বিবেকানন্দই অনুপ্রেরণা ছিলেন নিহত শিনজো আবে-র

২০২১ সালে তাঁকে পদ্মবিভূষণ পুরস্কারে পুরস্কৃতও করে ভারত সরকার। আবের মৃত্যুতে একজন সৎ এবং বিশ্বস্ত বন্ধু হারাল ভারত।

জাপানের দীর্ঘতম প্রধানমন্ত্রিত্বের নজির গড়েছিলেন যিনি, সেই শিনজো আবে ৮ জুলাই নিহত হয়েছেন। নারা শহরের রাস্তায় নির্বাচনী প্রচারের ভাষণ দেওয়ার সময় প্রকাশ্য দিবালোকে তাঁকে গুলি করেন এক ব্যক্তি। ওই অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। ‘ব্রডার এশিয়া’ ধারণার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। এই ধারণা নিয়ে তাঁর মতো কাজ করেছেন খুব কম ব্যক্তি। পাশাপাশি জাপানের ‘ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক পলিসি’-র সম্পূর্ণ নকশা তাঁর নিজের হাতে তৈরি। ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির পরিপূরক জাপানের এই নীতি। ভারত-জাপান সুসম্পর্কের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন আবে। ২০০৭ নাগাদ ভারতীয় পার্লামেন্টে বক্তৃতা দিয়েছিলেন আবে। এই বক্তৃতা অত্যন্ত বিখ্যাত। ‘কলফ্লুয়েন্স অফ টু সিজ’ অর্থাৎ "দু'টি সাগরের সঙ্গম", ১৮৯৩ সালে শিকাগোতে স্বামী বিবেকানন্দ যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেখান থেকে উদ্ধৃতি দেন তিনি। বিশ্বের ইতিহাসে ভারতের গৌরবময় অবদান বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “নানা গুরুত্বপূর্ণ অবদান তো রয়েইছে, রয়েছে তার সহ্যশক্তির নজিরও।"

বিবেকানন্দের বিশ্বভ্রমণের কথাও ঘুরে ফিরে এসেছিল তাঁর বক্তব্যে। আবে বলেন, “তেনশিন ওকাকুরা নামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে বিবেকানন্দের পরিচয় হয়। এই ওকাকুরা হলেন জাপানের নবজাগরণের অন্যতম প্রতিভূ, আধুনিক যুগের সেই ঊষালগ্নেই সমসাময়িক জাপানের থেকে তাঁর চিন্তা ভাবনা কয়েক লক্ষ গুণ এগিয়ে ছিল। ওকাকুরাকেও বিবেকানন্দ পথ দেখান। বিবেকানন্দের একনিষ্ঠ শিষ্যা এবং সামাজিক কর্মী সিস্টার নিবেদিতার সঙ্গেও তাঁর বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল।”

বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে যাওয়ার পথে ১৮৯৩ নাগাদ জাপানে পৌঁছন স্বামীজি। সত্যি বলতে কী, স্বামীজির লেখাপত্র থেকেও দেখা যায়, সেসময় জাপান ঘুরে খুবই মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। এর বছরচারেক পর 'দ্য হিন্দু'-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানাচ্ছেন, “জাপানিদের মতো এমন স্বদেশপ্রেমী এবং শিল্পী জাতি গোটা বিশ্ব দেখেনি কখনও। ...জাপানের এমন মহত্ব অর্জনের চাবিকাঠি হল তাদের আত্মবিশ্বাস। দেশের প্রতি তাদের অপার ভালোবাসা।” তিনি আরও বলেন, “যখন দেশের জন্য প্রাণপাত করতে রাজি– এমন বীরেরা জাগবে, সত্যি কথা বলার মেরুদণ্ড যাদের রয়েছে– তারা যখন জাগবে, তখন ভারত সবদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠবে। মানুষেই দেশ গঠন করে। এ ছাড়া দেশে আর আছে কী? জাপানিদের সামাজিক নীতিবোধ এবং রাজনৈতিক নীতিবোধ যদি বুঝতে পারো, তোমরাও ওদের মতো মহৎ হতে পারবে। দেশের জন্য সবকিছু তারা ত্যাগ করতে রাজি। এই মনোভাবই তাদের মহান করেছে।”

আরও পড়ুন: কেন রাজপথে গুলি জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে? প্রকাশ্যে এল আসল কারণ

শুধু স্বামী বিবেকানন্দই নন, ভারতের আরও কিংবদন্তি নায়কও জাপানের প্রতি উচ্চধারণা পোষণ করতেন। সম্মান করতেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ জাপানের বন্দর শহর ইয়োকোহামার সাঙ্কিয়েন গার্ডেনস্‌-এ মাসতিনেক কাটিয়েছিলেন। পশমের ব্যবসায়ী এবং শিল্পের পৃষ্ঠপোষক তোমিতারো হারার অতিথি হিসেবেই সেখানে দিন কাটাচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর ‘জাপান-যাত্রী’ বইতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,

“জাপানি পাঠকের চেহারা দেখার মানসিক শক্তিটা প্রবল।

এইখানে একটা কবিতার নমুনা দিই, যেটা চোখে দেখার চেয়ে বড়:

স্বর্গ এবং মর্ত্ত্য হচ্ছে ফুল, দেবতারা এবং বুদ্ধ হচ্চেন ফুল—

মানুষের হৃদয় হচ্চে ফুলের অন্তরাত্মা।

আমার মনে হয়, এই কবিতাটিতে জাপানের সঙ্গে ভারত বর্ষের মিল হয়েচে। জাপান স্বর্গমর্ত্যকে বিকশিত ফুলের মত সুন্দর করে দেখ্‌চে– ভারতবর্ষ বল্‌চে, এই যে একবৃন্তে দুই ফুল— স্বর্গ এবং মর্ত্ত্য, দেবতা এবং বুদ্ধ,---মানুষের হৃদয় যদি না থাকত, তবে এ ফুল কেবলমাত্র বাইরের জিনিস হত;---এই সুন্দরের সৌন্দর্য্যটিই হচ্ছে মানুষের হৃদয়ের মধ্যে।

আবার কখনও বলছেন,

আবেগের বোধ এবং প্রকাশকে খর্ব্ব করে, সৌন্দর্য্যের বোধ এবং প্রকাশকে প্রভূত পরিমাণে বাড়িয়ে তোলা যেতে পারে, —এখানে এসে অবধি এই কথাটা আমার মনে হয়েছে। হৃদয়োচ্ছ্বাস আমাদের দেশে এবং অন্যত্র বিস্তর দেখেচি, সেইটে এখানে চোখে পড়ে না। …এখানে যে লোক অত্যন্ত গরীব, সেও প্রতিদিন নিজের পেটের ক্ষুধাকে বঞ্চনা করেও এক আধ পয়সার ফুল না কিনে বাঁচে না।

নেতাজিকে জাপানিরা মহান শহিদ হিসেবে মান্য করে। অনেকে তাঁকে স্বাধীনতা সংগ্রামী দুর্ধর্ষ এক সামুরাই হিসেবে গণ্য করেন। মৃত্যুর ৭৭ বছর পরেও নেতাজি জাপানের সব থেকে পরিচিত ভারতীয় বীর। এই সমস্ত দিক উল্লেখ করে তাঁর ভাষণে আবে বলেন, “যাঁর নামে কলকাতার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের (নেতাজি) নাম দেওয়া হয়েছে, তিনিই হোন, কি আরেকটু পিছিয়ে গেলে চিরতরুণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই হোন— আত্মার গভীরতম কোণটি তাঁরা সমসাময়িক জাপানিদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন। আধুনিক যুগের সেই গোড়ার দিকেই যে গভীরতা, যে সমৃদ্ধির আদানপ্রদান জাপান এবং ভারতের মেধাসম্পন্ন নেতাদের মধ্যে হয়েছিল, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এতখানি আধুনিক হয়েও আমরা তা কল্পনাও করতে পারি না।"

জাপান এবং ভারতের সুসম্পর্ক গড়ে তোলার সুবিধার্থে আবে এও উল্লেখ করেন, যে জাপানের লোকে, “ভারতকে নতুন করে আবিষ্কার করেছে, আসলে আমি বলতে চাইছি, আমরা আমাদের উপলব্ধি করেছি ভারত আমাদের সঙ্গী, যার মূল্যবোধ এবং আগ্রহের জায়গাটা হুবহু আমাদের সঙ্গে মিলে যায়। আমরা নিজেদের কাছে নিজেরা স্বচ্ছ থাকব।” এই অমোঘ বক্তব্যের মাধ্যমে ভারত এবং জাপানকে পরস্পরের নিকটে নিয়ে আসেন আবে, যাতে দুই দেশেরই বাণিজ্যিক লাভ হয়েছিল। ২০২১ সালে তাঁকে পদ্মবিভূষণ পুরস্কারে পুরস্কৃতও করে ভারত সরকার। আবের মৃত্যুতে একজন সৎ এবং বিশ্বস্ত বন্ধু হারাল ভারত।

 

More Articles