হাতের জাদুকর, রসের কারিগর

Siulis and Kalbamshi of Bengal: কোনও পাঠ্যপুস্তকে, কোনো বইতে, মূলস্রোতের কোনো সামাজিক চর্চায় কি শিউলিদের শিল্পী বলা হয়েছে কখনো? হবে?

মোরাঘাট থেকে বাঁদিকে ঘুরলে তোতাপাড়া, মোগলকাটা, খুট্টিমারি, মেলাবস্তি পেরিয়ে খুকলুং। গা ঘেঁষে জঙ্গল। নভেম্বরের শেষে দুধের সরের মতো পাতলা শীত। সক্কাল সক্কাল শিলটুংবান নদীর পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছি আমি আর কাঞ্চনদা। খানিক পরে এখান থেকেই মেন্দাবাড়ি যাওয়া। সেখানে সারাটা দিন ধরে টানা কাজ। কচিকাঁচারা স্টাডি করবে জঙ্গলে বসে, আঁকবে নিজেদের গ্রাম। তাই নিয়েই কথা চলছে। আর, নদীর ঠিক পাশটায় এক বুড়ো ঝুঁকে পড়ে কাটছেন বেতের মতো সরু-সরু বাঁশ। তারপর, এনে জড়ো করছেন আপাত শুকনো একটা ঘাসজমিতে। কাঞ্চনদা দ্রুত ভাষা শিখতে পারে। অল্প কদিনেই বেশ খানিক রপ্ত করে ফেলেছে রাভাভাষা। আমি শুনে শুনে তাও খানিক বুঝি, কিন্তু বলতে গেলেই লোকজন হাসাহাসি শুরু করে। অতএব, কাঞ্চনদাই প্রশ্ন করে, গল্প জমায়। সেই বুড়ো বলেন, মনের মতো বাঁশ মিলছে না। সোজা আর লম্বা বাঁশ। যার ভিতর দিয়ে এপার-ওপার টানা দেখা যাবে। যেখানে কোথাও বাতাস আটকাবে না। তবেই না ভিতরের দেওয়ালে দেওয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে বেরিয়ে আসবে সুর। কাঞ্চনদার ভাষাজ্ঞানও এই কথার থই পায় না। আমি দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমাদের দেখে লোকটা হাসেন, বলেন, “কালবামশি দেখোনি? দেখবেই বা কী করে? কজনই আর বাজায়? অথচ, কদিন আগেও রাভাদের প্রতিটা গ্রামে থাকত কালবামশি আর ইয়াব্বড়ো হেম। এখন ওসব আর মেলে না...”

আমাদের মেন্দাবাড়ি যাওয়া পিছিয়ে যায় এরপর। সেই বৃদ্ধ মানুষটি আমাদের নিয়ে যান তাঁর বাসায়। নিয়ে আসেন একটা লম্বা বাজনা। বাঁশি। লম্বায় কমপক্ষে আটফুট। বাঁশের মোটা গোড়ায় একটা সরু ও সোজা বাঁশ আটকানো। সেই বাঁশি হাতে নিয়ে বাজাতে শুরু করেন। ইনিয়ে-বিনিয়ে একটা সুর ধাক্কা খেতে থাকে পাতলা জঙ্গলের এক গাছ থেকে অন্য গাছে। সেই সুরে রাভাদের কতদিনের পরিযায়ী ইতিহাস পাক খাচ্ছে। বাজাতে বাজাতে বুড়ো কেশে ওঠেন। বলেন, “আজকাল দম থাকে না। আর কদিনই বা বাঁচব। কেউ তো শিখলও না। বাঁশই চেনে না, আর বাঁশি...”

আমি জিজ্ঞেস করি, আমরা যদি কতগুলো বাঁশি নিয়ে যাই, বানিয়ে দেবেন? দাম দেব। বাঁশিগুলো বাঁচিয়ে রাখতে চাই আসলে। সেই বুড়ো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। বলেন, “এর জন্য দাম দেবে? কেন দেবে? আর, বাঁশি কে বাজাবে? সুর কোথায় পাবে? কেউ তো শিখল না...”

উত্তরবঙ্গের এক বনবস্তি থেকে অন্য বস্তিতে ঘুরতে ঘুরতে আমার কানে বাজে সেই কথাগুলো। নিরীহ অথচ দৃঢ় নাকচই যেন। আর আক্ষেপ। “কেউ তো শিখল না...”। রাভারাই যখন শিখল না, তোমাদের দিয়ে কী করব?

কুরমাই গ্রামে নড়াইয়ের বুড়ো কাকা সারাদিন ধরে ঘাড় গুঁজে বসে বুনে দিয়েছিলেন সরু কঞ্চির টুকরি। এই টুকরি বা সরু মুখের ঝুড়ি দিয়ে রাভা আর মেচরা মাছ ধরেন। আমার মনে হয়েছিল, এমন চমৎকার জিনিস কলকাতার বাড়িতে নিয়ে এসে সাজিয়ে রাখব। নড়াইয়ের কাকা, দিদা, নড়াই, নড়াইয়ের বোন জ্যোতি সবাই শুনে হেসেছিল। এসব কেউ বাড়িতে নিয়ে যায়! এ কী রাখার মতো জিনিস গো! এ তো কিনতেও পাওয়া যায় না। তাই, নড়াইয়ের বুড়ো কাকা আমাকে বানিয়ে দিলেন। সারাদিনের পরিশ্রমে মাত্র একটা। আমি দাম দিতে চাইলে রে রে করে ওঠেন। “এর কোনো দাম আছে নাকি! কে বেচে এসব?” আমি অবাক হয়ে ভাবি, সারাদিনের পরিশ্রমে তৈরি হওয়া একটা অদ্ভুত সুন্দর জিনিসের কোনো দাম নেই! কোনো বিনিময় মূল্য নেই! আমি বলেই ফেলি, এটা তো দিব্বি একটা হস্তশিল্প। হস্তশিল্প... রাভাভাষায় এর কোনো অনুবাদ হয় না। হস্তশিল্প কী, কাকে বলে, রাভারা জানেনি কোনোদিন। জানার প্রয়োজনই যে হয়নি।

তাই হয়তো আলিপুরদুয়ায়ের, চিলাপাতা অরণ্যের ভিতরে, এই প্রান্তিক বনগ্রামে, ঘুরতে থাকা অভ্যেসে, চর্যায়, এই দক্ষতার, শিল্পবোধের কোনো পোশাকি ‘দাম’ নেই। আমার মতো কোনো শহুরে বাবু ‘আবিষ্কার’ না করলে এই টুকরি বা ওই কালবামশি সম্ভবত কোনোদিন শহরের হস্তশিল্প মেলায় আসবে না। ঝকঝকে কোনো বিপণিতে বিক্রি হবে না। প্রাইস ট্যাগের সঙ্গে জুড়ে থাকা ট্যাগে যে-গল্পটা না-লিখিত থেকে যাবে, সেই গল্প শুনলে নড়াইয়ের কাকা হাসবেন। তাঁর চশমার ঘষা কাঁচে একটা ছোট্ট বুনো পোকা এসে বসবে। যেমন রোজ বসে। যেমন, তিনি রাতে টংবাড়িতে উঠে ফসল পাহারা দেন। যেমন, হাতি এসে ধান লণ্ডভণ্ড করে যায়। নড়াইয়ের ছোঁড়া তির তার পিঠে মশার কামড়ের মতো জ্বালা ধরায় মাত্র। এসবই যেমন সহজ ও স্বাভাবিক, তেমনই সহজ এই টুকরি, বিশুখার মায়ের তাঁত বোনা। আর, সেই বুড়ো মানুষটার কালবামশি। রাভারা বাদে অন্য কেউ তো সেই বাঁশি বাজাতেই পারবে না। সুর তো থাকে হাওয়া-বাতাসের মজ্জায়, এই নদীর জলে, শয়ে-শয়ে বছর ধরে হাতি-বাঘ-গণ্ডার-ভাল্লুক-মশা-ম্যালেরিয়ার সঙ্গে যুঝে, বেঁচে থেকে গড়ে তোলা জঙ্গলের কোণায় কোণায়, দিনাতিদিনের যন্ত্রণায়, বিস্ময়ে, আক্ষেপে। সেই সুর তোমরা কীভাবে চিনবে হে? বাঁশি বানিয়ে দিলে কী করবে? বেচবই বা কেন?

হস্তশিল্প কাকে বলে, তার সংজ্ঞা আলাদা করে বোঝার চেষ্টা করিনি কখনো। খুকলুং-এর সেই বুড়ো আর নড়াইয়ের কাকাও বোঝেননি। নিজেদের শিল্পী বলে মনেও করেন না তাঁরা। কিন্তু আমাকে তাঁরা ঘাড় ধরে শিখিয়েছিলেন, এই চিনতে না পারা শিল্পেরও শিকড় হয়। সেই শিকড়ের জোর থাকলে নাকচের মাধুর্য মধুর থেকেও ঘন হয়ে ওঠে। শিল্পকে তখন বাজারের ‘দাম’ দিয়ে মাপা যায় না। অন্তত, যদি শিল্পী সেই ‘দাম’ নিতে না চান।

মেদিনীপুরের একটা বাগানবাড়িতে সারারাত ধরে আমাদের গল্প শুনিয়েছিলেন জাদুকর অমর সেন। ‘দ্য গ্রেট হ্যান্ডশ্যাডোগ্রাফার অমর সেন’। সেও পাতলা শীতের রাত। সামান্য গান, হাতসাফাইয়ের খেলা আর ছায়াবাজি। আঙুলের সামান্য ভাঁজে হরিণ হয়ে ওঠে টুপি পরা সৈনিক, কখনো বা অট্টহাস্য করা বৃদ্ধ। স্বভাবসিদ্ধ রসবোধে অমরদা সেদিন বলেছিলেন, “এসব কিন্তু নিখাদ হস্তশিল্প।”

কে না জানে, রসবস্তু ছাড়া শিল্প হয় না। হস্তশিল্পও না। কিন্তু, হস্তশিল্পর রসবস্তু ঠিক কতটা বিচিত্র? কতটা বহুপথগামী?

বছর দেড়েক আগে সুমিতদা, সাংবাদিক সুমিত দাস, আমাকে একদিন বলল, “চিনি এসে সব নষ্ট করে দিল বুঝলি! গুড় নিয়ে এবার একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে!” আমি স্বভাবপতনশীল মানুষ। অতএব, আকাশ থেকেই পড়লাম। ক্রমে জানলাম, সুমিতদা ‘বাংলাপণ’ নামে একটা কর্মকাণ্ড শুরু করেছে। বাংলার নিজস্ব আর ঐতিহ্যশালী খাদ্যপণ্য ও হস্তশিল্প নিয়ে কাজ করছে। সেই সূত্রেই গুড়। আমি গুড়ের কিছুই বুঝি না। সুমিতদাই বলল, গুড় বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পদ। নীহাররঞ্জন নাকি লিখে গেছেন, এমনকি সুকুমার সেনও, গুড় থেকেই গৌড়। সাবেক ও প্রাক-ঔপনিবেশিক অখণ্ড বাংলাকে গুড় দিয়েও চেনা সম্ভব। তাই, বাংলার খাঁটি আর সেরা স্বাদের গুড় সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার কাজ খুব জরুরি। জরুরি, শিউলিদের বাঁচিয়ে রাখাটাও। বাংলার শয়ে-শয়ে শিউলি প্রতি বছর পেশাচ্যুত হচ্ছেন। ভিন রাজ্যে শ্রমিক হয়ে চলে যাচ্ছেন। কারণ, হাতে টাকা নেই। গুড়ে চিনির ভেজাল মিশছে। খাঁটি গুড়ের স্বাদ লোকে ভুলেই গেছে। প্রজন্মবাহিত একটা জ্ঞান আর শিক্ষার কোনো মূল্য থাকছে না। গাছোয়াল বা গাছি আর শিউলিরা তাই বিপন্ন সম্প্রদায় হয়ে উঠছে ক্রমশ। “অথচ, এঁরা তো নিছক উৎপাদক নন। এঁরা শিল্পী। শিল্পের দামটাই তো তাঁরা পাচ্ছেন না...”

সুমিতদার কথায় ধাঁধাঁ লেগেছিল। গুড় একটা অতি মূল্যবান সাংস্কৃতিক খাদ্যসম্পদ, সে নাহয় বোঝা গেল। কিন্তু শিউলিরা শিল্পী?

কলেজে পড়ার সময় মুকুন্দরামের কাব্যে পড়েছিলাম, ‘সিউলী নগরে বৈসে, খেজুরের কাটি রসে, গুড় করে বিধির বিধানে’। বিধির বিধান ছাড়া গুড় হয় না। তবে কি, গুড় তৈরি সত্যিই খুব গুরুতর ব্যাপার? অথচ, বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘পুরুষ অতি নীচজাতীয় পাষণ্ড—বোধ হয়, ডোম কি সিউলি!’ এত ‘নীচ’ জাতিভুক্ত উৎপাদকদের হাতে দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী জুড়ে বাংলার গৌরব উজ্জ্বল হয়ে বসে ছিল! সেই খাদ্যসম্পদ জাহাজ-ভর্তি করে লুটে নিয়ে যাচ্ছে পর্তুগিজ হার্মাদদের দল। কখনো বণিকদের হাত ধরে তা পৌঁছে যাচ্ছে ভিনদেশের বন্দরে। অধুনা ভারতের পশ্চিমপ্রান্ত মজে উঠছে পাটালির স্বাদে...

কিন্তু, সেসব তো একটা আশ্চর্য বুনোজাতীয় গাছের ‘রস’-এর কামাল। তার সঙ্গে শিউলিদের হাতযশের সম্পর্ক কী! শিল্প কি এতই সহজসাধ্য একটা শব্দ!

এরপর, মাজদিয়ার রমেশ মণ্ডল আর সঞ্জীব প্রামাণিক কিংবা বাঁকুড়ার পায়রাচালির দিলীপ শবরের সঙ্গে আমার পরিচয় হবে। তাঁরা আমায় বোঝাবেন গুড়তত্ত্ব আসলে গূঢ়তত্ত্ব। তার সাধন বাকপথাতীত। তা সহজসাধ্য নয়। সকলের সাধ্যও নয়। তার জন্য সত্যিই পরম্পরাবাহিত জ্ঞান আর প্রজ্ঞা প্রয়োজন। রসিক আর সাধক না হলে সে তত্ত্বের থই মিলবে না। শহরের শিক্ষিত বাবুরা সেই প্রক্রিয়ার ডকুমেন্টেশন করতে পারেন রাতের পর রাত জেগে। কিন্তু তাদের হাতে রস খেলবে না। সঞ্জীবদা হাসতে হাসতে বলেছিল, “সবাই তো সব পারে না।”

কী পারে না? উত্তর হল- রসের গাছ চেনা। গাছ দেখে, গাছের পাতা দেখে, গাছের বুকে টোকা মেরে বলে দিতে পারা, কোন গাছে রস ভালো হবে। আমি বেকুবের মতো জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কীভাবে বোঝেন?” রমেশ মণ্ডল উত্তরে বলেছিলেন, “বাপ-ঠাকুর্দা শিখিয়ে গেছে। আমরাও জন্ম ইস্তক দেখে দেখে দেখে শিখেচি।”

তারপর, গাছোয়াল বা গাছি গাছে চড়বে। গাছের মাথা পরিষ্কার হবে। পুরনো পাতা কেটে ফেলা হবে। সারা রাত জেগে গুড় জ্বাল দেওয়া সঞ্জীবদা লালচোখ করে বলবে, “যেভাবে গাছ কাটি, সেভাবে গুড় হবে। গাছ যত শুকোবে, সেই গাছ যত ইশারায় কাটা যাবে, রোশনি কুয়ার মতো যদি কাটা যায়, তবে, রসটা হয়েই সে গাছ শুকিয়ে যাবে। তাহলে জিরেনের পর সেই গাছে জিরেন কাটের গুড় হবে খাসা। আর, মোটা করে কাটলে সেই গাছ কাঁচিয়ে যাবে। অনেকদিন আর রস হবে না।”


সঞ্জীবদার কথা জড়িয়ে আসে। অনেক শব্দের অর্থ স্পষ্ট হয় না। তবু, বোঝা যায়-- শিউলি কাতান বা হাঁসুলির কোপের সামান্য তারতম্যে রসের স্বাদ বদলে যাবে। কাটার নকশা সামান্য বদলে গেলে জিরেন-কাটের গুড় মিলবে না। গাছ কাঙ্ক্ষিত শুকোবেই না। তাই, যাঁরা দড় শিউলি বা গাছি, তাঁদের হাতে গাছের রস প্রাণ পায়। তাঁরা বড়ো যত্ন করে কাটেন। আরো যত্নে ঢুকিয়ে দেন সরু কঞ্চি। সেই কঞ্চি বেয়ে বেয়ে ভোরের প্রথম ও মধুরতম রস জমা হয় হাঁড়িতে। সেই রসভর্তি হাঁড়ি নামিয়ে আনার পরে দিনমানে জমবে ঝরা-রস। সে রসের স্বাদ পাতলা। জাত নিচু।

কিন্তু ভোরের প্রথম সেই খাঁটি রস জ্বাল দিলেই তো নলেন হবে না। সেই জ্বাল দেওয়ার পন্থা অতি জটিল। ঠিক কতক্ষণ জ্বাল দিলে টকটকে লাল বা মধুর মতো হবে গুড়ের রঙ, তা চেনে জহুরির চোখ। তবে, শুধু জ্বালের সময়পর্ব নয়, অন্য মাপকাঠিও আছে। কতখানি শীত পড়ল, কতখানি কুয়াশা, কতখানি হাওয়া বইল— সেইসব মেনে খাঁটি নলেন গুড়ের জন্মক্ষণ নির্ধারিত হয়। সব জিরেনের রসেই নলেন হয় না। দিন-ক্ষণ-পরিবেশ আর শিউলির হাতযশ, সবটা মিলে সেই অমৃতের জন্ম।

দৈনন্দিন ঝোলাগুড় আর নলেনের মাঝে বিছিয়ে থাকে এমন বিস্ময়কর উপাখ্যান। যে উপাখ্যান বছরের পর বছর লিখেই যাচ্ছেন বাংলার শিউলিরা। তাঁদের প্রজ্ঞা আর চোখ, অভিজ্ঞতা আর দক্ষতা সেই উপাখ্যানে রসসঞ্চার করছে।

যেমন, নলেনের মাড়ি বা মাড় ক্রমে শুকিয়ে আসলে পরে পাটালি। তারও পরে শুকনো গুড়, আমরা যার নাম দিয়েছিলাম ‘ঝুরা’। বিচকাঠি দিয়ে বিচ মারতে মারতে, কেলাসীভবনের ব্রাহ্মমুহূর্তে শিউলি পাশা ফেলে দেন। চুলা নিভে যায়। তার আগে অবশ্য উত্তর থেকে দক্ষিণে শুকনো হাওয়া বইতে হবে। খাঁটি জিরেন রস মিলতে হবে। জবাকুসুম সূর্যকে সাক্ষী রেখে বেদজ্ঞানে নাপাক শিউলির দল সেই রস এনে ঢালবেন চুলায়। তবেই ঝুরা উঠবে। দিলীপ শবর আমাদের বলেছিল, “বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার শুকনো জলবায়ু ছাড়া ঝুরা সম্ভবই না। যেমন, নদিয়ার মাটি ছাড়া সম্ভব না স্বর্গীয় তরল নলেন।”

আর সুমিতদা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “সঞ্জীব বা দিলীপ কি শিল্পী নয়? কিংবা রমেশ?” চোখ, বোধ আর হাতের কারবারই তো সবটা জুড়ে। হাতের জাদু বুনে বুনে রসের কারিগর। শিল্পী আর কাকে বলে! কিন্তু কোনো পাঠ্যপুস্তকে, কোনো বইতে, মূলস্রোতের কোনো সামাজিক চর্চায় কি শিউলিদের শিল্পী বলা হয়েছে কখনো? হবে? ‘শিল্পী’ নামক উন্নত তকমা কি এমন উৎপাদকদের গায়ে লাগতে পারে! সেই কবে নরেন্দ্রনাথ মিত্র তাদের নিয়ে একটা গল্প লিখে ফেলেছিলেন, ব্যাস! সেই অনেক। তাছাড়া, বোকাদের কে পাত্তা দেয়! যেখানে খাঁটি আর ভেজাল গুড়ের কোনো বাছবিচারই নেই, সেখানে আবার নলেন আর ঝোলাগুড়ের পার্থক্য! যেখানে শীতই আর সেভাবে পড়ে না, সেখানে আবহাওয়া বুঝে রসের তারতম্য! এসব শিক্ষা নিয়ে পড়ে থাকে বোকারা। বেহদ্দ বোকারাই।

বড় আর ভারী শিল্পের পাশে হস্তশিল্প বরাবরই ‘ক্ষুদ্র’। ব্যবসার ভাষায় বিশেষ ‘ট্যানজিবল’ নয়। এবং সেই দুয়োরানির রাজত্বেও অনেকে ঢুকতে পারেন না। তারা এই দুনিয়ারও বাইরে। মাজদিয়ার অধিকাংশ শিউলির মতোই, প্রকৃতপ্রস্তাবে, ছিন্নমূল। তাঁদের জ্ঞান আর দক্ষতার ক্ষয়িষ্ণু বাজারমূল্য হয়তো আছে, কিন্তু স্বীকৃতি নেই। আর, আমার কাছে শিল্পের দুনিয়াটাই গোলানো মনে হয়। কোথাও শিল্পীরা ‘দাম’ নাকচ করেন। বাজার নাকচ করেন। তাঁরা শিল্পী কিনা নিজেরাই জানেন না। জানতে চানও না হয়তো। কোথাও আবার, শিল্পীরা দামই পান না। বাজার তাঁদের পেশাচ্যুত করে। অবশ্য, দ্বিতীয়পক্ষও জানেন না, তাঁদেরও শিল্পীর মর্যাদা প্রাপ্য। দুদিকেই জমাট বেঁধে থাকে প্রজন্মবাহিত জ্ঞান আর দক্ষতার ইতিহাস। অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতা। বাজারমূল্যে কোনোটা ‘আবিষ্কারসাপেক্ষ’, কোনোটা ‘সংরক্ষণযোগ্য’, কোনোটা ‘স্বাভাবিক নিয়মেই বিলুপ্তপ্রায়’।

আর, আমাদের মতো পুঁথিপড়া শিক্ষিত শহুরে বাবুরাই বসে আছি সেই বাজারমূল্য ঠিক করব বলে।

More Articles