শুধু চেন্নাই নয়, ৩ ফুট জলের নীচে তলিয়ে যেতে চলেছে ভারতের ১২ টি শহর!

Cyclone Michaung Chennai Flood : ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের ফলে ইতিমধ্যেই ১২ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অন্ধ্র প্রদেশ এবং তামিলনাড়ুর অবস্থা তথৈবচ।

ঘূর্ণিঝড় মিগজাউম চেন্নাইয়ে সাম্প্রতিক যে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তা ফের জলবায়ু-জনিত বিপর্যয়ের প্রশ্নটিকে নগ্ন করে দিয়েছে শহুরে ভারতের কাছে। ভারতীয় শহরগুলি আদৌ কোনও বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত? ঘূর্ণিঝড়, ভারী বৃষ্টি হলেই কেন শহরগুলি ভেসে যাচ্ছে, কেন বিকল হয়ে পড়ছে ঝাঁ চকচকে আভিজাত্য? ৪ ডিসেম্বর, ২০২৩- ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৪০ সেন্টিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে চেন্নাই শহরে। ফল? বন্যা! চেন্নাইয়ের দুর্দশা শহুরে ভারতে বাড়তে থাকা জলবায়ু সংকটের এক দগদগে প্রমাণ। ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের ফলে ইতিমধ্যেই ১২ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তামিলনাড়ুর অবস্থা তথৈবচ। ঝড়-বৃষ্টি কবলিত শহরগুলি থেকে পাওয়া ভিডিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে মানুষের অসহায়তা, দেখিয়ে দিচ্ছে জলমগ্ন আবাসন এবং রাস্তায় জলের স্রোতে ভেসে যাওয়া গাড়িগুলির দুর্দশা।

এই বন্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের কারণ ঘূর্ণিঝড় অবশ্যই, তবে এটিই একমাত্র কারণ নয়। চেন্নাইয়ে বন্যা নতুন কিছু নয়। ২০১৫ সালে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে ঐতিহাসিক বন্যায় ভেসে গিয়েছিল শহর। অপর্যাপ্ত নগর পরিকল্পনা এবং দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার পরিণতি কী হতে পারে, হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিল এই 'উন্নত' শহর। এই ধরনের বন্যার কারণ মূলত বহুমুখী। ভারী বৃষ্টিপাত, অপর্যাপ্ত নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং নদীগুলির বেশি জল না ধরে রাখতে পারার অক্ষমতাই এর নেপথ্যে। অপরিণত নগরায়ন এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। শহরের মূল জলাশয় এবং পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল অঞ্চলে মানুষের দাপট পরিস্থিতির সংকটকে আরও বাড়িয়ে তোলে। চেন্নাই সমতল ভূখণ্ড। ফলে জল নিষ্কাশনের বিষয় আরও জটিল।

আরও পড়ুন- মার্বেলের গায়ে চওড়া হচ্ছে হলদে ছোপ! বাঁচানো যাবে সাধের তাজমহল?

ভারতের উপকূলীয় শহরগুলিতে বন্যার আশঙ্কা কেমন?

চেন্নাই এই লড়াইয়ে একা নয়। উদাহরণ হিসেবে বলতে গেলে, কলকাতা এবং মুম্বইও প্রবল সংকটের মুখে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় এবং নদীর বন্যার কারণে এই দুই মহানগর অচিরেই ডুবে যাওয়ার মুখে। ঘনবসতিপূর্ণ এই মহানগরগুলি ইতিমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব টের পাচ্ছে। বৃষ্টিপাত এবং বন্যার তীব্রতা বৃদ্ধির পাশাপাশি খরার ঝুঁকিও বেড়েছে এখানে।

পটসডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চ অ্যান্ড ক্লাইমেট অ্যানালিটিক্সের গবেষণা সতর্ক করেছে যে, ভারত বিষুব রেখার কাছাকাছি হওয়ায় উচ্চ অক্ষাংশের তুলনায় এখানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। শহরে নোনা জল ঢুকবে যা উপকূলীয় শহরগুলির জন্য মারাত্মক এক পরিস্থিতি তৈরি করবে। কৃষি নষ্ট হবে, ভূগর্ভস্থ জলের গুণমান কমে যাবে এবং অবধারিতভাবেই জলবাহিত রোগের বৃদ্ধি ঘটবে।

২০২১ সালের প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর (IPCC) একটি প্রতিবেদনে ভারতের জন্য মারাত্মক সতর্কতা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ ভারতের ১২টি উপকূলীয় শহর ডুবে যেতে চলেছে। মুম্বই, চেন্নাই, কোচি এবং বিশাখাপত্তনম সহ মোট ১২ টি ভারতীয় শহর এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ প্রায় তিন ফুট জলের নিচে তলিয়ে যেতে পারে, বলছে আইপিসিসির প্রতিবেদন।

৭০ লক্ষেরও বেশি উপকূলীয় কৃষক এবং মৎসজীবী পরিবার ইতিমধ্যেই এর প্রভাব টের পাচ্ছে। সমুদ্রের জলরাশির বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় ক্ষয় ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১,৫০০ বর্গকিলোমিটার জমি গিলে খাবে বলে অনুমান করা হয়েছে। নিচু উপকূলীয় অঞ্চল এবং নদীর ব-দ্বীপগুলি সঙ্কটে পড়বে দ্রুত। মুম্বই, কলকাতা এবং চেন্নাইয়ের ঘনজনবসতি এবং ভারী পরিকাঠামোর কারণে, আরও ঘন ঘন এবং গুরুতর বন্যার ঝুঁকির মুখে আছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারেন, জীবিকা ও পরিকাঠামো ভেঙে পড়তে পারে অচিরেই।

আরও পড়ুন- ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের ফলে রাতভর ভিজছে বাংলা! কবে থামবে বৃষ্টি?

উপকূল ছাড়া, দিল্লি ও পার্বত্য রাজ্যগুলিও বন্যার ঝুঁকির মুখে রয়েছে এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। বিহার, হিমাচল প্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডের শহরগুলি বর্ষার কারণে বন্যা এবং ভূমিধসের শিকার হয়েছে। দিল্লিতেও এই বছরের শুরুতে প্রবল বন্যা দেখা দিয়েছে। জুলাই মাসে, যমুনার জল আশ্চর্যজনকভাবে ২০৮.৪৮ মিটারে বেড়ে যায় এবং যমুনা ১৯৭৮ সালের রেকর্ড ভেঙে তীরবর্তী দিল্লির নিচু এলাকা প্লাবিত করে।

বিশেষজ্ঞরা দিল্লিতে বন্যার জন্য অল্প সময়ের মধ্যে ভারী বৃষ্টির কারণে বন্যায় সমভূমি ভেসে যাওয়া এবং পলি জমে যাওয়াকেই দায়ী করেছেন। জুলাইয়ের বন্যার নেপথ্যে অবশ্য হিমাচল প্রদেশে নদীর তীরে অবৈধ খনন এবং নির্মাণের ভূমিকাও রয়েছে। চরম আবহাওয়া ধীরে ধীরে পাল্টে দিচ্ছে স্বাভাবিক ঘটনাকেও! বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলি খরা-প্রবণ হয়ে উঠছে এবং খরার রাজ্যে বন্যা হচ্ছে! ভারতের ৪০% এরও বেশি জেলা এই ঘটনায় প্রভাবিত।

বাঁচার উপায়?

এই চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলায় বহুমুখী পদ্ধতি ও পরিকল্পনার প্রয়োজন। বাড়ি তৈরির বিধিগুলি অবশ্যই কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। নগর পরিকল্পনায় অবশ্যই জলবায়ু-সম্পর্কিত বিপর্যয়ের বিশেষ চিন্তা রাখতেই হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি থেকে রক্ষা করার জন্য উপকূলীয় বাঁধ এবং উপকূলীয় নিয়ন্ত্রণ অঞ্চলয়ের বিধির কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন। জমে থাকা জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থাপনায় 'স্পঞ্জ সিটি' ধারণাটি বন্যার ঝুঁকি কমাতে পারে।

মুম্বই ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যান ২০২২ (MCAP) জলবায়ু ও বিপর্যয় মাথায় রেখে পরিকল্পনা করছে শহরের জলবায়ুর স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানোর লক্ষ্য। হাইড্রো-মেটিওরোলজিক্যাল সিস্টেমের উন্নতি এবং বন্যা সতর্কীকরণ ব্যবস্থা স্থাপন হচ্ছে।

তবুও, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সহজ না। চেন্নাইয়ের সাম্প্রতিক বন্যা বারে বারে সতর্ক কছে যে শহরগুলিকে বাঁচাতে কড়া পদক্ষেপ দরকার। ভারতীয় শহরগুলি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পাবেও। এখানে আরও বেশি মানুষ থাকতে চাইবেন সুযোগ সুবিধা পেতে। অথচ শহরগুলির পরিকাঠামো এবং নগর পরিকল্পনা একেবারেই টেকসই নয়। ফলে চিরতরে ডুবে যাওয়া থেকে আর কয়েক মাইল দূরে দাঁড়িয়ে ভারতীয় মহানগরগুলি।

More Articles