আজকের ভারতেও বহাল লজ্জার দাসপ্রথা! শিউরে উঠতে হবে বাস্তব জানলে
Bonded Labour in India: সংবিধানের পরিপন্থী, তবু বেগার শ্রম বহাল ভারতে।
প্রাচীনকালের সমাজব্যবস্থায় বহু নারী-পুরুষকে 'ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী' হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হতো। বিনিময়ে কোনওক্রমে ব্যবস্থা হতো খাওয়া-পরার। আর কথায় কথায় শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হতো ওই 'ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী'-দের।
প্রকৃতির নিয়মে সময় এগিয়েছে। এক যুগের অবসান হয়ে নতুন যুগের আবির্ভাব হয়েছে। এ-সত্ত্বেও কিছু অভিশাপ নির্মূল করা যায়নি। ভারতে আজও 'ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী' হিসেবে কাজ করানো হচ্ছে দরিদ্র, অসহায় নিম্নবর্ণর মানুষকে।
দেশের স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে 'আজাদি কা অমৃত মহোৎসব' দেশজুড়ে ঘটা করে পালিত হচ্ছে। আবার একইসঙ্গে জাতপাতভিত্তিক ভারতীয় সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একাংশকে কার্যত বিনা পারিশ্রমিকে স্রেফ বেগার খাটিয়ে নিচ্ছেন উচ্চবর্ণের মানুষজন। অথচ এই ব্যবস্থা অচিরে বিলুপ্ত হলে সবঅর্থেই তা হতে পারত স্বাধীন ভারতের পক্ষে মঙ্গলদায়ক।
আরও পড়ুন: ভারতে হু হু করে বাড়ছে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা, কেন এই পরিস্থিতি দেশের শৈশবের?
আজও 'ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী' বহাল কেন? এর অন্যতম প্রধান কারণ উচ্চবর্ণের প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছ থেকে বিপদে পড়ে ঋণ নেওয়ার পরে সেই কর্জ চোকাতে না পারা। এর জেরে নিম্নবর্ণের সংকটাপন্ন মানুষটিকে বেগার খাটানো হচ্ছে বিনা পারিশ্রমিকে। এ-ব্যাপারে একটি উদাহরণ পেশ করা যাক।
ঘটনাটি মহারাষ্ট্রের পালঘর জেলার। ছেলের আকস্মিক মৃত্যুর পর সন্তানহারা বাবার কাছে মৃত ছেলের শেষকৃত্য করার মতো টাকা ছিল না। সেই কারণে তিনি কয়েকশো টাকা ঋণ নেন গ্রামবাসী উচ্চবর্ণের এক ব্যক্তির থেকে। ছেলের শেষকৃত্যের জন্যে ৫০০ টাকা ঋণ পরিশোধ করার সঙ্গতি না থাকাতে কালু পাওয়ার নামে ওই দরিদ্র ব্যক্তিকে সকালে জলখাবার বাবদ বরাদ্দ পোড়া রুটি এবং নামমাত্র রাতের খাবারের বিনিময়ে দিনের পর দিন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয়েছে। এরপর ঘটনাটি সংবাদ মাধ্যমের নজরে আসায় চাঞ্চল্য ছড়ায়।
অথচ ব্যাপারটা অন্যরকমও হতে পারত। দুর্ভাগ্যজনক কারণেই তা হয়নি বলা যায়। দক্ষিণ এশিয়ার অন্তর্গত দেশগুলির মধ্যে ভারতই প্রথম বেগার শ্রম থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিল। ১৯৭৬ সালে ভারতে বেগার শ্রম আইনত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
তাতে কাজের কাজ এ-পর্যন্ত তেমন কিছু হয়নি। যদিও ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকল নম্বর ২৩ অনুসারে কোন নাগরিককে বেগার শ্রমে বাধ্য করাটা পুরোপুরিভাবে বেআইনি।
যে মানুষজনকে বেগার শ্রম দিতে বাধ্য করা হচ্ছে ওঁরা ন্যূনতম পারিশ্রমিক পর্যন্ত পাচ্ছেন না বলে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর অভিযোগ। এদিকে ১৯৪৮ সালেই ভারতে ন্যূনতম মজুরি সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন হয়েছে। এই আইন অনুসারে বেগার খাটানো পুরোপুরি বেআইনি।
এরপরও ১৯৭৬ সালে ভারত সরকার 'দি মিনিমাম ওয়েজ অ্যাক্ট'-এর প্রণয়ন করে সাফ জানিয়েছে, ন্যূনতম মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তির সর্বাধিক ৩ বছর পর্যন্ত কারাবাস এবং জরিমানা-বাবদ নগদ ২ হাজার টাকা দিতে হবে। ইন্ডিয়ান পেনাল কোডেও বেগার খাটানো এক দণ্ডনীয় অপরাধ।
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ১৯৭৬ সালে বেগার শ্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরে সেইসময়ে সরকারি উদ্যোগে বেগার শ্রম দিতে বাধ্য হচ্ছেন কত সংখ্যক শ্রমিক এই সংক্রান্ত খতিয়ান তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত সাতের দশক এবং আটের দশকজুড়ে সরকারি উদ্যোগে পুনর্বাসনেরও ব্যবস্থা করা হয় একই সঙ্গে।
কিন্তু নয়ের দশক থেকে যাঁদের বেগার শ্রমে নিযুক্ত করা হয়েছে, তাঁদের চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়াটাই শ্লথ হয়ে পড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রক এই সংক্রান্ত যে রিপোর্টটি পেশ করেছে, সেই অনুযায়ী, ভারতে এখন ৩ লক্ষ নাগরিক বিনা মজুরিতে অথবা অতি স্বল্প মজুরিতে বেগার খাটছেন। বেশিরভাগ সময়ে দুর্দিনে উচ্চবর্ণের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ ফেরত দিতে না পারাতে এঁদের বেগার শ্রম দিতে হচ্ছে।
প্রাচীনকালেও এদেশে 'ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী' প্রথার চল ছিল। এই শোষণ যুগ যুগ পেরিয়েও আজও বহমান। এই পরিস্থিতিতে অবহেলা, নিপীড়নের যে শৃঙ্খলে আবদ্ধ ভারতমাতার সন্তানদের একাংশ, সেই শৃঙ্খলের মোচন হবে কবে, এই প্রশ্নের উত্তর আজও অনুচ্চারিত। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বেগার শ্রমের রীতি এদেশের সমাজব্যবস্থায় বহাল জাতপাতের মাত্রাতিরিক্ত প্রাদুর্ভাবের কারণেই।
অথচ ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকেল নম্বর ৪২ এবং আর্টিকেল নম্বর ৪৩-এ পরিষ্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে, বেগার শ্রম পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কাজের উপযুক্ত পরিবেশেই শ্রমিককে দিয়ে কাজ করাতে হবে। আর দিতে হবে যথাযথ পারিশ্রমিকও। অন্যথায় তা বেআইনি।
বেগার খাটা শ্রমিকদের আর্থসামাজিক সুরক্ষা দিতে বেগার শ্রম নিষিদ্ধ করতে দেশের যে রাজ্যগুলির সরকার সর্বাগ্রে পদক্ষেপ নিয়েছে সেই রাজ্যগুলির ভেতর রয়েছে ওড়িশা, রাজস্থান এবং কেরল।
বেগার খাটা নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতে ১৯৭৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকার পুনর্বাসন প্রকল্প চালু করে। এরপর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পরে ২০১৬ সালে ওই পুনর্বাসন আইনে কিছু রদবদল আনা হয়। খাতায়-কলমে এই যে পরিবর্তন সেও নিতান্তই কথার কথা হিসেবে থেকে গিয়েছে।
ভারতের মাটি থেকে জাতপাতের বৈষম্য যতদিন পর্যন্ত না সমূলে বিনষ্ট হবে, সেপর্যন্ত দরিদ্র, নিম্নবর্ণের মানুষকে জাতপাতের নিরিখে শোষণ চলবেই, সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আসলে সর্ষের মধ্যেই ভূত থেকে গিয়েছে।
স্বেচ্ছাসেবীদের মতে, অবহেলিত নিম্নবর্গের মানুষজনের জন্যে অবিলম্বে পেশাগত প্রশিক্ষণ শিবির চালু করা হোক। এই ব্যবস্থা নেওয়া হলে একদিকে স্বাবলম্বী হবেন নিপীড়িত নাগরিকরা, পাশাপাশি জীবনের প্রতি ওঁদের আত্মবিশ্বাসও বাড়বে। বেগার শ্রমে বাধ্যও করা যাবে না।
এদিকে বিধি বাম। একাধিক সমী্ক্ষায় দেখা যাচ্ছে, বেগার শ্রমের নিরিখে দেশের ভিতর প্রথম স্থানাধিকারী রাজ্য কর্নাটক। এরপরই তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে তামিলনাড়ু, উড়িষ্যা, উত্তরপ্রদেশ ও দক্ষিণ ভারতের আরেকটি রাজ্যে অন্ধ্রপ্রদেশ।
১৯৭৮ সালে বেগার শ্রমে নিযুক্তদের উদ্ধারের পরে কেন্দ্রীয় সরকার একটি প্রকল্প চালু করে নিপীড়িতদের পুনর্বাসনের স্বার্থে। ওই প্রকল্পের নাম 'রিহ্যাবিলিটেশন অব বন্ডেড লেবার'। এক্ষেত্রে উদ্ধারের পরে বেগার শ্রমে নিযুক্ত পুরুষদের মাথাপিছু ১ লক্ষ টাকা এবং মহিলা, শিশুদের মাথাপিছু ২ লক্ষ টাকা আর্থিক সহায়তার কথা বলা হয়েছে। যদিও কার্যত এই-ই দেখা যাচ্ছে, বছরের পর বছর পেরিয়েও সরকার নির্ধারিত ওই আর্থিক সহায়তা মিলছে না।