শিউলি মানে শুধু ফুল নয়, বিশেষ একটি পেশাও! অভিধানে দানা বাঁধে যে রহস্য
ফুল 'শিউলি' যে তৎসম শেফালি বা শেফালিকা থেকে এসেছে, তা আমরা সবাই জানি। বাংলা ভাষায় 'শিউলি' শব্দটির আর একটি অর্থ আছে।
এবারের শব্দ 'শিউলি'। ফুল 'শিউলি' যে তৎসম শেফালি বা শেফালিকা থেকে এসেছে, তা আমরা সবাই জানি। বাংলা ভাষায় 'শিউলি' শব্দটির আর একটি অর্থ আছে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস প্রণীত 'বাঙ্গালাভাষার অভিধান'-এ সিউলি (শিউলি) শব্দের অর্থ দেওয়া হয়েছে, "জাতিবিশেষ। ইহারা খেজুরগাছ কাটে ও গুড় তৈয়ার করে।" শব্দটিকে তিনি 'প্রাদেশিক' বলেছেন।
নগেন্দ্রনাথ বসু প্রণীত বিশ্বকোষ জানাচ্ছে,
যাহারা খর্জুর গাছ কাটিয়া গুড় প্রস্তুত করে, চলিত কথায় তাহাদিগকে শিউলী কহে। স্থানভেদে ইহাদের গাছীও বলা হয়।
শব্দটিকে দেশজ বলা হয়েছে।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এ লেখা হয়েছে, ইহারা খেজুরগাছ কাটে ও খেজুর রসে গুড় প্রস্তুত করে। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে,
সিউলী নগরে বৈসে, খেজুরের কাটি রসে, গুড় করে বিধির বিধানে
হিন্দি 'সেবলী' (জাতিবিশেষ) শব্দ থেকে সিউলি তথা শিউলি এসেছে বলে এই অভিধানের দাবি। সংসদ বাংলা অভিধানে লেখা হয়েছে, খেজুর গাছ কেটে রসসংগ্রহকারী হিন্দু জাতিবিশেষ। [দেশি]
শব্দটি দেশি বলেই দাবি বেশিরভাগ অভিধানের। দ্রাবিড় না অস্ট্রিক, সেটা কোথাও বলা নেই। এবং শব্দটিকে যেন একটু অকুলীন গোত্রে ফেলার প্রবণতা সর্বত্র। না হলে বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়,
পুরুষ অতি নীচজাতীয় পাষণ্ড– বোধ হয়, ডোম কি সিউলি!
দেখতে হলো, শ্রদ্ধেয় সত্যনারায়ণ দাশ প্রণীত 'বাংলায় দ্রাবিড় শব্দ' বইটি। এখানে শিউলি প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে, "বি. জাতিবিশেষ, তাল-খেজুর গাছ থেকে রস বের করা এদের পেশা। কন্নড় ভাষায় 'শিবড়ি' মানে তাল বা খেজুর গাছের পাতা।"
অর্থাৎ তাঁর মতে কন্নড় ভাষার শিবড়ি থেকে কিঞ্চিৎ অর্থ পরিবর্তন ঘটার মধ্য দিয়ে শিউলি এসেছে বাংলায়। স্রেফ পাতা না বুঝিয়ে পাতার কর্তনকারীকে বোঝাচ্ছে। 'সাঁওতালি-বাংলা সমশব্দ অভিধান'-এ শিউলি-র দেখা পাইনি।
তাহলে শিউলি কি তদ্ভব শব্দ? যদি তাই হয়, তবে তার জন্মদাতা তৎসম শব্দটি কী? ভাবতে ভাবতে শিয়রী শব্দটি মাথায় খেলে গেল। শিয়র বলে যে তদ্ভব বা অর্ধতৎসম শব্দটি আছে, তা থেকেই বিশেষণে শিয়রী। শিয়র থেকে শিঅর বা শিওর আসে অপভ্রংশে। অন্তত জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে এটা পাচ্ছি।
এই অভিধানেই পাচ্ছি, শিয়র এসেছে তৎসম শীর্ষ থেকে। মানে মস্তক বা মাথা। শায়িত ব্যক্তির মাথার দিকও বোঝায়।
আবার বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানে দেখছি, শিয়র এসেছে শিখর থেকে। বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে শিয়র তথা শিওর শব্দটির মূলেও শিখর বলা হয়েছে।
শীর্ষ বা শিখর, যেখান থেকেই আসুক শিয়র, শিয়রী শব্দটি শিয়র-এর বিশেষণ রূপ। এই শিয়রী শব্দটির কথাই বীরভূম জেলার শহর সিউড়ির ব্যুৎপত্তি আলোচনায় আসে। কড়িধ্যা নামক ইতিহাসবিশ্রুত জনপদের শিয়রে অবস্থিত সিউড়ি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিখ্যাত শহর সিউড়ী আদতে ছিল শিয়রী। ব্যুৎপত্তিটি লক্ষ করার মতো, শিয়রী > শিউড়ি > সিউড়ি। এইভাবেই সিউড়ি এসেছে বলে বীরভূম-বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস। যদিও হান্টার সাহেবের মতো কেউ কেউ অন্য ব্যুৎপত্তির কথাও বলেন।
খেজুর গাছের শীর্ষ বা শিয়রে উঠে শিউলিরা গাছের পাতা কেটে সাফসুতরো করে রসের কলসি লাগায়। তাদের হাতে থাকে ধারালো কাতান বা হাঁসুয়া। এই কাতানকে শিউলি কাতান বলা হয়। শিয়রী> শিঅরি> শিঅলি> শিউলি।
গাছের শিয়র বা শীর্ষদেশে উঠে কাজ করে বলে এই পেশার লোককে শিয়রী তথা শিউলি বলে ডাকা হতো। অনেকে তর্ক জুড়তে পারেন গাছের ক্ষেত্রে শিয়র হয় কি না, তা নিয়ে। কারণ সংসদ বাংলা অভিধান যাঁরা ব্যবহার করেন, তাঁদের শিয়রের ব্যুৎপত্তি দেখে অকুল পাথারে পড়তে হবে। শিয়র শব্দের ব্যুৎপত্তিতে এই অভিধানের বর্তমান সংস্করণে(সুভাষ ভট্টাচার্য সংস্করণ) লেখা হযেছে, [সং. শয্যা > শিয > শিয়র]।
তাহলে সুভাষ ভট্টাচার্যর মতো অভিধানকার ধরেই নিয়েছেন, শীর্ষ নয়, শিখর নয়, শিয়র এসেছে শয্যা থেকে! অথচ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় আমরা গাছের শীর্ষদেশ অর্থে শিয়রের উল্লেখ পাই বারবার। যেমন,
সেই সময় চুপি-চুপি আলো আসে–একটুখানি চাঁদের আলো– বাতাসের গায়ে আলো পড়ে, গাছের শিয়রে আলো পড়ে...।
আর এক জায়গায়,
খেলার বেলা শেষ হয়ে আসে, তিন পহরের রোদ ছায়ার কাছেই মাদুর বেছায়, খেলা ভুলে' খোকা শুয়ে পড়ে রোদের কোলে মাথা রেখে, চেয়ে থাকে নীল আকাশে, তালগাছের শিয়রে, বাবুইয়ের বাসার দিকে।
তাহলে সুভাষবাবু অবনীন্দ্রনাথের এই শিয়রের ব্যাখ্যা করবেন কী করে? তালগাছের মাথায় শয্যা পাততে গেল কে বা কারা? সুশীলকুমার দে-র বাংলা প্রবাদ বইয়ে আছে, 'কিবা বাবুর আশা, শিয়রে ঘুঘুর বাসা!' এক কবির কবিতায় পাই, 'তালের শিয়র থেকে পেড়ে এনে নদী কুয়াশার/ আকাশের তারা ছেনে নিয়ে আসে অপার্থিব সার।' এই দু'টি ক্ষেত্রেও তো শিয়র মানে শীর্ষ বোঝানো হয়েছে!
আসলে অভিধানপ্রণেতার একটি প্রবণতাই আছে নতুন কিছু তত্ত্বের অবতারণা করা, নতুন কিছু বলা। আমার মনে হয়, যুক্তিতে যখন ফাঁক থেকে যায়, তখন পুরনোর চর্বিতচর্বণ করাই শ্রেয়। কিংবা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত বা কুখ্যাত জিজ্ঞাসাচিহ্ন প্রয়োগের মাধ্যমে পরবর্তী গবেষকদের জমি তৈরি করে দেওয়ার নীতিকে সমর্থন করা উচিত তাঁদের।
অভিধানকাররা অভিধানের সংস্কারের কাজ করুন, আমরা, শব্দগবেষকরা নিজস্ব শব্দচর্চা চালিয়ে যাই। খেজুর গাছের শিয়রে উঠে যারা খেজুরের পাতা ছেঁটে খেজুর গাছের গা চেঁছে খেজুর রস ধরার কলসি ঝুলিয়ে দেয়, তারাই শিয়রী তথা শিওরি তথা শিউরি বা শিউলি। এরাই পরের দিন ভোরে রসভর্তি কলসিগুলি নামিয়ে আনে ও সেই রস কড়ায় জ্বাল দিয়ে খেজুর গুড় প্রস্তুত করে। আসলে শিউলি কোনও জাতি নয়, শিউলি একটি পেশা বা বৃত্তির লোক। হিন্দু, মুসলমান দু'টি সম্প্রদায়ের লোকই এই কাজ করে। সাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্রর 'রস' নামক গল্প থেকে সাতের দশকে তৈরি হয়েছিল সুধেন্দু রায়ের পরিচালনায় 'সওদাগর' নামক সিনেমা। অমিতাভ বচ্চন সেখানে মোতি শিউলি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত খেজুর রসের কারবারি। বারাসাতের কামদুনিতে এই সিনেমার শ্যুটিং হয়েছিল। বিবাহিত বউ মাজুবিকে ছেড়ে প্রণয়ী ফুলবানুকে বিয়ে করার বিরাট মাশুল গুণতে হয়েছিল মোতিকে। ধিকিধিকি আঁচে তৈরি হয়েছিল বিষাদঘন পয়রা গুড়।