন টিভি-র পাশাপাশি সৌদির মালিকাধীন আল হাদাত ও আল আরাবিয়া চ্যানেলের জন্যও কাজ করতে হচ্ছে তাঁকে।

সংবাদমাধ্যমকে রোখার জন্য যুগে যুগে দিকে দিকে নানা ধরনের চেষ্টা হয়েছে। ব্যতিক্রমী নয় আল-খলিদির চ্যানেলও। কিন্তু নিজের জায়গা থেকে টলেননি খলিদি । কাজ বন্ধ করেননি তিনি। এরই মধ্যে গাজা উপত্যাকায় বিমান হামলার হুমকি দিল ইজরায়েলি বাহিনী। রাতারাতি প্যালেস্টাইন টিভি-র অফিস ছেড়ে উঠে যেতে হল গোটা টিমকে। তবে কাজ থামল না। প্রাথমিক ভাবে বাড়ি থেকেই কাজ চলছিল ফোনে ফোনে। ফোনে ফোনে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা, ইন্টারভিউ নেওয়া। এমনই একদিন ফোনে যখন ইন্টারভিউ নিতে ব্যস্ত খলিদি, স্বামী বাহের তাঁকে হঠাৎ জানান, বাড়ি ছাড়তে হবে এখনই। ইজরায়েলি বাহিনীর পরবর্তী নিশানা হতে চলেছে তাঁদের এলাকাটাই।

হাতে মাত্র মিনিট কুড়ি সময়। তার মধ্যে জীবনের সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি ছাড়া সহজ নয়। খলিদির মাথা ভালো করে কাজ করছিল না। তড়িঘড়ি ফোন নামিয়ে ঘরের মধ্যেই পাগলের মতো পায়চারি করতে থাকেন তিনি। স্বামী ও চার সন্তানকে নিয়ে যে বাড়িটিতে বাস করতেন খলিদিরা, সেই বাড়িটি দশ বছরের চেষ্টায় তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন তাঁরা। একটা মাত্রা রকেট হামলায় তাসের ঘরের মতো ধুলোয় মিশে গিয়েছে সেই ঘর। তাঁর হাতে আঁকা ছবি, যা যত্ন করে ঘরের দেওয়ালে টাঙিয়ে দিয়েছিলেন বাহের, তা ছাই হয়ে গিয়েছে। ছাই হয়ে গিয়ছে সমস্ত স্বপ্ন। সেই ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন খলিদি। তার পর অদ্ভুত রকম শান্ত হয়ে যান।

প্রতিবার এভাবেই বাস্তুচ্যুত হয়ে যান গাজার মানুষ। যেমন হয়েছেন খলিদিরা। এইভাবেই একদিন ভয়ঙ্কর বোমার শব্দে ঘুম ভেঙে ওঠেন তাঁরা। তাকিয়ে দেখেন চারদিক যেন এক নিমেষে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আল-খলিদির পরিবার সিদ্ধান্ত নেন গাজার কেন্দ্রে থারা আল মাগাজি শরণার্থী শিবিরে চলে যাওয়ার। তবে শরণার্থী শিবিরে পৌঁছেও বন্ধ হয়নি কাজ। নিজের দেশের প্রতি, নিজের পেশার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সরে আসতে পারেননি খলিদির মতো অনেকেই।

একদিন কর্মসূত্রে রাফাহ সীমান্ত ক্রসিংয়ে যান খলিদি। ওই পথেই গাজা থেকে চিকিৎসার জন্য মিশরে নিয়ে যাওয়া হয় রোগীদের। সে সময় রেডিওতে তিনি জানতে পারেন, আল মাগাজিতে যে শরণার্থী শিবিরে তাঁরা থাকতেন, সেইখানেও হামলা চালিয়েছে ইজরায়েলি সেনা। পরিবারের লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পারা যায়নি। ততক্ষণে সবচেয়ে খারাপটাই ভেবে নিয়েছেন খলিদি। ফিরে গিয়ে স্বামী-সন্তান বা ভাই আর কারওকে দেখতে পাবেন না ভেবেই গাড়ি ঘোরান। পৌঁছন আল আকসা শহীদ হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালের দরজায় গিয়েই বাহেরের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। জানতে পারেন, মোটামুটি ভালোই আছে সকলে। শুধু ছেলে করমের মাথায় কয়েকটি সেলাই পড়েছে। এই ঘটনার পরেই খলিদিরা সিদ্ধান্ত নেন, আর গাজায় নয়। চার সন্তানকে রাফাহর দেইর এল বালাহতে তাদের ঠাকুমা-দাদুর কাছে পাঠিয়ে দেওয়াই স্রেয়।

সেই মতোই নিজের সন্তানদের নিজের কাছ থেকে দূরে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হলেন খলিদি। গত বারো দিন কাছে নেই সন্তানেরা। দিনে ৬-৭ বার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলেন। তারা সারা দিনের সমস্ত কিছু মাকে বলে। কী খেয়েছে, কী করেছে, সমস্ত কিছু। আপাতত তাদের একটাই অসুবিধা, স্নান করতে পারছে না তারা। খলিদি আর তাঁর স্বামী এখনও রয়ে গিয়েছেন গাজায়। প্রতিদিন সকালে উঠে আরও একটা দিনের আয়ুপ্রার্থনা করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ভোর আটটায় আল আরাবিয়া চ্যানেলের জন্য লাইভ হন খলিদি। বিকেল চারটে পর্যন্ত চলতে থাকে কাজ। অন্ধকার হওয়ার আগে হাসপাতাল চত্বর ছাড়ার নিয়ম। বাড়িতে এসেও কাজ চালিয়ে যেতে হয় খলিদিকে। গাজার নানা প্রান্তের মানুষদের খবরাখবর নেন, ইন্টারভিউ নেন।

আরও পড়ুন: সন্তানের মৃতদেহও আসবে যে কোনওদিন! রোজ ২০০ লাশকে কাফন পরাচ্ছেন গাজার এই বৃদ্ধ

খলিদির স্বামী বাহের পেশায় একজন আইনজীবী। যবে থেকে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, লাটে উঠেছে আইনআদালত। ফলে কর্মহীন বাহের। খলিদি যেভাবে এই যুদ্ধপরিস্থিতিতে কাজ করে চলেছেন, তাতে পুরোমাত্রায় সমর্থন করে গিয়েছেন বাহের। প্রতিমুহূর্তে সাহস জুগিয়েছেন। সব সফল নারীর নেপথ্যেও যে একজন করে পুরুষ থাকেন, তা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন খলিদি। কাজ আর সন্তানের মধ্যে গাজায় বসে কাজকেই বেছে নিয়েছেন খলিদি। এই যুদ্ধের পরিমণ্ডলে সাংবাদিক হওয়ার দায়িত্ব পালন করে চলেছেন লাগাতার। আদৌ কোনওদিন আর সন্তানদের দেখতে পাবেন কিনা জানেন না। কোনও একদিন ভোরে ইজরায়েলি রকেট যে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়ে যাবে না তাদের শরীর, এমন কোনও ভরসা নেই গাজায়। এর মধ্যেই তাঁদের জাগিয়ে রাখছে শুধু ছেলেমেয়েদের কণ্ঠস্বরটুকু। যুদ্ধের প্রহর পেরিয়ে কতক্ষণে পৌঁছবেন তাঁরা সন্তানদের কাছে।

More Articles