শেষের পথে মেঘালয়ের সবুজ

সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই ধীরে ধীরে শেষ হতে শুরু করেছে মেঘালয়ের এই অরণ্য। ভারতের সবথেকে বড় বৃষ্টি-অরণ্য যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সারা ভারতের জন্য তা হয়ে উঠবে সমস্যার।

একটা সময় এমন ছিল যখন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মেঘালয়ে গ্রীষ্মকালীন বৃষ্টির দিনে বর্ষণের পরিমাণ থাকত প্রবল। মেঘালয়-চেরাপুঞ্জি এবং মফালাং অঞ্চলের জন্য একনাগাড়ে বৃষ্টি ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতি গ্রীষ্মকালে এমন একটা সময় আসত যখন একনাগাড়ে ৯ দিন এবং ৯ রাত্রি ধরে বৃষ্টি হত ভারতের সবথেকে বড় বৃষ্টি-অরণ্যের রাজ্যে। পুরো মেঘালয় যেন স্তব্ধ হয়ে যেত এই সময়ে। প্রাপ্তবয়স্করা কাজে যেতে পারতেন না, শিশুদের স্কুল ছুটি থাকত, বাজার পর্যন্ত থাকত বন্ধ। এমনকী, মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়েও পরিবেশ থাকত এরকমই। এসব দিন আজ অতীত। বৃষ্টির মরশুম এলেও, সেরকমভাবে আর বৃষ্টি হয় না মেঘালয়ে। ঔষধি গাছ, গোলাপি রঙের রডোডেনড্রন, ওক গাছের সারি, আজ অনেকটাই নিস্তেজ। শিলংয়ের বিখ্যাত কমলালেবুর মিষ্টতাও কমেছে অনেকাংশে। বৃষ্টির পরিমাণে এসেছে পতন, পাশাপাশি মেঘালয়ের পরিবেশও যেন পরিবর্তিত হয়েছে একই ছন্দে। বৃষ্টি-অরণ্যেও এসেছে পরিবর্তন। আর এই পরিবর্তন ভারতের সার্বিক পরিবেশের জন্য খুব একটা ভালো নয়।

২০১২ পর্যন্ত বৃষ্টির মরশুমে মেঘালয়ের বৃষ্টির পরিমাণ মোটামুটি একইরকম ছিল। খুব একটা পরিবর্তন মেঘালয়ের বৃষ্টির ক্ষেত্রে দেখা যায়নি এতদিন পর্যন্ত। ২০১৭ সালের আইআইটি গান্ধীনগরের একটি রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, গত ৩২ বছর ধরে প্রায় প্রতি বছর ওই এলাকায় বৃষ্টিপাত ১১.৫ মিলিমিটার করে বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু এখানে সমস্যাটা ছিল তাপমাত্রা বৃদ্ধি। গান্ধীনগর আইআইটির ওই রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, গত ৩২ বছরের প্রতি বছরে ০.০৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।

পাশাপাশি আইআইএসসি ব্যাঙ্গালোরের বিশেষজ্ঞ এনএইচ রবীন্দ্রনাথ এই বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ করেছেন উদ্বেগ। মেঘালয়ের জঙ্গলের অবস্থা নিয়ে তিনিও অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। তাঁর মতে, প্রতি ১০০ বছরে যদি ১.৫ থেকে ২ ডিগ্রি করে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, তাহলে সেই তাপমাত্রা বৃদ্ধি কোনও মাথাব্যথার কারণ নয়। কিন্তু যদি কয়েক দশকের মধ্যে এতটা তাপমাত্রা বাড়ে, তাহলে পরিবেশের জন্য এটা অবশ্যই চিন্তার বিষয়। কিন্তু মেঘালয়ে এমন কী হলো, যার জন্য এতটা তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেল ওই রাজ্যের? এতটা পরিবর্তন হলো তাঁদের চিরসবুজ অরণ্যে?

আরও পড়ুন: প্রচণ্ড গরমে আসছে না ঘুম, বিশ্বজুড়ে দানা বাঁধছে যে মারাত্মক সংকট

পরিবর্তনটা বৃদ্ধি পেয়েছে মূলত বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণেই। পরিবেশ বিজ্ঞানের ভাষায় এই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বৃষ্টিপাতের অনিয়ম হিসেবে। প্রতি বছর যেভাবে উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে মেঘালয় এবং ভারতের একাধিক রাজ্যের, তার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছে না বৃষ্টির পরিমাণ। এর ফলে প্রতি বছর বৃষ্টিপাতে একটা অনিয়ম লক্ষ করা যাচ্ছে। যদি কোনও রাজ্যে তাপমাত্রার অনিয়ম ঘটে, তাহলে একই সঙ্গে বৃষ্টিপাতের অনিয়ম ঘটতে থাকে। এই মুহূর্তে ভারতের সবথেকে বেশি বৃষ্টি হওয়া রাজ্য মেঘালয়ে বৃষ্টিপাতের অনিয়ম লক্ষ করেছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। আগের তুলনায় নিয়মিতভাবে বৃষ্টিপাত এখন আর মেঘালয় রাজ্যে দেখা যায় না। কিছু কিছু দিন হয়তো এমন হয়, যেদিন বাঁধভাঙা বৃষ্টি। আবার এমন অনেক দিন থাকে, যেদিন বৃষ্টি একেবারেই হয় না।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মেঘালয় প্রথম থেকেই ভারতের সবথেকে সবুজ রাজ্য হিসেবে পরিচিত। এর ভৌগোলিক গঠনের কারণে বৃষ্টিপাত অনেকটাই বেশি এই রাজ্যে। বৃষ্টিপাত এতটা বেশি হওয়ার কারণে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মেঘালয়ে গঠিত হয়েছে একটি দীর্ঘ চিরসবুজ অরণ্য। মেঘালয় রাজ্যটির মোটামুটি ৮০ শতাংশ এলাকা সম্পূর্ণরূপে গাছ দিয়ে ঘেরা। সারা ভারতের সম্পূর্ণ এলাকার মোটামুটি ৩০ শতাংশের কাছাকাছি এলাকায় রয়েছে সবুজ। শতাংশের হিসেবে তার প্রায় তিনগুণ রয়েছে শুধুমাত্র মেঘালয় রাজ্যটিতে। তাই ভারতের সবুজের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য মেঘালয় রাজ্যের অরণ্যগুলি অনেকটাই প্রয়োজন।

লোকাল ট্র‍্যাডিশন থেকে গ্লোবাল ফান্ডিং
মেঘালয় রাজ্যের মফলাং অঞ্চলটিতে ২০০৭ সাল নাগাদ শুরু করা হয়েছিল একটি বিশেষ প্রোজেক্ট, যার মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে বৃক্ষচ্ছেদন রোধের জন্য রুখে দাঁড়িয়েছিলেন গ্রামবাসীরাই। এই প্রোজেক্টের নাম দেওয়া হয়েছিল 'খাসি হিলস কমিউনিটি REDD প্লাস প্রোজেক্ট'। এই প্রোজেক্টের প্রধান কাজ ছিল মেঘালয়ের প্রত্যেকটি গ্রামে এটা প্রত্যেকটি গাছকে সুরক্ষা দেওয়া এবং তাদের ফল এবং ওই এলাকায় উৎপন্ন হওয়া মাশরুম এবং জীবজন্তুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। ২০১১ সালে প্রকল্পটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয় মেঘালয়ের ছোট্ট গ্রামের এই প্রচেষ্টা। এটি ছিল ভারতের প্রথম REDD প্রকল্প। ইউনাইটেড নেশনস প্রোগ্রাম থেকেও এই প্রকল্পটি প্রশংসিত হয়েছিল ওই একই বছর। যখন বনজঙ্গল কাটা হয় তখন পরিবেশে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। একটি গাছ কাটলে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হতে পারে, তাতে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের তাপমাত্রা কিন্তু অনেকটাই বাড়তে পারে। সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে আইপিসিসি-র একটি রিপোর্টে জানা গিয়েছিল, মানুষের কার্যকলাপের জন্য ইতিমধ্যেই প্রতি বছর সারা বিশ্বের তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবর্তিত হচ্ছে আবহাওয়া এবং একটি নির্দিষ্ট এলাকার জলবায়ু। এই পরিবর্তনের বাইরে নয় ভারতও। ভারতেও এই পরিবর্তনের প্রভাব লক্ষ করা গেছে বিগত কয়েক বছরে।

এবার আসা যাক মফলাং এলাকাটির বিষয়ে। মেঘালয়ের সবথেকে গভীর জঙ্গল যদি কোথাও থাকে, তাহলে সেটা হলো এই এলাকাটিতে। এই একটি অঞ্চলে প্রায় ২০০টি গভীর অরণ্য রয়েছে এবং এই সবক'টি অরণ্য কিন্তু বৃষ্টি-অরণ্য। তাই এই জায়গাতেই শুরু হয়েছিল ভারতের প্রথম REDD প্রোজেক্টটি। বিগত ১১ বছর ধরে ৬২টি গ্রামে এই প্রোজেক্ট বিস্তৃত রয়েছে। স্থানীয় মানুষদের নিয়েই গঠিত হয়েছে এই সম্পূর্ণ দল। তাদের লক্ষ্য, ২৭,০০০ হেক্টর জমিতে বৃক্ষচ্ছেদন রোধ করা। ২০১৮ সালে এই বিশেষ প্রকল্পটি বিশ্ব ব্যাঙ্কের তরফ থেকেও সাহায্য লাভ করে। এই প্রকল্পের প্রধান লিংদো বলছেন, "যদি বৃষ্টি অরণ্য মেঘালয়জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে, তাহলে ভারতের সৃষ্টি হওয়া পরিবেশের সমস্যাগুলিকে আমরা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পারব।" বিশ্ব ব্যাঙ্কের সাহায্য পাওয়ার পরেও এই প্রকল্পটি অনেক ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করেছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের এই সাহায্য ব্যবহার করে একাধিক ইন্সেনটিভ চালু করার কথা চিন্তা করছে সরকার। এছাড়াও, গ্রামের জায়গায় জায়গায় মানুষকে উজ্জীবিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে মেঘালয় সরকার এই সাহায্যের মাধ্যমে।

মেঘালয়ের বৃষ্টি অরণ্যে পরিবর্তন দরকার
২০০০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে মেঘালয়ের বৃষ্টি-অরণ্যর একটা বড় অংশে সমস্যা চলেছে। বৃক্ষচ্ছেদন, চোরাপাচার, বন্যপ্রাণী নিধন-সহ একাধিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ছিল মেঘালয়ের ওই বৃষ্টি-অরণ্যর প্রায় অর্ধেকের বেশি অংশ। এই বিষয়টিকে সম্পূর্ণরূপে উপড়ে ফেলতেই শুরু করা হয়েছিল এই REDD প্রকল্প। আইআইএসসি বেঙ্গালুরুর একটি টিম ২০১৮ সালে মেঘালয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পরিবেশ পরিবর্তন নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করে জানিয়েছিল, চোরাশিকার, চোরা পাচার এবং বিভিন্ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রকল্পের জন্য বিগত কয়েক বছরে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মেঘালয়ের বৃষ্টি-অরণ্য। এই ক্ষতি পূরণ করা এতটা সহজ কাজ হবে না মেঘালয়ের ক্ষেত্রে। চেরাপুঞ্জি এবং মৌসিনরামে বিশ্বের সবথেকে বেশি বৃষ্টিপাত হলেও, বিগত ৩২ বছরে মেঘালয়ের এই সমস্ত এলাকায় বৃষ্টিপাতের চরিত্র অনেকাংশে বদলেছে। চেরাপুঞ্জি এবং মৌসিনরামের পূর্ব খাসি পার্বত্য অঞ্চলে দীর্ঘ পাঁচ-ছয় বছর ধরে তেমন কিছু বৃষ্টি হয়নি। আইআইটি গান্ধীনগরের ওই রিপোর্টে উঠে এসেছে, এই অঞ্চলে দীর্ঘ প্রায় ৬ বছর ধরে চলছে খরা।

মেঘালয় ছাড়াও ভারতের আটটি আলাদা রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এমন আছে, যেখানে সবুজের পরিমাণ অনেকটাই বেশি। এই সমস্ত রাজ্যের মধ্যে রয়েছে উড়িষ্যা, আসাম, তেলেঙ্গানা-সহ একাধিক রাজ্য। ২০১৭-র ফরেস্ট সার্ভে থেকে উঠে আসে, উড়িষ্যা, আসাম এবং তেলেঙ্গানা- এই তিনটি রাজ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে গাছের পরিমাণ কমেছে। নর্থ ইস্টার্ন হিল ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক বিকে তিওয়ারি বলছেন, "মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় এবং কর্নাটক এই চারটি রাজ্যের জঙ্গল খুব একটা গভীর নয়। পাশাপাশি এই চারটি রাজ্যের জঙ্গল খুব তাড়াতাড়ি দাবানল ধরে ফেলার প্রবণতা রাখে। এই চারটি রাজ্যের মাটিতেই অর্গানিক কার্বনের পরিমাণ খুব কম। মেঘালয় বাদে অন্য কোনও রাজ্যের অরণ্য তেমনভাবে পরিবেশে প্রভাব ফেলতে পারে না। তাই, যদি ভারতের পরিবেশ বাঁচাতে হয়, তাহলে মেঘালয়ের বৃষ্টি-অরণ্যকে কোনওভাবেই দেওয়া যাবে না।"

যে কোনও জায়গায় গাছ লাগিয়ে কি আদৌ প্রাণ বাঁচে?
গাছ লাগালে অবশ্যই ভারতে সবুজের পরিমাণ বাড়বে। ফ্যাক্ট চেকার সংস্থার দ্বারা তৈরি করা একটি রিপোর্টে ২০১৯-এর জুলাই মাসে উঠে এসেছিল, ভারতে ৬,৭৭৮ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে সবুজের পরিমাণ অনেকটাই বেড়েছে। ভারত সরকারের গাছ লাগানোর প্রোজেক্ট অনেকটাই সফল হওয়ার কারণে এই বৃদ্ধি হয়েছে গাছের। কিন্তু, যে কোনও জায়গায় যে কোনওভাবে গাছ লাগিয়ে দিলে কিন্তু কাজ হয় না। স্বাভাবিকভাবে যে বনভূমি তৈরি হয়, তার জায়গা কোনওভাবেই কোনও কৃত্রিম বনভূমি নিতে পারে না। তাই গাছ লাগানো অবশ্যই প্রয়োজন, তাতে পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক থাকে। কিন্তু সেই সমস্ত গাছের থেকে খুব বেশি আশা করা ভুল। গাছ লাগালে শুধুমাত্র যে প্রাণ বেঁচে যাবে, এরকমটা নয়। প্রাকৃতিক বনভূমিকে রক্ষা করা সবার আগে প্রয়োজন। তারপরে গাছ লাগালে সেটা আরও ভালো।

আর ভারতের প্রাকৃতিক বনভূমির মধ্যে অবশ্যই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো মেঘালয়। এই রাজ্যটি এমন একটি জায়গায় অবস্থিত, যেখানে বিশ্বের সবথেকে বেশি বৃষ্টি হওয়া জায়গাটি রয়েছে। শুধুমাত্র মেঘালয় রাজ্যে এক বছরে ১২,০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হতে পারে। সারা ভারতের অধিকাংশ জায়গায় যেখানে মাত্র ৮০১ থেকে ১,৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়, যেখানে শুধুমাত্র মেঘালয়-চেরাপুঞ্জি অঞ্চলে বৃষ্টি হয় ১২,০০০ মিলিমিটার। ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তরের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, সম্পূর্ণ মুম্বইয়ের প্রায় পাঁচ গুণ বৃষ্টিপাত হয় শুধুমাত্র মেঘালয়-চেরাপুঞ্জি অঞ্চলে।

মূলত এই বৃষ্টিপাতের কারণেই মেঘালয়ের একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, গারো-খাসি এবং জয়ন্তিয়া পাহাড়ের কোলে তৈরি হয়েছে ভারতের সর্ববৃহৎ বৃষ্টি অরণ্য। উঁচু মালভূমি এবং সবথেকে বিপদসংকুল ডাইভার্সিটি হটস্পট থাকার কারণে মেঘালয় বনভূমি সবসময়ই চোরাশিকারিদের একটা প্রধান টার্গেট হয়ে থেকেছে। একটা সময় এমন ছিল, যখন মেঘালয়ের এই সমস্ত জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটতে গেলে শুধুমাত্র গাছের খোঁচা খেতে হতো। এখন বনজঙ্গলের পরিমাণ এতটাই কমেছে যে, মেঘালয়ের একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বনভূমি অনেকটাই কমে এসেছে। ওক, রডোডেনড্রন এবং পাইন গাছের জঙ্গলে যেখানে একটা সময় নিচ পর্যন্ত সূর্যের আলো আসতে পারত না, সেখানেই আজ স্বাভাবিকভাবে হাঁটা-চলা সম্ভব। সত্যিই কিন্তু বিপদসংকুল অবস্থায় মেঘালয়ের বনভূমি।

শিলংয়ের পেঁপে গাছ এবং অন্যান্য সমস্যা
এখানে প্রথমত পেঁপে গাছ নিয়ে একটু আলোচনা প্রয়োজন। বৃষ্টি-অরণ্যে পেঁপে গাছ থাকলে বুঝতে হবে, সেই অরণ্য ধ্বংসের পথে। বৃষ্টি-অরণ্য অঞ্চলে কোনওভাবেই পেঁপে গাছ তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। একমাত্র যদি সেই এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পর্যাপ্ত না হয় এবং তাপমাত্রার পরিমাণ বাড়তে থাকে, তাহলেই গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের এই বিশেষ গাছ অর্থাৎ পেঁপে গাছ সেই এলাকায় জন্ম নিতে পারে। পেঁপে গাছের মূল খুব একটা ভালোভাবে মাটি ধরে রাখতে সক্ষম নয়। বলতে গেলে, একটি এলাকার একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের মাটি অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বেশ কয়েকটা পেঁপে গাছ। আর অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য জন্ম নিয়েছে একটি পেঁপে গাছ।

শিলং এলাকার প্রতিদিনের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থাকে। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে শিলংয়ের তাপমাত্রা আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করেছে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেকটাই কম মেঘালয়ের রাজধানীতে। বিড়লা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর রাজীবকুমার চতুর্বেদী বলছেন, "এই সমস্ত বৃষ্টি-অরণ্য অঞ্চলে কোনওভাবেই পেঁপে গাছ সমীচীন নয়। ২০০০ থেকে এই অঞ্চলের বিভিন্ন ছবি নিয়ে আমরা ইতিমধ্যেই কাজ করতে শুরু করেছি। স্যাটেলাইট ইমেজের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের সঙ্গেও এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।" চতুর্বেদী আরও বলছেন, "বিগত ১৯৫১ থেকে ২০০০-এর মধ্যে এই অঞ্চলের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ০.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা যে-সমস্ত জায়গায় সবথেকে বেশি বন নিধন দেখেছি, সেই সমস্ত জায়গাতেই সবথেকে বেশি বায়োডাইভার্সিটি ছিল। যে সমস্ত বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে, সেগুলিকে কোনওভাবেই আর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় না।"

যদিও, NEHU-র প্রফেসর তিওয়ারি অবশ্য এই বিষয়টির জন্য দায়ী করেছেন সরকারকেই। মেঘালয় এমন একটি জায়গা, যেখানে ৯০ শতাংশ বনাঞ্চল রক্ষা করেন সেই এলাকার বাসিন্দারা। বাকি মাত্র ১০ শতাংশ রক্ষা করার দায়িত্ব থেকে সরকারের কাছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নাসার একটি ছবি থেকে উঠে আসে, ২০ বছর আগে মেঘালয়ের যে অঞ্চলটি এতটা সবুজ ছিল, সেই জায়গায় আজ সবুজের পরিমাণ অনেকটাই কমেছে। প্রফেসর তিওয়ারি বলছেন, "আপনি গাছ কেটে, সেই জায়গায় বাড়ি তৈরি করে, প্ল্যান্ট তৈরি করে, উন্নত এলাকা তৈরি করে, তারপর এর প্রভাবটাকে কখনওই আবহাওয়া পরিবর্তনের আখ্যান দিতে পারেন না। সরকারের উদাসীনতার কারণেই ধ্বংস হয়েছে বনাঞ্চল।"

বৃষ্টি-অরণ্য কেন প্রয়োজন?

১ বর্গ কিলোমিটার বৃষ্টি-অরণ্যর মধ্যে প্রায় ১০০০-এর বেশি বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ বসবাস করতে পারে। ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় সর্বমোট যত পরিমাণ গাছ রয়েছে, তার থেকেও কিছু হয়তো বেশি থাকে একটি বৃষ্টি-অরণ্য এলাকায়। ভারতের বৃষ্টি-অরণ্য মূলত রয়েছে তিনটি জায়গায়। পশ্চিমঘাট পর্বতমালা অঞ্চলে রয়েছে একটা ছোটখাটো বৃষ্টি অরণ্য। পূর্বঘাট পর্বতমালা অঞ্চলে কিছুটা বৃষ্টি-অরণ্য সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ভারতের সবথেকে বড় বৃষ্টি-অরণ্য রয়েছে অরুণাচল প্রদেশ, মেঘালয় এবং আসামে অর্থাৎ উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে।

মেঘালয়ের বৃহৎ আকৃতির এই বৃষ্টি-অরণ্য যত পরিমাণ গাছের আবাসস্থল তার মধ্যে ১০ শতাংশ এমন গাছ, যা ক্রান্তীয় চিরসবুজ। শকুন, ব্যাং, কচ্ছপ-সহ বহু ধরনের প্রাণী এই বৃষ্টি-অরণ্যে রয়েছে। কিন্তু মেঘালয়ের বৃষ্টি-অরণ্যের এই সমস্যা কিন্তু শুধু গাছের একার নয়। এই সমস্ত প্রাণীদের আবাসস্থল এই অরণ্য। তার পাশাপাশি ভারতের অক্সিজেনের ভান্ডারের ৮০ শতাংশের বেশি আসে মেঘালয়ের এই বৃষ্টি-অরণ্য থেকেই। ১,৮৮৬ ধরনের গাছ দেখতে পাওয়া যায় এই বৃষ্টি-অরণ্যে। শাল, অর্কিড, বাস এবং অন্যান্য ঔষধি গাছ এই বৃষ্টি-অরণ্যে দেখা যায়। মিয়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর কেনিথ জেম ফিলি বলেছেন, "বৃষ্টি-অরণ্যর জন্য সবথেকে বেশি যেটা প্রয়োজন, সেটা হলো জল। বৃষ্টি যদি ঠিকঠাকভাবে কোনও এলাকায় হয়, তাহলে সেই এলাকায় বৃষ্টি-অরণ্য তৈরি হওয়াটা অবধারিত। তার সঙ্গেই লাগবে উচ্চ-প্রজননশীল গাছ। যদি এই দু'টি সঠিকভাবে পাওয়া যায়, তাহলেই তৈরি হতে পারে একটি সঠিক বৃষ্টি-অরণ্য।"

কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই ধীরে ধীরে শেষ হতে শুরু করেছে মেঘালয়ের এই অরণ্য। ভারতের সবথেকে বড় বৃষ্টি-অরণ্য যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সারা ভারতের জন্য তা হয়ে উঠবে সমস্যার। শুধু ভারত নয়, ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশ এবং আশপাশের বেশ কিছু দেশের জন্যও বিষয়টা হয়ে উঠবে সমস্যার। অক্সিজেনের আকাল পড়বে ভারতীয় উপমহাদেশে। জীববৈচিত্র ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই সমস্যাটার সমাধান গাছ লাগিয়ে হবে না। বরং মেঘালয়ের বৃষ্টি-অরণ্যকে বাঁচাতে হবে সকলে মিলে। এর জন্য শুধু সরকারের সাহায্য নয়, প্রয়োজন মেঘালয়ের সাধারণ মানুষের সাহায্যও। নতুবা সেই দিনটা দূর না, যখন শুধু ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনের ভরসায় বেঁচে থাকতে হবে একটা গোটা দেশের মানুষকে।

More Articles