কুরিয়ানের সমবায় স্বপ্ন, দেশের ঘরে ঘরে 'আমুল' বদল যে ভাবে সম্ভব হল

ছোট্ট মেয়েটির পরনে লাল পলকা ডটের জামা। মাথার নীল ছিল ফিতে দিয়ে পরিপাটি করে বাঁধা।হতে কখনও দুধের গ্লাস বা মাখন লাগানো এক টুকরো পাউরুটি। আধো আধো গলায় 'আটালি বাটালি ডিলিসিইয়াস'। রাজনীতি থেকে শুরু করে বিনোদন জগতের সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একরত্তি এই মেয়ের প্রতিক্রিয়া দেশবাসীর মন কেড়েছে বারে বারে। কে এই ছোট্ট মেয়ে?  আমুল গার্ল, ভারতবাসীর কাছে আলাদা করে তার পরিচয় দেবার প্রয়োজন নেই। ৭৫ পেরিয়ে আমুল আজও দেশবাসীর হৃদাকাশে ধ্রুবতারা। আর এই  জাহাজের কাপ্তান কে? কেমন তাঁর উত্থানের পথ?

পরাধীন ভারতে কৃষকদের উপর চরম অত্যাচারের কথা কারও অজানা নয়। এমনই এক প্রেক্ষাপটে জন্ম হয় আমুলের। সময়টা ১৯৪২-৪৩। বোম্বের ডেয়ারি কোম্পানি পলসন অ্যান্ড পলসন গুজরাটের আনন্দ এলাকার কৃষকদের থেকে খুব কম দামে দুধ কিনে তা চড়া দামে বাজারে বিক্রি করত।ভারতের বাজারে একচেটিয়া ব্যবসা ছিল পলসন কোম্পানির। ইংরেজ সরকারের থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত এই সংস্থা ঠিকমতো বেতন না দেওয়ায় কৃষকরা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। তৎকালীন প্রভাবশালী নেতা সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল ও মোরারজি দেশাইয়ের বুদ্ধিমতো ত্রিভুবন দাস প্যাটেলের উদ্যোগে তৈর হয় কায়রা জেলার সমবায় দুগ্ধ উৎপাদক ইউনিয়ন লিমিটেড। ১৯৫৫ সালে এই সংস্থার নাম হয় আমুল। কায়রা জেলার এই সমবায়কে আমুলে রূপান্তরিত করার মূল কারিগর ছিলেন ডক্টর ভার্গিস কুরিয়ান।

কে এই ভার্গিস কুরিয়ান

১৯২৬ সালে কেরালার কালিকুটে  জন্ম হয় কুরিয়ানের। দেশে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে বেশকিছুদিন বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন তিনি কিন্তু মন টেকেনি সেখানে। এরপর ইংরেজ সরকারের স্কলারশিপের টাকা বিদেশে ডেয়ারি ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রশিক্ষণ নিতে যান কুরিয়ান। ফিরে এসেও কাজে যোগ দিতে চাননি কারণ তাঁর মন পড়েছিল নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে।  কিন্তু সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার তিনি বাধ্য হন সরকারি চাকরি গ্রহণ করতে। গুজরাটের আনন্দে ন্যাশনাল ডেয়ারি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন কুরিয়ান। এখানেই তাঁর পরিচয় হয় ত্রিভুবনদাস প্যাটেলের সঙ্গে। এর পরবর্তী ঘটনার সাক্ষী আমরা সকলেই। তিনি ভারতের দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনের মানচিত্রই বদলে দেন। কুরিয়ান আমুলকে ভারতের সর্বাধিক বিক্রিত দুগ্ধজাত পণ্যের ব্র্যান্ডে রূপান্তরিত করেন। 

আরও পড়ুন-মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগে আগ্রহী? জানুন এ বছর কোথায় বিনিয়োগ করলে সর্বাধিক লাভ

কুরিয়ানের দূরদর্শিতা

সরকারি পদে থাকাকালীনই তিনি ত্রিভুবন দাস প্যাটেলের তৈরি সমবায়কে সাহায্য করতে থাকেন। কিছু সময় পরে সরকারি চাকরী থেকে ইস্তফা দিয়ে মুম্বই ফিরে আসবেন বলে ঠিক করে। কিন্তু ত্রিভুবনদাস পটলের অনুরোধ ফেলতে পারেননি কুরিয়ান।কাজে ইস্তফা দিলেও তাই আর ফিরতে পারেন নি মুম্বইয়ে। জন্ম দিয়েছিলেন নতুন এক বিপ্লবের। গ্রামীণ দুগ্ধ উৎপাদন শিল্পের সাথে আধুনিক শিল্পের মেলবন্ধন ঘটান কুরিয়ান।  পাশাপাশি গ্রামের মানুষদের স্বনির্ভরও করে তোলেন তিনি। এই দুইয়ের মিশেলে কুরিয়ানের শিল্প মডেল হয়ে ওঠে স্বতন্ত্র।

প্রযুক্তির খেল

প্রতিদিন ২৪৭ লিটার দুধের উৎপাদন থেকে দিনে ২০ হাজার লিটার হতে সময় লাগেনি খুব বেশিদিন। শুধু গরুর দুধে আটকে না থেকে মোষের দুধকেও কাজে লাগান কুরিয়ান। একই সঙ্গে সারা বছর দুধের যোগান বজায় রাখতে তিনি অতিরিক্ত দুধকে গুঁড়ো দুধ হিসেবে সংরক্ষণ করার পথে হাঁটেন ।এর ফলে ঘাটতির সময় প্রাপ্ত দুধের সাথে তা মিশিয়ে সবসময় দুধের যোগান অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়। কুরিয়ান কাজে যোগ দেবার পরই এই সংস্থার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতে।একাধিক আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এগোতে থাকেন এই সংস্থা।

ভারতে প্রথম আমুলই দুধ উৎপাদনের ড্রায়ার স্প্রেয়ার প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিল। মোষের দুধে শুকনো করার জন্য এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ১৯৭০ সালে দেশব্যাপী শ্বেত বিপ্লবের নায়ক ছিলেন কুরিয়ান। সে বছর ' অপারেশন ফ্লাড' নামক প্রজেক্টটি চালু করেন ন্যাশনাল ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড যার ফলে প্রচুর উৎপাদক আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হয়ে ওঠেন। ভারতের বানিজ্য-ইতিহাসে এই ঘটনা শ্বেত বিপ্লব নামে পরিচিত।

আমুলের সেই খুদে

এরপর একের পর এক পণ্য বাজারে নিয়ে এসেছেন আমূল। গুঁড়ো দুধ থেকে শুরু করে ঘি, মাখন, চিজ, আইসক্রিম এমনকি এই সময়ের আমূল লস্যি সবই সমানভাবে জনপ্রিয় ভারতবাসীর কাছে। উৎপাদনের গুণমানের পাশাপাশি কোম্পানির প্রচার কৌশল ও ছিল অসাধারণ। কুরিয়ান আমুল মাখনের বিজ্ঞাপনের দায়িত্ব দেন মুম্বইয়ের এডভার্টাইজিং এন্ড সেলস প্রমোশন কোম্পানিকে। সংস্থার আর্ট ডিরেক্টর ইউস্টাজে ফার্নান্ডেজ ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর সিলভেস্টার ডি কুনহা আমুলের ম্যাসকট গার্লকে বাজারে নিয়ে আসেন। এর পিছনেও অবদান রয়েছে কুরিয়ানের। কুরিয়ান বলেন, এমন একটা ম্যাসকট তৈরি করতে হবে যা সহজেই  ভারতের প্রতিটি গৃহবধূর দৃষ্টি আকর্ষন করবে। আরও বলেন এমন একটা ম্যাসকট হওয়া চাই যা সহজেই মনে রাখা সম্ভব ও আঁকা সম্ভব। কারণ সে সময় হোর্ডিং  রংতুলি দিয়েই ছবি আঁকা হত। 

সমবায়ের স্বপ্ন

মজার ব্যাপার, চলচ্চিত্রেও সমবায় প্রয়াসের সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন কুরিয়েন। তার নেতৃত্বেই ‘অপারেশন ফ্লাড’-এর কাহিনি নিয়ে শ্যাম বেনেগাল তৈরি করেন বিখ্যাত ছবি, মন্থন (১৯৭৬)। গল্প লিখতে সাহায্য করেন কুরিয়েন নিজেই। ছবির খরচ দেন গুজরাট সমবায় প্রকল্পের পাঁচ লক্ষ দুধ উৎপাদক। দুই টাকা করে চাঁদা দিলেন সকলেই। গিরিশ কারনাড-স্মিতা পাতিলকে নিয়ে তৈরি হল 'মন্থন'। পরে ‘আমুলে’র বিজ্ঞাপনেও ব্যবহার করা হয়েছে সেই গান, ‘মেরো গাম কথা পারে ঝা দুধ কি নদিয়া বাহে...।’

২০১৯- ২০  অর্থবর্ষে আমুলের বাজারদর দাঁড়িয়েছে ৫.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কুরিইয়ানের আমুলের দৌলতে ভারত বিশ্বের এক নম্বর দুধ উৎপাদনকারী দেশ। আজও দেশবাসীর কাছে দুধ, মাখন মানেই আমূল। নামিদামী শপিং মল বা প্রত্যন্ত গ্রামের কোনও দোকান, আমুলের পণ্য সর্বত্রই সমানভাবে গ্রহণযোগ্য।

অবাক করার বিষয় হল কুরিয়ান নিজে কখনই দুধ খাননি । অথচ তাঁর হাত ধরেই দেশের দুধ উৎপাদনের খোলনলচে বদলে গেছে । কুরিয়ানের আমুল আজও আক্ষরিক ' দ্য টেষ্ট অফ ইন্ডিয়া'।

More Articles