আবারও নির্বাচনের দামামা, সোশ্যাল মিডিয়ায় কেমন লড়ছে বিজেপি থেকে বিরোধীরা
Gujarat Election 2022: হাতে আর মাত্র কয়েকদিন। তারপরই গুজরাটে সিংহাসনের লড়াই শুরু। সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতিমধ্যেই সক্রিয় শাসক থেকে বিরোধী...
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। ভারতের নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে একটি নির্দেশ জারি করা হয়েছিল। উপলক্ষ্য চলতি বছরের ডিসেম্বরে আসন্ন গুজরাট বিধানসভা নির্বাচন। সেখানে কমিশন খুব স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, তারা এবার সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর কড়া নজরদারি চালাবে। নির্বাচন সংক্রান্ত ছবি তো বটেই, এমনকী নিজের ব্যক্তিগত মতামত, ছবিও নেট দুনিয়ায় দিতে পারবেন না দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকেরা। সেইসঙ্গে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপের ওপর কড়া নজরদারি রাখা হচ্ছে বলেও জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সোশ্যাল মিডিয়াও সেই আতসকাচের বাইরে পড়বে না। নির্বাচন কমিশনের আশঙ্কা, সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিভিন্নভাবে ঝামেলা লাগতে পারে। তাই আগেভাগে যেটুকু দায়িত্ব নেওয়া যায়।
নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সংস্থার এমন সিদ্ধান্ত মোটেই অমূলক নয়। আরও যেখানে রাজ্যটির নাম গুজরাট। ডিসেম্বরের ১ থেকে ৫ তারিখ পর্যন্ত সেখানে চলবে ভোটগ্রহণ পর্ব। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজ্যে এবার কেমন ফলাফল হয়, সেদিকে তাকিয়ে নেতা থেকে বিশ্লেষক প্রত্যেকে। তবে ভোটের আগেও একটি ব্যাপার বারবার আমাদের সামনে এসেছে। যার সূত্রপাত ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে। সেই সময় থেকে ভোটের রাজনীতিতে দু’টি শব্দের জোরালো আমদানি হয়। একটি সোশ্যাল মিডিয়া, অন্যটি আইটি সেল। যার সূত্রধর ভারতীয় জনতা পার্টি। মিসড কল দিয়ে পার্টি সদস্য (পড়ুন কার্যকর্তা) হওয়া বলুন, বা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারকাজ, গেরুয়া শিবিরের জুড়ি মেলা ভার। আর এই কাজে তাদের দফতরও রয়েছে, যার জনপ্রিয় নাম আইটি সেল। প্রায় ১০ বছরের গেরুয়া রাজত্বে এই নামটি সব জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে।
আরও পড়ুন : মত্ত ছিলেন পদ্মাবৎ বিরোধিতায়! গুজরাত ভোটে বিজেপির ভরসা, কে এই করণী সেনা প্রধান?
তাহলে এখন এতো হাঁকডাক? কারণ আইটি সেলের কাজকর্মের ‘নমুনা’ এতদিনে আমি আপনি সবাই পেয়ে গিয়েছি। সেসব কথায় আসার আগে একবার গুজরাটে চোখ ফেরানো যাক। ১৯৯৮ সাল থেকে গুজরাট বিজেপির শক্ত ঘাঁটি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে ১৩ বছরের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে থেকেছেন গুজরাটে। ২০০১-২০১৪ এই সময়কালে যেমন উঠে এসেছে শিল্পের মোদী মডেল, তেমনই এসেছে কুখ্যাত ২০০২ দাঙ্গা। মোদীর সেনাপতি অমিত শাহের জন্ম মুম্বইতে হলেও, তাঁর শিকড় গুজরাটে। কাজেই এবারও মোদী-শাহ মন্ত্রেই যে নিজেদের শাসনের আসনে বসাতে চাইবে বিজেপি, তা বলাই বাহুল্য। অন্যদিকে বিরোধী দলে রয়েছে কংগ্রেস এবং আম আদমি পার্টি। দিল্লির পর পাঞ্জাব জয় করে আপের পালে একটু হলেও হাওয়া লেগেছে।
অন্যদিকে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-এ প্রবলভাবে নিজেদের তুলে ধরার চেষ্টা করছে কংগ্রেস। বিজেপি যে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপাবে, সেটা অবশ্যই বিরোধীরা জানে। তাই আসন্ন গুজরাট বিধানসভা নির্বাচন উপলক্ষ্যে তারাও সোশ্যাল মিডিয়ার যুদ্ধে নেমে পড়েছে। পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কংগ্রেসের সোশ্যাল মিডিয়া ডিপার্টমেন্টের সভাপতি কেয়ুর শাহ এমন ইঙ্গিতই করেছেন। কংগ্রেস ইতিমধ্যেই বুথভিত্তিক এবং গ্রামীণ পর্যায়ে প্রচার চালানোর জন্য ৫০,০০০ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলেছে। প্রতিটি জাতির আলাদা আলাদা গ্রুপও তৈরি করা হয়েছে। সেইসঙ্গে চলছে ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউবের মাধ্যমে প্রচার। থেমে নেই আপও। ২০,০০০ ‘সোশ্যাল মিডিয়া ভলান্টিয়ার’দের নামিয়েছে তারা। এজেন্ডা, ম্যানিফেস্টো, লিফলেট – প্রচারে ঘাটতি নেই।
আরও পড়ুন : বড় ভোটে মোদি, ছোট ভোটে মিঠুন! এবারে কার্যসিদ্ধি হবে, না কি খালি হাতেই ফিরতে হবে
তাহলে নির্বাচন কমিশনের ভয়টা কোন জায়গায়? সেটা আলোচনা করার আগে আরেকটি ছোট্ট খবরে যাই। গত শুক্রবার গুজরাটের খেদা জেলায় নির্বাচনী প্রচারে গিয়েছিলেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপির শীর্ষ নেতা আমিত শাহ। সেখানে খুব স্পষ্টভাবে তিনি বলেছেন, মোদীজি গুজরাটে শান্তি ফিরিয়ে এনেছেন। তাঁর মতে, ‘কংগ্রেস নিজেদের ভোট ব্যাঙ্ক বজায় রাখার জন্য একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ‘সমঝে’ চলত। সেই সময় সাম্প্রদায়িক হিংসা খুব বেশি হতো। কিন্তু ২০০২-এ ওরা শিক্ষা পাওয়ার পর চলে গিয়েছে। তাই এখন এখানে শান্তি রয়েছে’। খেয়াল করুন কথাগুলি। ‘ওরা শিক্ষা পাওয়ার পর’। ওরা বলতে কারা? কংগ্রেস পার্টি, নাকি ওই ‘গোষ্ঠী’? ২০০২ সালের ইঙ্গিত যখন আছে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না কোন ঘটনার দিকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হিংসার সময় স্বয়ং অটলবিহারী বাজপেয়ী (তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী) নরেন্দ্র মোদীকে রাজধর্ম পালন করার কথা বলেছিলেন। তারপর ২০২২-এ দাঁড়িয়ে অমিত শাহের এমন ইঙ্গিত, কীসের প্রতি?
হিসেব বলছে, গুজরাট ভোটের জন্য ৬০,০০০-এরও বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ভলান্টিয়ার রয়েছে বিজেপির। সেইসঙ্গে রয়েছে তাদের নিজস্ব ‘হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি’। নিত্যদিন দেশের কোটি কোটি মোবাইলে যেখান থেকে ভুয়ো খবরের আমদানি হয়। তার ওপর অমিত শাহের প্রচ্ছন্ন হুমকির পর যে কেউ চিন্তায় পড়বেন। ইতিহাস বিকৃতি থেকে রাজনৈতিক পাশাখেলা, সব জায়গায় গেরুয়া শিবিরের দর্শন একটিই। টার্গেটও একটি নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষজন। আর সেই মনোভাবই ব্যক্ত হয় সোশ্যাল মিডিয়ার কাজকর্মের মধ্য দিয়ে। ‘দু’টাকা প্রতি কমেন্ট’-এর মতো কথা থেকে সরে একটু গভীরে তলিয়ে দেখা যাক। করোনাকালীন পরিস্থিতির কথা ভাবুন। ভাবুন পশ্চিমবঙ্গের তেলেনিপাড়া ও দিল্লির কথা। ২০২০ সালে এই দু’টি জায়গাতেই সাম্প্রদায়িক হিংসা, দাঙ্গার আগুন জ্বলেছিল। এবং দু’টি ক্ষেত্রেই সবথেকে বড়ো ভূমিকা ছিল সোশ্যাল মিডিয়ার। আইটি সেলের ‘তৎপরতায়’ সেই বিষ ছড়িয়ে পড়তে সমকয় লাগেনি। আর গুজরাটের তো নিজস্ব ইতিহাস আছেই। তার ওপর এখন ভোটের মরসুম। নির্বাচন কমিশনের সাম্প্রদায়িক হিংসার ভয় যে অমূলক নয়, সেটা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরও পড়ুন : ছ’বছরে সর্বত্র শুধুই ক্ষতি! নোটবন্দির কালো ছায়া আজও ঢেকে রেখেছে দেশকে
তথ্যপ্রযুক্তি ও টেকনোলজির এই বিস্ফোরক দুনিয়ায় সোশ্যাল মিডিয়াকে সবাই নানাভাবে কাজে লাগাতে চায়। কেউ নিজের ব্যবসা বাড়ানোর কাজে এগোয়, কেউ আবার গায়ক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন। ইনফ্লুয়েন্সার শব্দটি অহরহ শোনা যায় বাজারে। সাংবাদিকতার জগতেও এসে গিয়েছে ডিজিটাল ওয়েব মিডিয়া। কাজেই রাজনীতির ময়দানেও তার প্রভাব পড়বে না, সেটা ভাবা অনুচিত। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানির মতো দেশেও সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে প্রচার চালানো হয়। জনতা টানার জন্য আয়োজিত হয় অনলাইন ক্যাম্পেইন সহ বিভিন্ন আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান। কিন্তু সেই সোশ্যাল মিডিয়া যখন লাগাতার হিংসা ছড়ায়, আর সেই কাজে যদি একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের মদত থাকে, তাহলে সেটা ভয়ংকর প্রবণতা ডেকে আনে। সেই দলটি যদি শাসকের চেয়ারে থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। বিজেপির ক্ষেত্রে বারবার সেই জিনিসটিই দেখা গিয়েছে। একের পর এক ভুয়ো খবর, ভুয়ো ছবি, ভিডিওর ফুলঝুরি চলছে। তাতে প্রভাবিত হচ্ছে দেশবাসী, প্রভাবিত হচ্ছেন আমার আপনার প্রতিবেশীরা। আর ক্ষমতার লড়াই যখন হয়, তখন তো সমস্ত গণ্ডি পেরিয়ে যাই আমরা। অল’স ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার!