মাদকচক্রের জাল ঠিক কতটা গভীরে? বিজেপি নেত্রী সোনালী ফোগাতের রহস‍্যমৃত‍্যুতে যে ইঙ্গিত লুকিয়ে

বিজেপি নেত্রী সোনালী ফোগাতের রহস্যমৃত্যুই বুঝিয়ে দিল, অতল গভীরে প্রোথিত মাদক সমস্যার শিকড়।

প্রতিভাবান অভিনেতার মৃত্যুর ঘোর তখনও কাটেনি পুরোপুরি। তার মধ্যেই দেশের প্রথম সারির অভিনেতার ছেলের গ্রেফতারি। দুই ঘটনাতেই আবার মাদক সংযোগ। বছরখানেক আগে তা নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল গোটা দেশ। সঙ্গে সঙ্গে মাঠে নেমে পড়েছিলেন দেশের তাবড় নীতিবাগীশ, গণ‍্যমান্য ব্যক্তিরা। অল্প বয়সে বৈভবের ছোঁয়া পেয়েই অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা মাদকের নেশায় ডুবে যাচ্ছেন বলে গেল গেল রব উঠেছিল চারিদিকে। মায়ানগরীতে প্রায় সকলেই বেলেল্লাপনায় ডুবে থাকেন বলে বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছিল রাতারাতি। কিন্তু বিজেপি নেত্রী সোনালী ফোগাতের রহস্যমৃত্যুই বুঝিয়ে দিল, অতল গভীরে প্রোথিত মাদক সমস্যার শিকড়।

২৩ অগাস্ট সকালে কার্যত আগুনের মতোই ছড়িয়ে পড়েছিল খবরটি। জানা গিয়েছিল, গোয়ায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে হরিয়ানার বিজেপি নেত্রী সোনালী ফোগাতের। শাসক দলের হাই-প্রোফাইল নেতানেত্রীর ভিড়ে সোনালী কে, তা বুঝতে সময় লেগেছিল খানিকক্ষণ। তবে ছবি দেখে মুখচেনা মনে হয়েছিল অনেকেরই। কারণ তথাকথিত রাজনীতিক বলতে যা বোঝায়, তার চেয়ে আলাদা ছিলেন সোনালী। Gen Z-এর ভিড়ে টিকটক ভিডিও বানিয়ে খ্যাতি পেয়েছিলেন। টেলিভিশনে সঞ্চালনার কাজ করেছেন। অভিনয় করেছেন টিভি সিরিয়ালেও। বিনোদনের চেয়ে বিতর্কের জন্য পরিচিত রিয়্যালিটি শো ‘বিগ বস’-এও দেখা গিয়েছিল তাঁকে। আবার সরকারি কর্মীকে চটিপেটা (জুতো নয়) করে বিতর্কও বাধিয়েছিলেন।

মৃত্যুর সময় নয় নয় করে ৪২ বছর বয়স হয়েছিল সোনালীর। তবে চেহারা দেখলে বোঝার উপায় নেই। ৪২ বছর বয়সেও বলিউডের কন্যা-সম নায়িকাদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল তাঁর। এহেন সোনালীর মৃত্যুতে তাই কেচ্ছার গন্ধ পেয়েছিলেন অনেকেই। কারণ স্বামী বিয়োগের পরেও যে ভাবে খোলামেলা জীবনযাপন করতেন সোনালী, হাঁটুর বয়সি সুদর্শন অভিনেতার প্রতি যেভাবে প্রকাশ্যে অনুরাগ প্রকাশ করেছিলেন তিনি, তা হজম হয়নি অনেকেরই। তাই প্রদীপের তলায় অন্ধকার থাকলেও থাকতে পারে মনে হয়েছিল। তবে শাসক দলের নেত্রী যেহেতু, তা সোশ্যাল মিডিয়ার মুখরোচক গল্প হয়ে ওঠা ছাড়া, তেমন বড় আকার ধারণ করেনি।

আরও পড়ুন: আপাতত দিল্লিতে বাজিমাত কেজরির! রাজধানীতে আটকানো যাবে ‘পদ্ম ফোটাও অভিযান’?

কিন্তু সোনালীর মৃত্যুর খবর প্রকাশের পর তখনও বেলা গড়ায়নি, প্রথম বোমা ফাটান তাঁর পরিবারের লোকজনই। তাঁরা জানান, মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে ফোনে মা, বোন এবং জামাইবাবুর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন সোনালী। নিজের সহযোগী-কর্মীর বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। খাবার বা পনীয়ের সঙ্গে কিছু মিশিয়ে তাঁকে খাইয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানান। শুধু তাই নয়, তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং সেই ভিডিও তুলে ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে বলেও নাকি ফোনে জানিয়েছিলেন সোনালী, অন্তত এমনই দাবি তাঁর পরিবারের। শুধু তাই নয়, তাঁর ফোন, সম্পত্তির কাজগপত্র, এটিএম কার্ড এমনকী, বাড়ির চাবিও সুধীর আটকে রেখেছেন, ফোনে সোনালী জানিয়েছিলেন বলে দাবি তাঁদের। তবে সোনালীর মৃত্যুর কারণ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও, শুরুতে ময়নাতদন্তে রাজি হননি পরিবারের কেউ। পরে গোয়া মেডিক্যাল কলেজে ময়নাতদন্তের প্রস্তাব দেওয়া হলে রাজি হন।

আর সেই ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টেই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে। জানা যায়, সোনালীর দেহে একাধিক আঘাতের চিহ্ন ছিল। তার ধরন দেখে চিকিৎসকদের মনে হয়, ভারী এবং ভোঁতা কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়ে থাকতে পারে সোনালীকে। এতেই সোনালীর মৃত্যুর কারণ ঘিরে জল্পনা দানা বাধতে শুরু করে। তাতে অন্য মাত্রা যোগ করেন তাঁরই পরিবারের সদস্যরা। গোয়া পুলিশ প্রথমে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের করে। কিন্তু সোনালীর পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে ৩০২ ধারায় খুনের মামলা দায়ের করা হয়। তবে তারপর থেকে একের পর এক যে তথ্য সামনে এসেছে, সিসিটিভি ফুটেজ থেকে পাওয়া যে ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে গুরুতর কিছু একটা যে ঘটেছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।

সোনালীর ব্যক্তিগত সচিব সুধীর সাংওয়ান এবং সহযোগী সুখবিন্দর সিংহ বিরুদ্ধে ধর্ষণ এবং খুনের অভিযোগ দায়ের করেন বিজেপি নেত্রীর পরিবারের সদস্যরা। তার ভিত্তিতেই তদন্তে নেমে গোয়া পুলিশ জানিয়েছে, সোনালীর পানীয়তে MDMA মেশানোর কথা স্বীকার করেছেন অভিযুক্তরা। সোনালীর পানীয়তে ১.৫ গ্রাম MDMA মেশানো হয়েছিল বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। উত্তর গোয়ার যে কার্লিজ রেস্তরাঁয় গিয়েছিলেন সোনালী, সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজে সুধীর এবং সুখবিন্দরের সঙ্গে দেখা গিয়েছে সোনালীকে। একরকম জোর করেই সোনালীকে মাদক মেশানো ওই পানীয় গলায় ঢালতে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ। তার একটি ফুটেজও সামনে এসেছে।

এর পর ভোর ৪টে নাগাদ রেস্তোরাঁর শৌচাগারে ছুটে যান সোনালী। শৌচাগারের ভেতর তিনি প্রায় ঘণ্টাদুয়েক ছিলেন বলে জানা গিয়েছে। ওই সময় অভিযুক্তদের মধ্যে একজনও সোনালীর পিছু পিছু শৌচাগারে গিয়েছিলেন। ওই দু’ঘণ্টায় কী ঘটে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে এরপরই নাকি অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন সোনালী, দাবি পুলিশের। গোয়ায় গ্র্যান্ড লিউনি হোটেলে ছিলেন সোনালী, সুধীর এবং সুখবিন্দর। সেই হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজেও সোনালীকে ধরে নিয়ে যেতে দেখা গিয়েছে সুধীর এবং সুখবিন্দরকে। ভোর সাড়ে ৪টে নাগাদ সেখান থেকেই সেন্ট অ্যান্টনি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় সোনালীকে। সেখানে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। বলা হয়, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। পরে ময়নাতদন্তে আঘাতের চিহ্নের কথা উঠে আসে।

সোনালীর মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে আপাতত ভিসেরা টেস্টের রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছে গোয়া পুলিশ। গোয়া, চণ্ডীগড়, দুই জায়গাতেই ভিসেরা টেস্ট হচ্ছে। রিপোর্ট আসতে সময় লাগবে কয়েকদিন। ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও মৃত্যুর কারণ অধরা। কেমিক্যাল, হিস্টোপ্যাথোলজিক্যাল এবং সেরোলজিক্যাল পরীক্ষার রিপোর্ট এলে, তবেই নিশ্চিতভাবে কারণ জানা যাবে। তবে সুধীর এবং সুখবিন্দরকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশের দাবি, ইচ্ছাকৃতভাবেই সোনালীকে মাদক মেশানো পানীয় গলায় ঢালতে বাধ্য করেছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে দু’জনই স্বীকার করে নিয়েছেন। প্রমাণ যাতে নষ্ট করতে না পারেন, তার জন্যই দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাহলে কি সোনালীকে হত্যার ছকই ছিল দু’জনের! উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ। টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়াই দু’জনের উদ্দেশ্য হতে পারে বলে সন্দেহ পুলিশের।

এর মধ্যেই সোনালীর রহস্যমৃত্যু নিয়ে নানা তত্ত্ব উঠে আসতে শুরু করেছে। সোনালীর ভাই রিঙ্কু ঢাকার দাবি, হিসার থেকে চণ্ডীগড়ের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল সোনালীর। গোয়া যাওয়ার কোনও পরিকল্পনাই ছিল না। তাঁকে খুন করতে সুধীর এবং সুখবিন্দরই জোর করে গোয়া নিয়ে গিয়েছিলেন বলে দাবি রিঙ্কুর। হিসারে সোনালীর বাড়ি থেকে সুধীর ৪০ লক্ষ টাকা চুরিও করেন বলে দাবি তাঁর। সেই নিয়ে থানায় অভিযোগও দায়ের করার পরিকল্পনা ছিল সোনালীর। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, গোয়া যাওয়ার আগে কি বাড়িতে জানিয়েছিলেন সোনালী? তাঁকে জোর করে মাদক মেশানো পানীয় গলায় ঢালতে বাধ্য করলে, আশেপাশের কেউ কেন এগিয়ে এলেন না? সোনালীই বা তাঁদের কথা শুনলেন কেন? বাড়িতে ফোন করে সব জানালেও, কেন পুলিশকে খবর দিতে বললেন না? টাকা চুরি নিয়ে অভিযোগ জানাতে অপেক্ষা করছিলেন কেন? সুধীর এবং সুখবিন্দর ছাড়া আর কেউ কি গোয়ায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন না? মৃত্যুর আগে সত্যিই কি সোনালীর ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়, নাকি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় ধাক্কাধাক্কিতে শরীরে আঘাত লাগে? প্রশ্ন অনেক, কিন্তু উত্তর অধরা।

তবে তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হল, ২০১৯ সালে গোয়ার সমুদ্রসৈকত থেকে শুরু করে প্রকাশ্য জায়গায় মদ্যপান যেখানে নিষিদ্ধ, সেখানে হরিয়ানা থেকে গিয়ে MDMA-র ব্যবস্থা কী করে হয়ে যায়? যদিও স্থানীয়রা তাতে একটুও অবাক হচ্ছেন না। কারণ এ-বছরই জুলাই মাসে গোয়ার বিধায়ক স‌ংকল্প আমোনকর জানান, গোয়ার অলিগলিতে বিকোচ্ছে মাদক। স্কুল, কলেজ, কোনও জায়গা বাদ যাচ্ছে না। পাঞ্জাব নয়, বর্তমানে গোয়াই দেশের মাদক রাজধানীতে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বিধায়ক মাইকেল লোবোও। বিধায়ক অ্যালেক্সিও সেকোয়েরা অভিযোগ করেন যে, সরকার শুধু ছুটকো মাদক বিক্রেতাদের ধরেই হাত তুলে নিচ্ছে। বড় বড় পাচারকারীদের নির্ভয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর সঙ্গে পুলিশও যুক্ত বলে দাবি করেন তিনি। তাঁর অভিযোগ, ছুটকো বিক্রেতাদের জেলে ভরে চোখে ধুলো দেওয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। তার আড়ালে বড় কারবারিদের ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়া হয়। সোনালীর রহস্যমৃত্যু মাদক কারবার রুখতে গোয়া সরকারের ব্যর্থতারও প্রমাণ।

More Articles