রিল মানে কি সহজেই হাততালির লোভ? 'রিয়েল'-কে পাশ কাটিয়ে কত দূর যাব আমরা?
সাংঘাতিক অস্থিরতা, ট্রেন্ডে থাকতে চাওয়া বাধ্যতামূলক জীবন মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করছে। দায়টা সকলের, দায়িত্বটাও সকলকেই ভাগ করে নিতে হবে।
স্কুলের বদ্ধ নিয়মের গণ্ডি পার করে ফার্স্ট ইয়ারে পড়া অদ্রিজাকে পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য নতুন ফোন কিনে দেয় অদ্রিজার মা-ই, ফোন ঘাঁটাঘাঁটির অভ্যেস যদিও অনেক আগে থেকেই, স্কুলের নোটস, প্রোজেক্টের হোমওয়ার্ক- সবকিছুই তো ফোনে। আমরা ফোনসর্বস্ব প্রজন্ম, অদ্রিজাই বা বাদ যাবে কেন তা থেকে? জন্মানোর পর থেকেই যেখানে শিশুকে খাওয়ানোর জন্য মোবাইল ফোন হাতে দিয়ে দেওয়া হয়, সেই প্রজন্ম কী করে ফোন থেকে দূরে থাকবে এবং কেনই বা থাকবে?
তবে যে সমস্যা নিয়ে আজ লিখতে বসেছি তা হলো, এখনকার অদ্রিজার সঙ্গে আগের অদ্রিজার তফাৎ। সোশ্যাল মিডিয়ায় বাধ্যতামূলকভাবে ট্রেন্ড ফলো করা থেকেই সেই সমস্যার শুরু। ছোটবেলা থেকে সমাজের চোখে তথাকথিত ফরসা, লম্বা, সুন্দরী অদ্রিজাকে বিয়েবাড়ি থেকে শুরু করে নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে সমাজই বারবার বলেছে মডেলিং করতে, অভিনয় করতে, গ্ল্যামার-জগতের ঝাঁ-চকচকে মোড়কে অদ্রিজার স্থান হবেই- এমনটাই দাবি ছিল ফুলকাকিমা, মিষ্টুপিসিদের, "এত সুন্দরী মেয়ে তুই, সিরিয়াল-সিনেমায় তো এক চান্সে বাজিমাত করবি!"
তাই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নায়িকা সেজে নাচ-গান করলেও অঙ্কের টিউশনে স্যরের চোখরাঙানি, বাবার কড়া শাসন, পাশের বাড়ির পারমিতাদির বোর্ডে দুরন্ত রেজাল্ট করা আর কেরিয়ারের কথা কান ধরে মনে করিয়ে দেওয়া- এগুলোও ছিল। আর সঙ্গে এই আশ্বাসও জুটত, একবার স্কুলের গণ্ডি পেরোলেই স্বাধীন, তখন ওর ইচ্ছেতে আর কেউ বাধা দেবে না। ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, টিকটক তার সেই স্বপ্নকে অনেক বাস্তবিক করেছে। ছোটবেলার অনেক না পাওয়া হাততালি, সাফল্য পাওয়ার পর না-পাওয়া ফিডব্যাক, মনের গভীরে যত্নে লালন হয়ে থাকা হীনম্মন্যতা, বহু পরিশ্রমের পরেও সফল না হওয়ার নিরাপত্তাহীনতা অনেক সহজ করে দিয়েছিল এই মাধ্যমগুলো। অনেক অদ্রিজাকেই তো আনন্দ দিয়েছে লকডাউনের ডালগোনা কফি থেকে শুরু করে ছাদে উঠে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন, কাটিয়ে দিয়েছে অনেকটা অবসর সময়।
আরও পড়ুন: স্টারডমের দুনিয়া ক্ষমাহীন, পল্লবীদের দুঃখ বেড়ে বেড়ে ক্যানসার হয়ে ওঠে সেখানে
সমাজ-মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই বিষয়কে বলা হয় Bandwagon effect. যে প্রবণতা থেকে কিছু মানুষ এক ধরনের ব্যবহার, স্টাইল ধারণ করে, যা সবাই করছে। এটা মস্তিষ্কের একটি ভ্রম বা bias, যখন যা নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে, তখন তার অংশীদার হওয়া। এত দূর অবধি অদ্রিজা মানসিকভাবে সুস্থ ছিল, স্বাভাবিক ছিল। সমস্যা শুরু হয় তখন, যখন অদ্রিজা বাধ্যতামূলকভাবে ইনস্টাগ্রামে ফেসবুকে ট্রেন্ডে থাকার জন্য, ফলোয়ার বাড়ানোর জন্য প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে এবং কেন লাইক, কমেন্ট, শেয়ারের সংখ্যা বাড়ছে না সেই নিয়ে তার রাতের ঘুম উড়ে যায়। মানসিক সমস্যা এবং জটিলতা শুরু হয় এই কষ্ট থেকেই। যে কষ্ট এই প্রজন্মের ইদানীং বাড়ছে, বেড়েই চলেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে Social media jealousy। অন্য মানুষ কতটা আনন্দে আছে, ভালো আছে, সেই ভাবনা থেকে এক ধরনের ক্রাইসিস শুরু হয় অনেকের।
অনেকে এটা বুঝতে পারেন না, সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ নিজের মনের আনন্দের দিকটাই বেশি প্রকাশ করে, খুব কদর্যতা আমরা নিজেরাও বিশেষ তুলে ধরি কি? কিন্তু ওই যে মোড়ক, যার পিছনে ছুটতে থাকছে হাজার অদ্রিজা, সেটা bandwagon effect হোক বা social media jealousy- মানসিক অবস্থানের বিশেষ পরিবর্তন হচ্ছে না। ইঁদুর দৌড়ে একটু-আধটু সাফল্য, হাততালি পেলেও মন ভরছে না কিছুতেই, মনের ভার বাড়ছে। গত বেশ কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া আত্মহত্যাগুলি এই বিষয়গুলোকে আরও ইঙ্গিত করেছে। যাঁরা মূলত চর্চা এবং খ্যাতি গোলাচ্ছেন না, তাঁদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না সেইভাবে। কিন্তু মাথার পিছনে কেউ বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এমন দায় থেকে যেন কেউ কেউ বাধ্যতামূলকভাবে ইন্সটাগ্রামে বা ফেসবুকে ছবি বা ভিডিওতে কেন লাইকের সংখ্যা কম, কেন কমেন্টের গুঞ্জন হল না- তাই নিয়ে অবসাদে চলে যাচ্ছেন।
বিশ্বাস করুন, যাঁরা এটা ক্রমাগত, বাধ্যতামূলকভাবে করছেন, করেই যাচ্ছেন, তাঁদের দিকে আমরা, মনোবিদরা একেবারেই আঙুল তুলছি না। আসলে এখনকার সময় বা আমাদের জেনারেশন চায় ‘ফলোয়ার’। তোমার সোশ্যাল মিডিয়ায় যত বেশি ফলোয়ার, তত বেশি তুমি সাধারণ মানুষের কাছে পপুলার। আর এই তথাকথিত 'জনপ্রিয়' হওয়ার তাগিদ একটা গোটা প্রজন্ম যেন নিজেদের ব্যক্তিত্বকে বিলিয়ে দিচ্ছি আরও বেশি লাইক, আরও বেশি শেয়ারের লোভে। কিছু ভিডিও আপলোড হওয়ার কয়েক ঘণ্টায় ছাড়িয়ে যাচ্ছে হাজার লাইক, শেয়ার, সাবস্ক্রাইবার। অদ্রিজাদের মধ্যের অন্য অদ্রিজা চাগাড় দিয়ে উঠছে জনপ্রিয় হওয়ার জন্য, অদ্রিজাদের ধৈর্য কমে যাচ্ছে, অদ্রিজারা অপেক্ষা করতে ভুলে যাচ্ছে, অল্প সময়ে বিপুলভাবে ভাইরাল হবার আকাঙ্ক্ষা রাতের ঘুম উড়িয়ে দিচ্ছে ট্রেন্ড ফলো না করতে পারার জন্য।
এই মুহূর্তে সবাই সকলেই একটি বিশেষ বাংলা গানের জনপ্রিয় ভিডিওতে নাচছে, কাজেই আমার মন যতই ভেঙে যাক, যতই গুঁড়িয়ে যাক, আমায় তা করতেই হবে, ট্রেন্ডে থাকতেই হবে। কারণ আগামিকালের ট্রেন্ড আজ রাতের মধ্যেই হুট করে বদলে যাবে। এবার এই 'আমাকেই দেখো’-র ইঁদুর দৌড়ে আমি কিন্তু আসলে অস্থির, ক্লান্ত, ভীত, অবসাদগ্রস্ত। এবং যদি মনের গভীরে প্রবেশ করি, তাহলে বুঝতে পারি, এই যন্ত্রণার শিকড়ও আছে অনেক ভেতরে। আমরা কিন্তু আসলে সকলেই চাইছি গ্রহণযোগ্যতা, ভালবাসা, বন্ধুত্ব, সহানুভূতি, প্রশংসা, যা আমাদের এই ক্ষমাহীন জীবনে ব্যাথায় লাগানো মলমের মতো কাজ করবে। ছোটবেলায় পাওয়া অসংখ্য অপমান, অমর্যাদা, হীনম্মন্যতা, নিরাপত্তাহীনতা- সমস্তকিছুই সেরে উঠবে সাফল্যের হাততালিতে।
সেই আকাঙ্ক্ষা, সেই চাওয়া কি ভুল তবে? একেবারেই নয়। সোশ্যাল মিডিয়া সেই সুযোগ কি একেবারেই করে দেয়নি অনেক মানুষকে? তাহলে সেই পথে এগিয়ে যাওয়া অদ্রিজাদের দিকে হাত তোলার আমি-আপনি কে? আমরাই তো ইন্ধন জোগালাম। লাইক, শেয়ার, কমেন্ট আমরাই করেছি। কিন্তু সত্যি করে পাশে থেকেছি কি? জানিয়েছি কি, এই পথ ঠিক নয়? যদি অভিনয়ই করতে হবে, তবে তার জন্যও শিক্ষার প্রয়োজন, সাধনার প্রয়োজন। কোনও শিল্পকে মাধ্যম করে স্টার হতে চাওয়া অনেক বড় ভুল পদক্ষেপ তো বটেই, তার সঙ্গে তা সেই শিল্পকেও অবমাননা করা।
উপায় আছে অনেক, আমরা যদি পারি একটু অন্য পথে ভাবতে, তবে মনের ওপর এত সাংঘাতিক চাপ পড়ে না। কিন্তু এই সাংঘাতিক অস্থিরতা, ট্রেন্ডে থাকতে চাওয়া বাধ্যতামূলক জীবন মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করছে। দায়টা সকলের, দায়িত্বটাও সকলকেই ভাগ করে নিতে হবে। যদি সম্ভব হয়, আমরা কথা বলি, আমরা মানসিকভাবে পাশে থাকি, ঠিক যেমন করে মোবাইল ফোন আসার আগে থাকতাম। তাতে ‘সব’ ঠিক হবে না। অদ্রিজারা কাল থেকেই সোশ্যাল মিডিয়া জীবন থেকে মুছে ফেলবে না, কিন্তু তারা মানুষের সান্নিধ্য পাবে, ভার্চুয়াল জগতের লোকদেখানো হাততালি, পাশে থাকার প্রতিশ্রুতির বদলে একজন আসল মানুষের সান্নিধ্য পাবে।