বিজ্ঞান জগতে অমার্জনীয় অপরাধ, আপত্তি তুলেও সরব হননি সত্যেন্দ্রনাথ
সাক্ষর সেনগুপ্ত: অন্যায় বা অমার্জনীয় কাজ হিসাবে যদি বিষয়টিকে মেনে নেন, তা হলে তিনি সেটি করেছিলেন বসুর সঙ্গে সাক্ষাতের আগেই। বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী এমন কাজ করেছিলেন, যা বিজ্ঞানের জগতে নজিরবিহীন। অথচ ১৯২০-র মাঝামাঝি মুখোমুখি দেখা হওয়ার পর কিন্তু প্রকাশ্যে সত্যেন্দ্রনাথের কাজের ভূয়সী প্রশংসাই করেছিলেন আইনস্টাইন। বসুর দ্বিতীয় পেপার-এ আইনস্টাইন (যা তিনি নিজেই জার্মানে অনুবাদ করেন) জুড়ে দেন এক ফুটনোট। বসুকে না জানিয়েই। ওই ফুটনোটে আইনস্টাইন লেখেন, বসুর নতুন সম্ভাব্যতা সূত্র আপাতদৃষ্টিতে ভুল। ওই ফুটনোট সহযোগেই ছাপা হয় পেপার। ওই মন্তব্য প্রায় পেপারটিকে হত্যা করার শামিল। আজ কোনও জার্নাল এরকম কাজের অনুমতি দেবে না। পেপার যাঁদের পরীক্ষা করতে পাঠানো হয়, তাঁদের মন্তব্য এলে সে সব পাঠানো হয় গবেষক বা লেখকক। সেই বিষয়ে সংশ্তিষ্ট লেখক যদি মন্তব্যের কোনও সদুত্তর দিতে না পারেন, তা হলে সে পেপার ছাপাই হয় না। ওই রকম বিরূপ মন্তব্য-সহযোগে কোনও পেপার এখন ছাপার রীতি নেই। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সর্বশেষ জীবিত ছাত্র একথা জানিয়েছিলেন ২০২০ সালের ৪ঠা জানুয়ারি, মুম্বইয়ের নেহরু সেন্টারে " S N BOSE - THE IGNORED GENIUS" শীর্ষক বক্তব্যে। এই বক্তব্য মেনে নিলে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান দুনিয়ায় অন্যতম বড় অপরাধই হয়তো সংঘটিত হয়েছিল সকলের অজান্তে।
শুধু এই নয়, আইনস্টাইনের অত্যন্ত প্রিয় একটা ধারণাও যে ভুল, সত্যেন্দ্রনাথ তা ধরিয়ে দিয়েছিলেন নির্দ্বিধায়। আইনস্টাইনের ধারণা ছিল যে, একটি স্তরে পরমাণু থেকে দু’ভাবে রশ্মি নির্গত হতে পারে। একটা স্বতঃস্ফূর্ত আর অন্যটা উদ্দীপিত। সত্যেন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, এই বিভাজনের ধারণা কৃত্রিম এবং অমূলক। কিন্তু কোনওভাবেই সেই বক্তব্য আইনস্টাইন মানতে চাননি। পরে, ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পল অ্যাড্রিয়েন মরিস ডিরাক যে তত্ত্ব প্রস্তাব করেন, তাতেও এই বিভাজন মানা হয়নি। তা ছাড়া, আধুনিক পরীক্ষা দেখিয়ে দিয়েছে, এ ব্যাপারে আইনস্টাইন ভুল তত্ত্বের উপর এগোচ্ছিলেন। স্বতঃস্ফূর্ত বিকিরণ পরমাণুর একান্ত নিজস্ব ধর্ম নয়। এটা বাড়ানো বা কমানো যায়। নেহরু সেন্টারে ৪ জানুয়ারির ওই আলোচনায় সে তথ্যও সর্বসমক্ষে জানিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র সুশান্ত দত্তগুপ্ত। বসু-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান তত্ত্বের নির্মাণে এও যেন এক অকথিত করুণ অধ্যায়।
বিশ্বখ্যাত এই পদার্থবিজ্ঞানী, কোয়ান্টাম স্ট্যাটিসটিক্সের উদ্ভাবক শুধু নন তাঁকে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার পথিকৃৎ বলা যায় । জন্ম, কলকাতায় ১৮৯৪ সালের ১ জানুয়ারি। হিন্দু স্কুল থেকে সত্যেন্দ্রনাথ ১৯০৯ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান আবার রাস্তার ঠিক উল্টোদিকে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯১১ সালে প্রথম স্থান অধিকার করে এফ.এ পরীক্ষা পাশ করেন। এরপর যথারীতি একই কলেজ থেকে ১৯১৩ সালে গণিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি পান সত্যেন্দ্রনাথ। এহেন প্রতিভা যে স্নাতকোত্তরেও একই ফল পাবেন তা আর আশ্চর্য কি? এবং ১৯১৫ সালে মিশ্র গণিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থানসহ এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন।
সেই সময় সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজে সত্যেন্দ্রনাথ ১৯১৫ সাল থেকে ড. মেঘনাদ সাহার সাহচর্যে মিশ্র গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে বিভাগীয় প্রধানের পদেও ছিলেন দীর্ঘদিন যাবৎ। দীর্ঘকাল ধরে বিভাগটি গড়ে তুলতে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যান। সত্যেন্দ্রনাথ এখানে ২৪ বছর একনিষ্ঠভাবে গবেষণা কর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান ও এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফির ওপর গবেষণাত কাজ শুরু করেন, যা পরবর্তীতে তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। ১৯২৪ সালে তাঁর ‘প্ল্যাঙ্কস্ ল অ্যান্ড দি লাইট কোয়ান্টাম হাইপথেসিস’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, যেটি বিজ্ঞানী আইনস্টাইন পাঠ করে অত্যন্ত উৎসাহিত হন। আইনস্টাইন সত্যেন্দ্রনাথের এই প্রবন্ধটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ ও ব্যাখ্যাসহ বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশ করেন। প্রকাশিত প্রবন্ধটি বিজ্ঞান জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং ‘বোস-আইনস্টাইন তত্ত্ব’ নামে সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়। কিন্তু সমস্যার শুরু এরপরেই, সত্যেন্দ্রনাথ যখন আলোককনা সংক্রান্ত গবেষণায় কিছু তথ্য যা পরিমার্জিত হচ্ছে সে বিষয়টি আইনস্টাইনতে জানান বাতিল হযে যায সেউ প্রস্তাব। আক্ষেপ করে সত্যেন্দ্রনাথ ঘনিষ্ঠমহলে জানান, এটা ভুল হচ্ছে, কিন্তু আইনস্টাইন মানতে চাইছেন না।
তাঁর নামানুসারে পরমাণুর এক ধরনের কণিকার নাম রাখা হয় ‘বোসন কণা’। আপেক্ষিক তত্ত্বের কতগুলো জটিল গাণিতিক সমীকরণের পূর্ণ সমাধান করে বিজ্ঞানের ইতিহাসে তিনি আরও একটি কীর্তি স্থাপন করেছিলেন। ১৯২৯ সালে অধ্যাপক বসু ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের পদার্থবিজ্ঞান শাখার সভাপতি এবং ১৯৪৪ সালে মূল সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকের দায়িত্ব নেন। অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত খয়রা অধ্যাপক পদে এবং কয়েক বছর স্নাতকোত্তর বিজ্ঞান বিভাগের ডিন পদে দায়িত্ব পালন করার পর অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত সত্যেন্দ্রনাথ বসু বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৮৫৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এমিরিটাস প্রফেসর’ পদে নির্বাচিত হন। ১৯৫৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসাবে সন্মাননা্ দেয়।
বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৯৫৮ সালে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৫২ সাল থেকে কিছুকাল পর্যন্ত রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ব্যাপারে অধ্যাপক বসু বরাবরই অত্য্যন্ত অগ্রণী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছেন। মূলত সেই লক্ষ্যেই তিনি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’ প্রতিষ্ঠা করেন। আর ওই পরিষদের একটি মুখপত্র মাসিক ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। সেই সময় এই পত্রিকা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই বিজ্ঞানীকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তরফে ‘দেশিকোত্তম’ এবং ভারত সরকার ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতেও ভূষিত করে। কিন্তু ১৯৭৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে পর্যন্ত সত্যেন্দ্রনাথ হয়তো ভুলতে পারেননি তার গবেষণার জগতের গুরুতুল্য ব্যক্তিত্বটির সাথে সেই অনভিপ্রেত মতপার্থ্যকের অযাচিত অধ্যায়।
তথাসূত্র :
- S.N, BOSE - THE IGNORESD GENIUS - SPEECH, NEHRU CENTRE, MUMBAI, 4TH JANUARY, 2020
- সত্যেন্দ্রনাথ বসু - বাংলাপিডিয়া Rift between Einstein & Bose - downtoearth.org.in