কে বেশি গেরুয়া? শিবসেনা-বিজেপি তরজার নেপথ্যে আসলে কোন কারণ?
হিন্দুত্ব, জয় শ্রীরাম- এই শব্দগুলো থেকে বিজেপিকে আলাদা করা যায় না। তবে নতুন ভারতের মন যে খানিক বদলেছে, তা বলাই বাহুল্য। একথা ভালোই বুঝেছেন মোদি-শাহরা। তাই উত্তরপ্রদেশ এবং বিভিন্ন গো-বলয়ের ভোটেও মোদিকে দেখা গেছে উন্নয়নের বার্তা দিতে। আসলে শুধু কট্টর হিন্দুত্বে ভর করে এখনকার সময়ে ক্ষমতায় আসা এবং টিকে থাকা যে মুশকিল, তা ভালোই বুঝেছেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু পুরোপুরি হিন্দুত্ব থেকে সরে আসেনি বিজেপি। এদিকে শিবসেনা-রও ভিত্তি হিন্দুত্ব। বিজেপি সম্প্রতি শিবসেনাকে আক্রমণ করেছে এই বলে যে, তারা ভুলে যাচ্ছে তাদের 'আইডিওলজিক্যাল রুট'। এরপর আসরে নামেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে। হিন্দুত্ব নিয়ে তিনি বিজেপিকে তুলোধোনা করেন।
আক্রমণের ইস্যু বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং রাম মন্দির নির্মাণ। কে বড় হিন্দুত্ববাদী, তা নিয়ে যেন প্রতিযোগিতা চলছে শিবসেনা এবং বিজেপি ও মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা (এমএনএস)-এর মধ্যে। বিজেপিকে আক্রমণ করে সোমবার উদ্ধব বললেন, ‘আপনারা কী ধরনের হিন্দুত্ববাদী? বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় লুকিয়ে পড়েছিলেন। রাম মন্দির নির্মাণের সিদ্ধান্ত তো নিয়েছে আদালত!’ রাজ্যে কংগ্রেস এবং এনসিপি-র সঙ্গে জোট রয়েছে শিবসেনা-র, যা নিয়ে বিজেপি তাদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করে চলেছে প্রতিনিয়ত। তার জবাব দিতেই উদ্ধব বললেন, "ওরা (বিজেপি ও এমএনএস) দুর্বল হিন্দুত্ববাদী। এটা ভুয়া নিও-হিন্দুইজম। কার জামা বেশি গেরুয়া, তা নিয়ে ওদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে।"
উদ্ধব আরও বলেন, "আমরা গদাধারী হিন্দুত্বের অনুসরণ করি, ঘণ্টাধারীর নয়।" শিবসেনা-প্রধান এও জানান, খুব শিগগিরই একটা সমাবেশ করে সবাইকে বুঝিয়ে দেবেন, কে বা কারা আসল হিন্দুত্ববাদী। প্রসঙ্গত, মসজিদে লাউডস্পিকার বাজানো বন্ধ করতে মহারাষ্ট্র সরকারকে ৩ মে পর্যন্ত চূড়ান্ত সময়সীমা দিয়েছিলেন রাজ ঠাকরে। সময়মতো বন্ধ না হলে রাজ্যের প্রত্যেক মসজিদের সামনে লাউডস্পিকারে হনুমান চালিসা চালাবে তাঁর দল, এই বলে হুমকিও দিয়েছিলেন তিনি। এরপর বিতর্ক চরমে ওঠে।
আরও পড়ুন: স্বাধ্বী প্রজ্ঞা বললে সাত খুন মাফ, বাক-স্বাধীনতা নেই জিগনেশের? কেন গ্রেফতার!
শিবসেনা তাদের মুখপত্র 'সামনা'-র সম্পাদকীয়তেও বলে, উদ্ধব ঠাকরের আমলে এখানে কঠোর হিন্দুত্ব আনুসরণ করা হয়। এই রাজ্যে হনুমান চালিসা পাঠে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই।
গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, হিন্দুত্ব-র আদর্শের উদ্দেশ্য ছিল অন্য ধর্মগুলিকে বাদ দিয়ে ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা এবং সেই অর্থেই বিজেপি একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল। ১৯৯৮ সালে এনডিএ সরকার গঠনের পর বিজেপি এই বিষয়ে কিছুটা মধ্যপন্থা গ্রহণ করে। অটলবিহারী বাজপেয়ী এই মধ্যপন্থার পক্ষে ছিলেন। তাঁর মধ্যপন্থী নীতি ব্যর্থ হওয়ার পর বিজেপি আবার কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী অবস্থানে ফিরে আসে। কিন্তু এই অবস্থানের প্রেক্ষিত ছিল। ১৯৮৪ সালে লালকৃষ্ণ আদবানি দলের সভাপতি হয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে বিজেপি-র রামজন্মভূমি আন্দোলন গতিপ্রাপ্ত হয়। আটের দশকের গোড়ার দিকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ চত্বরে রামের মন্দির নির্মাণের জন্য আন্দোলন শুরু করে। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লালকৃষ্ণ আদবানি রাম মন্দির আন্দোলনের সমর্থনে অযোধ্যার দিকে ‘রথযাত্রা’ কর্মসূচি গ্রহণ করেন। রামচন্দ্র গুহ-র মতে, এই রথযাত্রা কর্মসূচির বৈশিষ্ট্য ছিল ‘ধর্মীয়, পৌরুষদীপ্ত’। এই কর্মসূচি চলাকালীন একটি বক্তৃতায় লালকৃষ্ণ আদবানি বলেন, সরকার মুসলিম-তোষণ নীতি গ্রহণ করে ‘ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষতা’-র আড়ালে হিন্দুদের আইনসম্মত অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। তিনি কর্মসূচির সমর্থনে বলেন, এটি সোমনাথ থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত চলা একটি স্বতঃস্ফূর্ত কর্মসূচি। বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব আদবানি-র বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। যদিও বহু সংখ্যক করসেবক অযোধ্যায় জড়ো হন। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব দেড় লক্ষ করসেবককে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেন। কিন্তু করসেবকদের একটি অংশ অযোধ্যায় ঢুকে পড়ে এবং মসজিদটি আক্রমণ করে। অনেক পরে ভারতের অযোধ্যাতে যে বিতর্কিত ধর্মীয় স্থানটি নিয়ে বহু বছর ধরে সংঘাত চলেছে, সেখানে একটি হিন্দু মন্দির বানানোর পক্ষেই রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। এর পাশাপাশি মুসলিমদের মসজিদ বানানোর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে অযোধ্যাতেই অন্য কোনও 'বিকল্প' স্থান। মোদি যতই উন্নয়নের কথা বলুন না কেন, তাঁকে বারবার অযোধ্যা নিয়ে রাজনীতি করতে দেখা গেছে। সেনাও যে হিন্দুত্ব থেকে সরে আসেনি, তার প্রমাণ মিলেছে সাম্প্রতিক একটি ঘটনায়।
সম্প্রতি শিবসেনা-র সঙ্গে জোট গড়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন এআইএমআইএম মুখপাত্র ইমতিয়াজ জলিল। সেই প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে খারিজ করেন উদ্ধব। ওয়েইসি-র দলের সঙ্গে জোটে যেতে রাজি নয় শিবসেনা। অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম) প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়েইসির দলের জোট-প্রস্তাব ওড়ান শিবসেনা প্রধান তথা মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে। শিবসেনা হিন্দুত্ব-র প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে ফের একবার স্পষ্ট করেছেন উদ্ধব ঠাকরে। শিবসেনা হল মহারাষ্ট্রকেন্দ্রিক হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল। ১৯ জুন, ১৯৬৬ সালে বাল ঠাকরে এই দলের পত্তন করেন। দলটির সদ্যস্যরা শিবের সৈনিক হিসেবে পরিচিত। অনেকে এই দলকে ভারতের ফ্যাসিবাদী দল হিসাবে উল্লেখ করেন। সে যাই হোক, মোদ্দা কথা, শিবসেনা-রও মূল ভিত্তি হিন্দুত্ব। দলের এই অ্যাজেন্ডা থেকে তারা যে সরে আসেনি, তা বারবার প্রমাণ করেছেন উদ্ধব ঠাকরে। এদিকে বিজেপির সময়টা ভালো যাচ্ছে না। বঙ্গ বিজেপির অবস্থা করুণ। দলের অন্দরে ফাটল। বিদ্রোহে জেরবার নেতৃত্ব। এই অবস্থায় মোদি-শাহরা ভালোই বুঝেছেন, নতুন রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে এবং দিল্লিতে আগামী দিনে টিকে থাকতে শুধুমাত্র হিন্দুত্বকে আঁকড়ে থাকলে চলবে না। কারণ নতুন ভারত খোল, করতালের বদলে কাজ চায়। কৃষক আন্দোলন নিয়েও কম ভুগতে হয়নি নরেন্দ্র মোদিকে। এই অবস্থায় বিকাশের স্লোগানে ভর করে এগোতে চাইছেন মোদি। দেখা যাক, হিন্দুত্ব না বিকাশ?
প্রশ্ন যেদিকেই ইঙ্গিত করুক, দিনের শেষে হিন্দুত্ব, সেনা, বিজেপি- এই শব্দগুলো সমার্থক। সেনা যার সঙ্গেই ঘর করুক না কেন!