আটের দশকে AI নিয়ে আস্ত একটি উপন্যাস! শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কেন পড়ব

Shirshendu Mukhopadhyay: 'পাঠান'-এর প্লাবনের মধ্য দিয়েও আমরা ভুলিনি আমাদের শৈশবের অন্যতম প্রিয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে।

ইন এবং য়াং (Yin and Yang) তত্ত্ব সম্পর্কে জানেন তো? সব ভালোর মধ্যেই কিছু খারাপ রয়েছে এবং সব খারাপের মধ্যেই কিছু ভালো রয়েছে। ব্যাপারটা দৃষ্টিভঙ্গির। ভূত, প্রেত, পিশাচ, আত্মা ইত্যাদি বললেই আমাদের মনে খারাপ কিছু আসে। কিন্তু ওই যে বললাম, খারাপের মধ্যেই ভালো খুঁজে পাওয়া। এমন ভাবেই ভূত, প্রেত, পিশাচের মধ্যে দিয়ে ভালবাসতে শিখিয়েছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। শীর্ষেন্দুবাবু দেখিয়েছেন ভূতেরা অশরীরী হলেও অমানবিক নয়। বাঙালি পাঠককুল ভূতেদের ভালবাসতে শিখেছে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরেই। আজ ২ নভেম্বর ৮৭-তে পা দিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁকে বাংলা সাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তি বললে অত্যুক্তি করা হয় না। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা যেন চারপাশের অস্থির সময়টুকু পেরিয়ে একটা শান্তির পরশ দেয়। এই যে শান্তির পরশটুকু, তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লেখার মধ্যে একটা ম্যাজিক রিয়‍্যালিজমের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন তিনি। তাঁর লেখার মধ্যে থাকে এক লার্জার দ্যান লাইফ প্লট, ম্যাজিক এবং মাটির সঙ্গে জুড়ে থাকা চরিত্র। এই লেখাগুলির মাধ্যমেই কিশোর মনে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। কিশোর উপন্যাসে প্রায় সবক'টিতেই আন্ডারটোনে দেওয়া রয়েছে কিছু না কিছু নীতিগত শিক্ষা।

‘মাটি থেকে ইট হয়, ইট থেকে বাসা, বাসা পুরাতন হয়ে ভেঙে যায়।’ পার্থিব উপন্যাসে এই লাইনটি লিখেছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, দেশভাগ এবং ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য একটি দেশে চলে আসে কতটা কষ্ট দিয়েছিল তাঁকে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের টালমাটাল সময়ে পরিবারসমেত কলকাতা পাড়ি জমান। বাবার চাকরির সুবাদে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় শৈশব কেটেছে তাঁর। কোচবিহার বোর্ডিং স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন তিনি। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় থেকে বিএ এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। শীর্ষেন্দু তাঁর পেশাজীবন শুরু করেন শিক্ষকতার মাধ্যমে। দৈনিক 'আনন্দবাজার পত্রিকা'-য় সাংবাদিকতাও করেছেন বহুদিন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ছোটবেলা থেকেই ভীষণ পড়ুয়া ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানিক বন্দোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়ের মতো লেখকদের রচনাবলী পড়ার অভ্যাসই তার লেখক সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলে।

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১৯৫৯ সালে 'দেশ' পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প ‘জলতরঙ্গ’ প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ ৭ বছর পর দেশ পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’। এরপর থেকেই নিয়মিত লিখতে থাকেন তিনি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বই এর সংখ্যা দুই শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস 'পার্থিব', 'দূরবীন', 'মানবজমিন', 'গয়নার বাক্স', 'যাও পাখি', 'পারাপার' ইত্যাদি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের 'রহস্য সমগ্র' রহস্যপ্রেমীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ছোটদের জন্য রচিত প্রায় চল্লিশের বেশি গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘অদ্ভুতুড়ে সিরিজ’। শিশু-কিশোরদের জন্য এই লেখাগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হলো সহজ-সরল-সরস ভাষায় বর্ণনা। প্রচুর হাস্যরস ও রহস্যমেশানো এই বইগুলোর গল্পের সঙ্গে সাসপেন্সও রয়েছে। 'মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি', 'ভুতুড়ে ঘড়ি', 'হেতমগড়ের গুপ্তধন', 'নন্দীবাড়ির শাঁখ', 'ছায়াময়' ইত্যাদি এই সিরিজের অন্তর্ভুক্ত।

book cover

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ

এছাড়াও তিনি বেশ কিছু ছোটগল্প রচনা করেছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে বিভিন্ন সময় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে বাংলায়। 'পাতালঘর', 'গয়নার বাক্স', 'মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি', 'ছায়াময়', 'বনি', 'আশ্চর্য প্রদীপ' এর উৎকৃষ্টতম উদাহরণ। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্র শবর দাশগুপ্ত। পর্দায় আমরা এই যে ‘ব্যাডঅ্যাস কপ’ শবরকে দেখে অভ্যস্ত, তা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়েরই সৃষ্টি। একদিকে শিশুদের জন্য কিশোর উপন্যাস, আবার অন্যদিকে বড়দের জন্য শবরের মতো দুর্ধর্ষ একটি সিরিজ- সার্থকভাবেই নিজের কলমে সময়কে স্থান দিয়েছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।

জনপ্রিয় শবর সিরিজ ও অন‍্যান‍্য রহস্য গল্প
এই ভূত, প্রেত, পিশাচ, ডাকাত, গোয়েন্দা এসব ছাড়িয়েও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখনীর আরেকটি দিক আছে, যা লক্ষ করলে তাঁর চিন্তাশক্তির ব্যাপ্তি এবং গভীরতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে বর্তমানে আগ্রহী মানুষজন। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মানুষরা। কিন্তু শীর্ষেন্দুবাবু এই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছিলেন সেই আটের দশকেই। এই চিন্তাভাবনার ফসল ‘বিকেলের মৃত্যু’। ১৯৮৪ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার 'রবিবাসরীয়' সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতো এই উপন্যাসটি। প্রকাশকালেই, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে, সর্বস্তরের পাঠককুলকে করে রেখেছিল উন্মুখ, রুদ্ধশ্বাস ও সম্মোহিত। একাধারে প্রেম, রহস্য, বিজ্ঞান, কল্পবিজ্ঞান ও অ্যাডভেঞ্চারের উপাদানে তৈরি এই উপন্যাস আদ্যোপান্ত নেশা ধরিয়ে দেবে উপন্যাসটি পড়ার। এই কাহিনির নায়ক বছর আটত্রিশের ববি রায়। এক বিস্ময়কর প্রতিভা। কলকাতার এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির জাঁদরেল বস। উপন্যাসের শুরুতেই এই মানুষটির সম্পর্কে আত্মভোলা, বেঁটেখাটো, বিরলকেশ প্রভৃতি বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু গল্প এগোতে এগোতে বোঝা যাবে, ইলেকট্রনিক্সের জাদুকর, ক্যারাটে-কু্ংফুতে সুদক্ষ, সুরসিক এই মানুষটি নিজেই আস্ত একটি কোড। ববি রায়ের নামের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক গোপন কোড। এই গল্পে অন্যতম মুখ্য চরিত্র লীনা। লীনার সঙ্গে বসের অদ্ভুত সম্পর্ক। বস তাকে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য এমন একটি গাড়ি দেন, গাড়িটি আবার বুক কাঁপিয়ে কথা বলে ওঠে। এই গাড়ি কীভাবে তৈরি হলো, ববি রায়ের হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, ববি রায়ের কম্পিউটারে কিলবিল করা অসংখ্য কোড, 'নীল মঞ্জিল' নামের এক দুর্ভেদ্য দুর্গ, পদে পদে বিপদ, ষড়যন্ত্রকারীদের মরণ-ফাঁদ, লীনা ও ববি রায়ের বিচিত্র সম্পর্কের টানাপোড়েন এইসব নিয়েই সেই আটের দশকে একটি গোটা উপন্যাস লিখে ফেলেছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। পারলে একবার পড়ে দেখবেন ‘বিকেলের মৃত্যু’। শীর্ষেন্দুবাবু একবার বলেছিলেন ১৯৮৪ সালে আনন্দবাজারের অফিসে যখন প্রথম কম্পিউটার আসে, তখন সেই কম্পিউটারের বিভিন্ন জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই এই উপন্যাসটি লেখার কথা মাথায় আসে তার।

book cover

'বিকেলের মৃত্যু'-র প্রচ্ছদ

ঘটনাচক্রে এই ২ নভেম্বর আরেকজন বিখ্যাত মানুষের জন্মদিন। তিনি বলিউডের ‘কিং’ শাহরুখ খান। প্রায় চার বছর কোনও সিনেমা আনেননি শাহরুখ। আর এই জন্মদিনে সামনে এল তাঁর পরবর্তী সিনেমার টিজার। স্বভাবতই সোশ্যাল মিডিয়ার সর্বত্র লেখালেখি শাহরুখ খানকে নিয়ে। কিন্তু এই 'পাঠান'-এর প্লাবনের মধ্য দিয়েও আমরা ভুলিনি আমাদের শৈশবের অন্যতম প্রিয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে। প্রতি বছর এভাবেই ‘বাদশাহী’ ঝড়ের মধ্য দিয়েও এমনই সপ্রতিভভাবে চলতে থাকুক আমাদের শৈশবের এই স্মৃতির গাড়ি।

More Articles