প্রতিপক্ষ গোটা বিজেপি নয়, অভিযোগেই প্রমাণ লড়াইটা আসলে অভিষেক বনাম শুভেন্দুর
তীব্র হচ্ছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং একদা তৃণমূলের সৈনিক, মমতা-শিষ্য শুভেন্দু অধিকারীর সম্মুখ সমর!
বিজেপি ঠেকাতে এক ঢিলে দুই পাখি মারার কৌশল নিচ্ছে তৃণমূল! রাজনৈতিকভাবে 'কঠিন স্তম্ভ'কে কাবু করলেই কেল্লা ফতে! দুর্নীতিকে হাতিয়ার করে আর বাড়তে না দেওয়ার কৌশল নিচ্ছেন তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব! সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ইঙ্গিত দিচ্ছে ঠিক এমনই। কারণ, তৃণমূল-বিজেপি অথবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-বিজেপি লড়াই ঠিক যতটা প্রকাশ্যে আসছে, তার অনেক বেশি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিজেপি-র বিবাদ প্রকাশ্যে আসছে নিরন্তর। সিপিএম, কংগ্রেসের 'সেটিং তত্ত্বে'র আবহেই এই লড়াই উপস্থাপিত হচ্ছে বঙ্গবাসীর সামনে। যেখানে রাজনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে নীতির লড়াইয়ের আঙ্গিকেই ক্রমশ জায়গা করছে ব্যক্তিগত লড়াই। অর্থাৎ মমতার দল তৃণমূল আর বিজপি বা সিপিএম, কংগ্রেসের লড়াই নয়, বঙ্গের রাজনীতিতে তীব্র হচ্ছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং একদা তৃণমূলের সৈনিক, মমতা-শিষ্য শুভেন্দু অধিকারীর সম্মুখ সমর! যেখানে অস্ত্র হিসেবে সুর চড়াচ্ছে দুর্নীতি। গরু, কয়লা পাচারের আবহে চড়ছে পারদ।
গরু পাচার, কয়লা পাচার দুর্নীতিতে একাধিকবার তলব করা হয়েছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ২ সেপ্টেম্বর সল্টলেকের নিজাম প্যালেস-এর ইডি দফতরে কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদককে। প্রতিবারই ইডি-কে সহযোগিতার কথা বলে হাজিরা দিয়েছেন অভিষেক। কালো পোশাকে পরোক্ষে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শানিয়েছেন তিনি। যা তীব্রতর হয়েছে ২ তারিখ। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজাম প্যালেস থেকে বেরিয়ে দাবি করেন, পলাতক অভিযুক্ত বিনয় মিশ্রর সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর। তৃণমূল নেতার দাবি, বিনয়ের সঙ্গে আট মাস আগে ফোনে কথা বলেছেন শুভেন্দু। শুধু কথাই নয়, কেস দেখে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে ওই বিজেপি নেতার তরফে। অভিষেকের চ্যালেঞ্জ, এই কথোপকথনের প্রমাণ তিনি আদালতে জমা দেবেন। তিনি মিথ্যা বললে, শুভেন্দু যেন মানহানি মামলা করেন। বিজেপি-কে হুঙ্কার দেন অভিষেক। এরপরেই অস্বস্তি বাড়ে বঙ্গ বিজেপি-র। একচেটিয়া তৃণমূল এবং দুর্নীতি বিরোধিতার ইস্যুতে নেমে আসে তাঁদের নেতা শুভেন্দুর নাম। বাড়ে বিতর্ক। যদিও অভিষেকের এই অভিযোগের পরেই পাল্টা সরব হন শুভেন্দু। তাঁর দাবি, ওই অডিও ক্লিপের সঙ্গে আমার নম্বরও দেখাতে হবে, নইলে সুদীপ্ত সেনের চিঠির মতো, এটাও সাজানো প্রমাণিত হবে। শুভেন্দুর সুরেই তৃণমূলকে আক্রমণ করতে শুরু করেন রাজ্যের বিজেপি নেতারা। পাল্টা অভিষেক-সুরেই আক্রমণ শানায় তৃণমূলও।
আরও পড়ুন: বিজেপিই রক্ষাকবচ, শুভেন্দুর গায়ে আঁচ না লাগা প্রমাণ করছে সেকথাই?
যদিও এই আবহেই উত্তরপাড়ার দোলতলায় নবান্ন অভিযান কর্মসূচির সমর্থনে মিছিল এবং মিছিল শেষের সভা থেকে বিস্ফোরক অভিযোগ করেন শুভেন্দু। 'অভিষেকের স্ত্রী রুজিরা নারুলার ব্যাংককের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। যা ২০১৯ সালে বন্ধ করা হয়। সেই টাকা রুজিরার বোন মেনকা গম্ভীরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরিয়ে দেওয়া হয়।' এমনকি শুভেন্দুর দাবি, "ওই টাকায় আট ব্যাগ সোনা কেনেন রুজিরা। যা আনতে গিয়ে কলকাতা বিমানবন্দরে ধরা পড়েন তিনি। পরে জ্ঞানবন্ত সিংহের নেতৃত্বে বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের কয়েক'শো পুলিশকর্মী গিয়ে সেই ব্যাগ উদ্ধার করে নিয়ে আসে।"
অভিষেক এবং তাঁর স্ত্রী রুজিরার বিরুদ্ধে বারবার সরব হয়েছেন শুভেন্দু। একদা মমতার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের তৃণমূল নেতা দাবি করেছেন, একের পর এক দুর্নীতির সঙ্গে অভিষেকের জড়িত থাকা নিয়ে। অস্বস্তিতে পড়েছে তৃণমূল। শুভেন্দুর মামলা, দাবি, অভিযোগ; বঙ্গ বিজেপির রাজনৈতিক লড়াইয়ে অক্সিজেন জুগিয়েছে। পাল্টা একটু হলেও অস্বস্তি বেড়েছে তৃণমূলে। ঠিক এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বিজেপির সামগ্রিক রাজনৈতিক বিরোধিতায় প্রধান উপজীব্য হয়েছে শুভেন্দু-বয়ান। যেখানে অভিষেককে করা হয়েছে বারবার টার্গেট। যা বিজেপির অভ্যন্তরে নেতাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব। দলীয় কোন্দল। এক অংশের শুভেন্দু-বিরোধিতা কমিয়ে সামনে এনেছে হাতে গরম ইস্যু। এই পরিস্থিতিতে বঙ্গ বিজেপি-কে ঠেকানোর চেয়েও তৃণমূলের কাছে রাজনৈতিক টার্গেট হয়েছেন শুভেন্দু। পুরনো বন্ধু, বর্তমান শত্রুকে ঠেকানোর কৌশল খুঁজেছেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা। সেই প্রেক্ষাপটে অভিষেকের প্রমাণ-সহ অভিযোগ এবং সরাসরি কেন্দ্রীয় এজেন্সির অপব্যবহারের দাবির সঙ্গে শুভেন্দুর নাম করে অভিযোগ, তৃণমূলের বিরোধিতার পালে খানিকটা হাওয়া লাগিয়েছে।
রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, অভিষেককে আক্রমণ মমতার ভাবমূর্তিতে খুব একটা সুখকর হয়নি, সেখানে বারবার শুভেন্দু নাম করে অভিযোগ করেছেন। যেখানে দাঁড়িয়ে সমগ্র বঙ্গ বিজেপি-র আপাত নিষ্ক্রিয়তায় শুভেন্দু এনে দিয়েছেন রাজনৈতিক ঢাক বাজানোর কাঠি। সেই পরিস্থিতিতে বারবার আক্রমণে বিদ্ধ হতে হতে শুভেন্দুর বিরুদ্ধে প্রমাণ-সহ যুক্তিগ্রাহ্য অভিযোগের দিকেই হাঁটতে চাইছিল তৃণমূল। যেখানে 'শুভেন্দু নিয়ে অখুশি বিজেপি'-র একাংশের হাতেও অস্ত্র তুলে দেওয়া যাবে। এর পাশাপশি দলের অন্দরে শুভেন্দুর একছত্র আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা খানিকটা খর্ব হবে! যা তৃণমূলের পক্ষে শুভেন্দু-ঠেকানোর মোক্ষম অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। সেই রাজনৈতিক কৌশলই অভিষেককে পাল্টা সরব করিয়েছে। যেখানে দুর্নীতির কিন পিন বিনয় মিশ্রের সঙ্গে শুভেন্দুর যোগাযোগের তথ্য নড়িয়ে দিয়েছে বঙ্গের রাজনৈতিক বিরোধিতার ভিত। যা মিথ্যা বলেও সরাসরি দাবি করেননি শুভেন্দু! উপরন্তু বিনয় মিশ্রের ভাই জেলবন্দি বিকাশের সঙ্গে অভিষেকের কথা বলার দাবি করেছেন শুভেন্দু অধিকারী। অর্থাৎ 'আমি একা নই, আছ তুমিও'- এইরকম একটা আবহ তৈরি হয়েছে বঙ্গের রাজনৈতিক অলিন্দে। যা তৃণমূলের নারদাকাণ্ডে অভিযুক্ত শুভেন্দুকে কোণঠাসা করার সার্থক কৌশল হলেও, তা যে খুব একটা সুবিধার হবে না, তা-ও বলে রাখছেন রাজনৈতিক মহলের ওই অংশ।