রান্নাঘরে যাত্রা শুরু, আজ ঠাঁই লাখো দেশবাসীর হৃদয়ে, ভিকো-র লড়াইটাকে স্যালুট
এক কামড়েই আখরোট ভেঙে ফেলছেন এক বৃদ্ধ ব্যক্তি-নব্বয়েই দশকে দূরদর্শনের পর্দায় এই দৃশ্য ভেসে উঠতেই বুঝতে সমস্যা হয় না এটা ভিকো বজ্রদন্তির বিজ্ঞাপন। আট থেকে আশি-এই বিজ্ঞাপন প্রত্যেক ভারতবাসীর মনেই ছাপ ফেলেছিল। সঙ্গে ছিল হ্লুদের গুণসম্পন্ন ভিকো টারমারিক ক্রিম। গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়েছে, নিউ ইন্ডিয়া এখন অনেকটাই ঝাঁ চকচকে। কিন্তু নিরন্তর পশ্চিমা ঝড়েও ভিকো যেন এক অনড় খেয়া। ভারতের বাজারে দেশীয় ব্র্যান্ডগুলির মধ্যে অন্যতম সফল ব্র্যান্ড বিষ্ণু ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যালস কোম্পানি, সংক্ষেপে ভিকো যেন অনেকটা বাড়ির সেই বৃদ্ধদের মতো, যাদের চৌখস হালফিলের ফ্যাশান নেই, তবে দার্ঢ্যে কাঁপে পাড়া। বিশ্বাসীরা বলেন ভিকো মানে স্বদেশচেতনা। কেন, সে গল্পই বলছি।
সালটা ছিল ১৯৫২। সদ্য স্বাধীন হওয়া ভারতবর্ষে তখন প্রথম ভোটের দামামা বেজে উঠেছে। প্রত্যেক দেশবাসীর মনে তখনও ভরপুর স্বদেশপ্রেম। এমন সময়েই মুম্বইয়ের প্যারেলের বাসিন্দা কেশব পেনধারকর ভারতের বাজারে নিয়ে এলেন প্রথম দেশীয় ভিকো টুথপাউডার। কাপড়ের ব্যাগে ছোট একটি বাক্সে বিক্রি হত ভিকো বজ্রদন্তি টুথপাউডার। মহারাষ্ট্রের নাগপুরে একটি ছোট মুদি দোকান চালাতেন কেশব পেনধারকর। এক সময়ে সেসব বিক্রি করে দিয়ে পাড়ি দেন মুম্বইয়ের উদ্দেশ্যে। মুম্বইয়ের বান্দ্রা এলাকায় ছোট্ট একটি ব্যবসা শুরু করেন। পুঁজি নেই বললেই চলে, তবে মুম্বইয়ে তিনি যেটা শিখলেন সেটা রীতিমতো গুপ্তবিদ্যা। বিপণনের সাত সতেরোও দক্ষ হয়ে উঠলেন তিনি। পরবর্তীকালে মুম্বইয়ের পারেল থেকে যখন কাজ শুরু করেন তিনি, খোলাবাজারে মাল বিক্রির এই শিক্ষাই তাঁর উড়ানের মন্ত্র হয়েছিল। তিনি জানতেন কী ভাবে হাজার পণ্যের মাঝে নিজের ঠাঁই তৈরি করতে হয়।
বাজার যখন অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ এবং পন্ডস, নিভিয়া, আফগান স্নোর মত বিভিন্ন প্রসাধন সামগ্রীতে ভরে গিয়েছে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন প্রাকৃতিক, আয়ুর্বেদিক পণ্য দিয়েই ব্যবসা শুরু করবেন। আজ একেই আমরা বলছি অরগ্যানিক। যাই হোক, যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। বাবার নাম অনুসারে কোম্পানির নাম দিলেন বিষ্ণু ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যালস। রাসায়নিকবিহীন ঔষধি দাঁতের পাউডার দিয়ে শুরু হল ভিকোর পথচলা। বিজ্ঞাপন বলছে, তখনকার সময়ে ভিকোই ছিল ভারতের বাজারে একমাত্র টুথপেস্ট যা দাঁত ঝকঝকে করার পাশাপাশি মাড়িকেও মজবুত করত। এখন আমরা টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে প্রায়ই বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহারের কথা প্রচার করতে শুনি কিন্তু ভিকো সেই সময়েই ১৮ রকম প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে তৈরি করেছিল এই টুথপাউডার। বিজ্ঞাপনী পরিভাষায় একেই বলে ক্যারেক্টার বিল্ডিং। সাদামাটা গেটআপ নিয়ে লোকের মনজয় করতে ভিকোর অসুবিধে হয়নি কারণ সে জোরালো চরিত্র তৈরি করতে পেরেছিল, কেন মানুষ দেশি ব্র্যান্ড কিনবে তা বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলেন কেশব পেনধারকরা।
আরও পড়ুন-স্বদেশি আন্দোলনের উত্তরাধিকার, ১০০ কোটির নস্টালজিয়ার নাম পার্লে-জি
বর্তমানে কোম্পানির দায়িত্বে থাকা সঞ্জীব পেনধারকারের মতে, ১৯৫০ এর সময়ে ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেস্টের কারণে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা হতে শুরু করে। শিশুদের জন্য এমন টুথপেস্টের ব্যবহারে উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়। সেই সময়ে আয়ুর্বেদিক এই টুথপাউডার মানুষের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। কেশব পেনধারকর তাঁর এক আত্মীয়ের কাছ থেকে আয়ুর্বেদিক শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেন। এরপরে তিন কামরার ঘরের রান্না ঘর হয়ে ওঠে কোম্পানির উৎপাদন ইউনিট, অন্য দু'টি ঘরের একটি গোডাউন ও অন্যটি কোম্পানির অফিসে পরিণত হয়। নিজেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করতেন এই টুথপাউডার। অভিনব কায়দায় জিতেও নিয়েছিলেন মানুষের মন। পেনধারকার বলতেন," আপনার পছন্দের নয়, আপনাদের প্রয়োজনের জিনিস বিক্রি করি আমি "। কোম্পানি শুরুর চার বছরের মাথায় লাভের অঙ্ক বাড়তে শুরু করলে ফ্যাক্টরি-স্পেস বা কারখানার জায়গা তৈরি করে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন শুরু করেন তিনি। পরে সময়ের সঙ্গে পেনধারকরের তিন ছেলেও ব্যবসায় যোগ দেন। এক সময়ে বাজারের চাহিদায় টুথপাউডার বদলে হয় টুথপেস্ট, সঙ্গে সঙ্গেই নিজেদেরও বদলে ফেলে ভিকো। আসলে দেশবাসীর নার্ভটা বুঝতেন মুম্বইয়ের বাজারে মালের সওদা করতে আসা কেশবজী। আর তাতেই কিস্তিমাত।
এরপরেই বাজারে আসে ভিকো টারমারিক ক্রিম। হ্লুদের গুনাগুণকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা এই ক্রিম স্বাস্থ্যকর ও উজ্জ্বল ত্বকের প্রতিশ্রুতি দেয়।এই ক্রিমের হাত ধরেই ভারতের প্রতি ঘরে পৌঁছে যায় ভিকো। ১৯৭১ সালে কেশব পেনধারকরের মৃত্যুর পর কোম্পানির দ্বায়িত্ব নেয় ছেলে গজানন পেনধারকর। পরবর্তীকালে বিভিন্ন প্রকারের তেল, ক্রিম পেস্ট বাজারে নিয়ে আসে এই সংস্থা। পরবর্তী বছরগুলিতে, সংস্থাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ ৩৫ টি বাইরের দেশে পণ্যগুলি রপ্তানি করতে শুরু করে। এ উড়ান মসৃণ, তিলে তিলে কেশব যে স্বপ্ন গড়েছিলেন তা সাকার হল গজাননের বৃষস্কন্ধেই।
আরও পড়ুন-বড়দিনের মিষ্টিমুখ, ৯০ পেরিয়ে আজও নবীন সালদানহা, রইল তিন নারীর অসাধ্যসাধনের গল্প
তবে চলার পথে আইনি বাধাও এসেছে। প্রতিবারই নিপুণ বিজ্ঞাপন কৌশলের মাধ্যমে জয় করেছেন দুস্তর পথ। ১৯৭৮ সালে কেন্দ্রীয় আবগারি দপ্তর কোম্পানির ওপর প্রসাধন সামগ্রী উৎপাদনের আওতায় কর চাপাতে চাইলে কোম্পানির তরফে স্পষ্ট জানানো হয় তাঁরা শুধুমাত্র আয়ুর্বেদিক পণ্য উৎপাদন করেন। অভিনব কায়দায় এই সময়ে বিজ্ঞাপনেও প্রচার করা হয় এটি কোনো কসমেটিক পণ্য নয়। তবে আদালতের রায় কোম্পানির পক্ষেই আসে। দ্বিতীয় বার ১৯৮৫ সালে কেন্দ্রের নতুন কর আইন বাস্তবায়নের সময়েও একই সমস্যার মুখে পড়ে কোম্পানি। তবে এবারেও সুপ্রিম কোর্ট কোম্পানির পক্ষেই মামলার রায় দেন।
২০১৯ সালে নতুন তরুণ প্রজন্মকে টানার জন্য আলিয়া ভাটকে কোম্পানির মুখ করা হয়। সাত দশক কেটে গেলেও আজও পেনধারকরের পরিবারের লোকেরাই ব্যবসা চালান। পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের হাতে এখন ব্যবসার কোম্পানির দ্বায়িত্ব। তাঁদের চোখ ভরা স্বপ্ন ও মনে আশা একদিন ভিকো বিদেশের সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে পড়বেই।