চলন্ত ট্রেনে কোন ফাঁদে? 'নিখোঁজ' জয়ের সঙ্গে যা ঘটেছে কতটা বিশ্বাসযোগ্য?

Siliguri: বুধবার সকালে ট্রেন যখন হাওড়ায় পৌঁছয় তখন জয়ের জ্ঞান ফিরলেও নাকি মাথা কাজ করছিল না। নেশাগ্রস্ত অবস্থাতেই ছিলেন।

হঠাৎ করে এক রহস্যজনক হোয়াটস্যাপ মেসেজ। তারপরেই চলন্ত ট্রেন থেকে নিখোঁজ হয়ে যান জয় অধিকারী, পেশায় বেসরকারি ওষুধ কোম্পানির কর্মী। বড়দিনের আগের রাতে বাড়ি ফেরার কথা ছিল তাঁর। কথা ছিল পরিবারের সঙ্গেই ক্রিসমাস কাটাবেন। সংস্থার কাজের জন‍্যই মালদা যেতে হয়েছিল তাঁকে। তারপর বাড়িতে ফেরার ট্রেনে চাপার পরেই বিপত্তি! গত মঙ্গলবার রাতে সরাইঘাট থেকে ট্রেনে চেপে শিলিগুড়ি আসার কথা ছিল জয় অধিকারীর। ট্রেনে চেপে গভীর রাতে স্ত্রীকে মেসেজ করেছিলেন যে, তিনি কোনও এক ফাঁদে পড়েছেন। বিস্তারিত লিখতে পারছেন না। পরিস্থিতি ঠিক হলেই ফোন করবেন। তারপর থেকেই নিখোঁজ তিনি। সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় হয়ে যায় এই ঘটনায়। এমন অস্বাভাবিক ঘটনার পরে হন্যে হয়ে চলে তাঁর খোঁজ। অবশেষে জয় অধিকারীকে পাওয়া যায় মুম্বইয়ে। কীভাবে সেখানে পৌঁছলেন? কী ঘটল সেই রাতে? কী সেই ফাঁদ?

জয় এবং তাঁর পরিবারের সূত্রে জানা গেছে, সরাইঘাট ট্রেনে বাড়ি ফেরার কথা থাকলেও জেনারেল কামরাতে প্রচুর ভিড় দেখে উঠতে পারেননি জয়। তার ঠিক পরেই পরে তিস্তা তোর্সা ট্রেনটি আসে মালদা স্টেশনে। ওই ট্রেনে উঠতে গিয়েই শারীরিক ভাবে অসুস্থ বোধ করেন জয়। তাঁর মাথা ঘুরে যায়। সম্ভবত খাওয়াদাওয়ার অনিয়মের জন্যই তা ঘটে। পরিবার সূত্রে জানা গেছে, সেই সময় তিস্তা তোর্সা আর কামরূপ এক্সপ্রেস পাশাপাশি ৩ ও ৪ নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়েছিল। ভুল করে জয় নাকি তিস্তা তোর্সাতে না উঠে কামরূপে উঠে পড়েন। কামরূপ এক্সপ্রেসেও জায়গা ছিল না, তিনি জেনারেল কম্পার্টমেন্টের শেষে বাথরুমের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখনই সেখানে পরিচয় হয় কয়েকজনের সঙ্গে। হালকা গল্প চলতে থাকে। জানা গিয়েছে, এই সময়ই তাঁর খিদেও পেয়েছিল। কাছাকাছি কোনও স্টেশনে নেমে খাবার কেনার আগেই সদ্য পরিচয় হওয়া সেই ছেলেগুলির মধ‍্যে একজন তাঁকে তাঁদের সঙ্গে আনা খাবার খেতে অনুরোধ করেন।

আরও পড়ুন- আশ্চর্য মিল! টাইটানিকে মৃত দম্পতির বংশধরই নিখোঁজ ডুবোজাহাজ টাইটানের চালকের স্ত্রী!

ছোটবেলা থেকে অপরিচিত কারও থেকে কোনও খাবার বা পানীয় না নেওয়ার বিষয়টি আমাদের মজ্জায় রয়েছে ঠিকই কিন্তু বাস্তবে মাঝে মাঝে অন্যথাও ঘটে। জয় গল্প করতে করতে সেই খাবার খেয়ে ফেলেন বলেই দাবি তাঁর। অভিযোগ, খাওয়ার কিছুক্ষণ পর তাঁর মাথা ঘুরতে থাকে। শরীরে অস্বস্তি শুরু হয়ে যায়। তিনি আন্দাজ করেন, খাবারে কিছু মেশানো ছিল। বমি করার নাম করে বাথরুমে গিয়ে স্ত্রীকে হোয়াটস্যাপে লেখেন, "ট্রেনে উঠেছিলাম, কিন্তু একটা ট্র্যাপে পড়েছি, খুলে সব বলতে পারছি না, কোনওরকমে মেসেজ করলাম, এখান থেকে বেরিয়ে ফোন করব।" মঙ্গলবার রাত ১২ টা নাগাদ এই ঘটনা ঘটে। জয়ের দাবি, তিনি টলতে টলতে বাথরুম থেকে বাইরে বেরোতেই ছেলেগুলির মধ‍্যে একজন তাঁর থেকে টাকা পয়সা সহ যাবতীয় সব কিছু নিয়ে নেয়। ফোন কেড়ে নিয়ে সিম খুলে ফেলে। ফোন সুইচ অফও করে দেয়। তারপর ওই ছেলেরাই নাকি জয়কে জিজ্ঞাসা করেন যে তিনি কোথায় যাবেন? জয় জানান, শিলিগুড়ি ফিরবেন তিনি। তখন ওই ছেলেদের দল জানায় ওই ট্রেন হাওড়া যাবে। জয় তখন নাকি বুঝতে পারেন ভুল ট্রেনে উঠে পড়েছেন তিনি। শরীর অবশ হতে থাকায় তিনি ওখানেই বসে পড়েন। তারপর নাকি কিছুই মনে নেই তাঁর।

বুধবার সকালে ট্রেন যখন হাওড়ায় পৌঁছয় তখন জয়ের জ্ঞান ফিরলেও নাকি মাথা কাজ করছিল না। নেশাগ্রস্ত অবস্থাতেই ছিলেন। তখন নাকি আবার ওই ছেলেগুলির মধ‍্যেই একজন তাঁকে বলে যে তিনি এখন আর ফিরতে পারবেন না। তাঁর সবকিছু ওই ছেলেরা নিয়ে নিয়েছে। সন্ধ‍্যায় নাকি জয়কে মুম্বইগামী ট্রেনে তুলে দেবেন তারা। ওই ট্রেনেই নাকি তাঁর সব কিছু ফিরিয়েও দেবনে তারা। না হলে সব জিনিস আটকে রেখে দেবেন আর জয়কে ফাঁসিয়ে দেবেন যে তিনি ট্রেনে নেশা করেছেন। জয়ের দাবি, এগুলো শুনে ভয় পেয়ে গেছিলেন তিনি। তাঁর সব প্রয়োজনীয় জিনিস ও সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ব‍্যাগে থাকায় বাধ্য হয়ে নাকি তিনি বাধ‍্য হয়েই মুম্বইয়ের ট্রেনে চাপতে রাজি হন। সারাদিন স্টেশনে বসে কাটান। সন্ধ‍্যায় ওই ছেলেদের কথা মতো মুম্বইয়ের ট্রেনে উঠে পড়েন।

আরও পড়ুন- ‘ফাঁদে পড়েছি’ মেসেজ লিখেই নিখোঁজ! সোশ্যাল মিডিয়ায় তন্নতন্ন করে যে খোঁজ চলছে

জয় নাকি ভেবেছিলেন, ট্রেনে উঠে যখনই ওঁকে সব ফেরত দেওয়া হবে তখনই তিনি চেষ্টা করবেন কোথাও নেমে যাওয়ার। কিন্তু ট্রেনে উঠেই নাকি জয় আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরলে দেখেন ট্রেন কোনও এক অচেনা স্টেশনে। টিটি টিকিট চাইলেও নাকি টাকা না থাকায় হাতে পায়ে ধরে ম্যানেজ করেন। আবার ঘুমিয়ে পড়েন। এবার ঘুম ভেঙে দেখেন ট্রেন মুম্বইয়ের দাদার স্টেশনে দাঁড়িয়ে। জয়ের দাবি জিআরপি-তে গিয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলেন তিনি। জিআরপি নাকি বলে টাকা জোগাড় করে আনলে টিকিটের ব্যবস্থা করে দেবেন তারা। জিআরপি নাকি তাঁকে বসিয়েই রাখে। জয় ব‍্যাগ ঘাঁটতে গিয়ে দেখেন তাঁর মোবাইল ও সিন ব্যাগেই আছে আলাদা করে। তারপর বাড়িতে ফোন করেন তিনি। সংস্থার ম‍্যানেজার নাকি তাঁকে টাকা পাঠান। তাঁর চাকরির সংস্থাই নাকি রবিবার সকালে মুম্বই থেকে বাগডোগরা বিমানের ব‍্যবস্থা করে দেয়। 

কাহিনি দীর্ঘ কিন্তু তা সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য কি? শিলিগুড়ি জিআরপির ডিএসপি অরিজিৎ পাল চৌধুরী বলেছেন, “জয় আমাদের প্রাথমিকভাবে বলেছেন, কেউ তাঁকে জোর করে ভয় দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছে। সেই মতো আমরা ওঁর থেকে একটি লিখিত অভিযোগ নিয়েছি। তবে অপহরণ কিংবা চুরির কোনও ঘটনা ঘটেনি।” সিসিটিভি ফুটেজ বলছে, মালদা থেকেই তিনি অন্য ট্রেন ধরেন এবং হাওড়ায় যান। হাওড়া স্টেশনেও তাঁর ফুটেজ পাওয়া গিয়েছে বলে খবর। কিন্তু জয়ের বক্তব্যে একাধিক অসঙ্গতি পাওয়া যাচ্ছে। সূত্রের খবর, ঘন ঘন বক্তব্য বদলাচ্ছেনও তিনি। যেমন, একবার বলেছেন, দু’জন তাঁকে নিয়ে যাচ্ছিল। পরে বলেছেন, তিনজন। একবার বলেছেন, দুই যুবক ছিলেন, পরে বলেছেন, বয়স্ক লোক। জয়ের সঙ্গে থাকা কোনও জিনিসই খোয়া যায়নি। ফলে চুরির কোনও ধারাও তদন্তে যোগ করা যাচ্ছে না। ট্রেন ধরতে গিয়ে ভুল হয়ে যাওয়া, ট্রেনে অপরিচিতের থেকে খাবার খাওয়ার মতো ঘটনা শিশুর সঙ্গে ঘটলেও বিশ্বাসযোগ্য, একজন প্রাপ্তবয়স্ক, যিনি হামেশাই কাজের জন্য ট্রেনেই সফর করেন তিনি এই ভুল করলেন কীভাবে? তারপর হাওড়া এসে কী এমন ভয় পেলেন যে সেখানে কোনও পুলিশকে না জানিয়ে মুম্বই যেতে রাজি হয়ে গেলেন! কী এমন নেশা করানো হলো তাঁকে? প্রশ্ন অনেক, কুয়াশাও কাটাতে পারেননি জয় নিজেও।  

More Articles