ওটেনকে সুভাষ কখনো মারতে চাননি

৮৬/১ কলেজ স্ট্রিট, বইপাড়া। পুরনো বইয়ের মন ভালো করা গন্ধের সঙ্গে এখানে মিশে আছে ইতিহাসের পুরনো গন্ধ। এই অঞ্চলের ইতিউতি ছড়িয়ে আছে পুরনো ইতিহাস। যে ইতিহাস বাংলায় নবজাগরণ আগমনের গল্প বলে, স্বাধীনতার অগ্নিযুগের গল্প বলে, সত্তরের দশকে বুকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে যাওয়া কিছু তরুণ-তরুণীর রোমান্টিসিজমের গল্প বলে এই বইপাড়া। কলেজ স্ট্রিট দেখেছে ডিরোজিও - সুভাষকে, এই বইপাড়ার হাত ধরেই সমগ্র কলকাতাবাসী পরিচিত হয়ে উঠেছে পোড়া ট্রাম, গুলিতে এফোঁড়-ওফোঁড় যুবকের দেহ আর গলাকাটা কনস্টেবলের লাশের সঙ্গে। আজও প্রেসিডেন্সি, হিন্দু বা হেয়ার স্কুলের দেওয়ালে কান পাতলে শোনা যায় এমন অনেক ইতিহাসে স্মৃতিচারণ।

১৯১৩ সালের এক সকাল। সদ্য ঘুমভাঙা চোখে কলকাতা প্রস্তুতি নিচ্ছে আর একটা ব্যস্ত দিনের। এমন সময় প্রেসিডেন্সি কলেজের গেটে এসে দাঁড়ালেন এক তরুণ। সুভাষচন্দ্র বসু। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সারির যোদ্ধা। বস্তুতপক্ষে প্রেসিডেন্সির মাটি থেকেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সুভাষের হাতেখড়ি যা পরবর্তীকালে ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র ভারতে। প্রেসিডেন্সির বুকে এক সময় ডিরোজিওর মতো তরুণ অধ্যাপক উড়িয়ে দিয়েছিলেন যে প্রতিস্পর্ধার জয়ধ্বজা, সুভাষ যেন দক্ষ হাতে বহন করে নিয়ে চললেন তাঁকে। প্রেসিডেন্সিতে এলেও এখানে পড়াশোনা সম্পন্ন করতে পারেননি সুভাষ। একের পর এক জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েছিলেন কলেজ জীবন থেকেই । সেই সময়ে প্রতিনিয়ত নতুন ভাবে আঁকতে হচ্ছিল আমাদের জীবনের যাপনচিত্র, ব্যতিক্রম ছিলেন না সুভাষচন্দ্র বসু। কটকের সেই একরত্তি ছেলেটাকে সময় যেন ভেঙেচুরে নিজের মতো করে গড়ে নিল পরবর্তী কয়েকটা বছরে।

হিন্দু হোস্টেলের বার্ষিক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানকে ঘিরেই বিতর্কে সূত্রপাত, যার জল পরবর্তীকালে গড়িয়েছিল অনেকদূর।' বঙ্গ আমার জননী আমার ' গানটি তখন ইংরেজ সরকারের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে ইংরেজ সরকারের অত্যাচারের গ্রাফ। হিন্দু হোস্টেলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে ইংরেজ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ' বঙ্গ আমার জননী আমার ' গানটি পরিবেশন করলেন হোটেল আবাসিকরা। অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন ওটেন। তিনি সহ্য করেননি ছাত্রদের এই অবাধ্যতা। বক্তৃতার সময় ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে বেশ কিছু বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করলেন ওটেন। বিরুদ্ধতার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র প্রেসিডেন্সিতে। হিন্দু হোস্টেলের ডাকে শুরু হলো অনির্দিষ্টকালীন ছাত্র ধর্মঘট। অবশ্য এর আগে ছাত্রদেরকে প্রতিনিধিরূপে পাঠানো হয়েছিল সুভাষকে, অধ্যক্ষের কাছে সুভাষ দাবি জানান ওটেন যেন তার মন্তব্যের জন্য ছাত্রদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। প্রথম দিকে মানতে না চাইলেও, পরবর্তী সময়ে ছাত্র আন্দোলনের কাছে অধ্যাপক ওটেন নতিস্বীকার করে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে বাধ্য হলেন।

আরও পড়ুন-সুভাষ না রাসবিহারী, বাঙালির প্রাণের নায়ক সব্যসাচী আসলে কে!

এর কিছুদিন পরেই আবার ওটেনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। প্রতিবাদের সুভাষ পুনর্বার ছাত্রধর্মঘটের ডাক দিলেন। সুভাষের কথা মতো, প্রেসিডেন্সি কলেজে এই ধর্মঘটের সাফল্যে সারা শহরে প্রবল উত্তেজনার কারণ হয়েছিল, ধর্মঘটের ছোঁয়াচ ছড়িয়ে পড়তে লাগলো এবং কর্তৃপক্ষ ঘাবড়াতে শুরু করলেন। ধর্মঘটে যোগ দেওয়া ছাত্রদের উপর জরিমানা ধার্য করে আন্দোলনের মেরুদণ্ড ভাঙতে চেয়েছিল প্রেসিডেন্সি কর্তৃপক্ষ। এরপরেও ছাত্ররা আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসেনি। শেষ পর্যন্ত ওটেন আবারও ছাত্রদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। যদিও ছাত্রদের জরিমানা প্রত্যাহার করা হয়নি।

১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। প্রবল বাকবিতণ্ডা শুরু হয় হিন্দু হোস্টেলের আবাসিক এবং ভারতবিদ্বেষী ওটেনের মধ্যে। এবার তার বিরুদ্ধে ছাত্রদের অভিযোগ ছিল আরও মারাত্মক। ওটেন নাকি বেশ কিছু ছাত্রকে শারীরিক নির্যাতন করেছিলেন। বাক বিতন্ডার মধ্যেই হিন্দু হোস্টেলের আবাসিকরা ওটেনকে নির্মমভাবে প্রহার করে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুভাষ ওই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। না এই ঘটনায় কাউকে পাশে পায়নি ছাত্রসমাজ। একমাত্র রবীন্দ্রনাথ 'ছাত্রশাসনতন্ত্র'তে লিখেছিলেন, "কিন্তু ছাত্রকে জেলের কয়েদি বা ফৌজের সিপাই বলে আমরা মনে করতে পারি না। অতএব যাদের উচিত ছিল জেলের দারোগা, বা ড্রিল সার্জেন্ট বা ভূতের ওঝা হওয়া তাদের কোনোমতেই উচিত নয় ছাত্রদের মানুষ করবার ভার লওয়া।"

এই ঘটনার সঙ্গে সুভাষ যে কোনোভাবেই যুক্ত ছিলেন না তার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রমথনাথ সরকারের লেখায়, " তখন তিনটে কি চারটে বাজে, শেষ পিরিয়ডের শেষে ওটেন সাহেব সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। তখন হিন্দু হোস্টেলের কয়েকজন বাছা বাছা ছেলে যারা পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিল তারাই মেরেছিল।"

অনঙ্গমোহন দাস ছিলেন সেই দলে। তিনি বলেন, " ওটেন পড়ে গেলে আমি ও বিপিন দে তাকে দু - চার ঘা দিই। ওই মারামারিতে সুভাষ ছিল না।"

সুভাষ এই মারামারিতে না থাকলেও বেয়ারা বংশীলালের সাক্ষ্য অনুযায়ী সুভাষ এবং অনঙ্গমোহন দাস দু'জনকেই কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হল।

ইতিহাস বড় বিশ্বাসঘাতক। তাই বোধহয় সে বড় সহজেই দুয়ে দুয়ে চার করে ফেলতে পারে। তবে একথা সত্যি সেদিন যে বিদ্রোহের মশাল জ্বলেছিল সুভাষের হাতে, তা পরবর্তীকালে আলো যুগিয়েছে সারা ভারতবর্ষকে।

তথ্যসূত্র :-
১. ' দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র ' - পার্থ গোস্বামী
২. আনন্দবাজার পত্রিকা
৩. কলকাতাট্রিবিউন.ইন

More Articles