একটা গাড়িও নেই, এক চিলতে ঘরেই জীবনটা কাটিয়ে দিলেন 'ডাক্তারবাবু' সূর্যকান্ত মিশ্র
পাম অ্যাভিনিউয়ের ছোট ফ্ল্যাটে জীবন কাটালেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ছাদে একটা ছোট্ট ঘরে থাকেন বিমান বসু।
একদিকে যখন শাসকদলের চুনোপুটি নেতাদের জাহাজবাড়ি দেখে আঁতকে উঠতে হচ্ছে, যখন অহরহ দুর্নীতির খবরে মাথা ঘুরে যাচ্ছে, তখনই সামনে আসছে এই নেতাদের ছবিটাও। যারা ভিড়ের মধ্যে অন্যরকম আজও। যারা অনাড়ম্বর জীবনকেই বেছে নিয়েছেন স্বেচ্ছায়, এমনকী তা নিয়ে ঢাক পেটাতেও জাননি। সেই তালিকায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসুর পাশেই সংযোজিত নাম সিপিএম-এর প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। এই বাম নেতাদের অনাড়ম্বর জীবন কি হয়ে উঠতে পারে না আজকের নেতা-মন্ত্রীদের জন্য সহজপাঠ?
এসএসসি দুর্নীতি সামনে নিয়ে এসেছে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় কীভাবে কুবেরের বিষয় আশয় তৈরি করেছেন, তার হালহকিকত। এরপর এই তালিকায় ফলাও করে উঠে আসে অনুব্রত মণ্ডলের লামাগহীন সম্পত্তির ঠিকানা। প্রকাশ্যে আসে তৃণমূলের ছোট বড় সব নেতা মন্ত্রী এই কয়েক বছরে কীভাবে গুছিয়ে নিয়েছেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে। রাজ্যের নানা প্রান্তে ইমারত, গ্যারেজে বিলাসবহুল গাড়ির লাইন, বছরে নিয়ম করে বিদেশ ভ্রমণ এবং অবশ্যই কালো টাকা। তৃণমূলের মা-মাটি-মানুষের সরকারের বিভিন্ন স্তরীয় নেতা মন্ত্রী, আমলাদের জীবনধারা এভাবেই চর্চায় উঠে আসছে। সৌজন্যে পার্থ ও অনুব্রত। (এখনও পর্যন্ত, শেষ কোথায় কে জানে!) । আজ যখন রাজ্য দুর্নীতির পচা পাঁকে মুখ লুকোচ্ছে তখন বারবার উঠে আসছে বাম নেতাদের অনাড়ম্বর জীবন যাপনের কথা।
সম্প্রতি সূর্যকান্ত মিশ্রর জীবনধারার যে ছবি সামনে এসেছে, তাতে তৃণমূলের নেতা মন্ত্রীরা ভাবতেই পারেন, এসব হল নীতি কথার সহজপাঠ। কী ছবি প্রকাশ্যে?
কতটা সাদামাটা সূর্যকান্ত মিশ্রর জীবন
নেই এসি, ঘুপচি রান্নাঘর, রংচটা দেওয়াল-ভাইরাল সূর্যকান্ত মিশ্রর বাড়ির এই ছবি। সিপিআইএম নেতাদের দাবি, একজন প্রাক্তন মন্ত্রী এবং একটি দলের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদকের যে এরকম ছিমছাম বাড়ির অন্দর হতে পারে, তা তৃণমূল জমানার নেতা মন্ত্রীদের পক্ষে সত্যিই বিশ্বাস করা কঠিন। অনেকেই বলছেন, আসলে এর সঙ্গে তো তাঁরা পরিচিতই নন। গত বুধবার ১০ অগাস্ট সৌম্যশুভ্র চট্টোপাধ্যায় নামে এক বাম সমর্থক ফেসবুকে সূর্যকান্তকে নিয়ে একটি লেখা পোস্ট করেন। যা `পটাশপুর কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিআইএম’ একটি পেজেও পোস্ট করা হয়। সেই পোস্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে।
পোস্টে কী লেখা
পোস্টে লেখা- `দরজায় বেল বাজাতেই ওঁর স্ত্রী কমরেড ঊষা মিশ্র দরজা খুলে দিলেন। না আছে নিরাপত্তার বেষ্টনী, না আছে দরজার ভেতর থেকে কে এসেছে জিজ্ঞাসা করার বালাই। মেহানতি মানুষের নেতার বাড়ি। সবসময় সকলের অবাধ প্রবেশ। একনজরে দেখে মনে হল, ৬০০-৮০০ স্কোয়ার ফুটের ছোট্ট একটা আবাসন, দু’টো ছোট্ট ছোট্ট রুম, ঘুপচি একটা রান্নাঘর, রান্নাঘরের পাশেই ফাইবারের একটা ডাইনিং টেবিল, হাজার তিনেক দাম হবে হয়তো। তাতে আবার জলের বোতলে অর্ধেকটা ভর্তি। ঠিক যে রুমটায় কমরেড সূর্যমিশ্র বিশ্রাম নেন, সেই রুমের দরজার সোজাসুজি ৩/৫ ফুটের একটা বাথরুম।‘
এটাই প্রাক্তন মন্ত্রীর বাড়ির ইন্টিরিয়ার। এবার কীভাবে কাটান তিনি? বাম সমর্থকের কথায়,
নিজের চোখকে আর বিশ্বাস করতে পারছি না। পরনে গোলগলা একটা গেঞ্জি আর লুঙ্গি। ব্রাত্য বসুদের কথায় (সম্প্রতি তৃণমূলের তরফে অভিযোগ করা হয় সূর্যকান্ত মিশ্র অনেক সম্পত্তি করেছেন) কোটিপতি সূর্য মিশ্র তখন ফ্যানের নিচে। তখন বই পড়ছেন। ঘর জুড়ে বইয়ের ভাণ্ডার। স্প্লিট এসি, উইন্ডো এসি? থাক সেটা আর বললাম না, দেওয়ার থেকে রং খসে পড়ছে। ওঁর বাবার ছবি, ওঁর পুরস্কার পাওয়ার ছবি-জানলার ওপর একটা তাক বানিয়ে সেখানে সাজিয়ে রাখা। কাঁচের অভাবে তাতে ধুলো জমেছে। শ্রদ্ধার পাহাড়টা যেন হিমালয়ে চেয়ে উঁচু হয়ে যাচ্ছে।
কত সম্পত্তির মালিক সূর্যকান্ত মিশ্র?
বামকর্মীর ফেসবুক পোস্টে দাবি করা হচ্ছে, সূর্যকান্ত মিশ্রর সম্পত্তি বলতে দেশের বাড়িতে প্রায় ১০ কাঠা জায়গা পৈতৃক উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। ২০১১ সালে যার বাজারদর ছিল প্রায় ৭-৮ লাখ টাকা। ২০১১ সালে নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া তার স্থাবর ও অস্থাবর (উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির পরিমাণ ধরে) সম্পত্তির পরিমাণ সর্বসাকুল্যে ১৫ লাখ টাকা। কলকাতা পুরসভার সামনে যখন তৃণমূলের কাউন্সিলরদের কোটি টাকার গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে, তখন সূর্য মিশ্রর মতো মানুষের মোটর সাইকেল বা চারচাকাও নেই।
আরও পড়ুন-৪০০ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে জীবন কাটল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের, সততার সহজপাঠ ছিল হাতের কাছেই
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় হলফনামায় জানাতে হয় প্রার্থীর সম্পত্তির পরিমাণ, ২০১৬ সালে সেই সূত্রে জানা যায়, নারায়ণগড়ের জোটপ্রার্থী সূর্যকান্ত মিশ্রর সম্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে সাড়ে সাত লক্ষের কাছাকাছি।
হলফনামা সূত্রে জানা যায়, এই বছরে সূর্যকান্ত মিশ্রর স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ১৮,০২,৫০০ টাকা। তাঁর অস্থাবর সম্পত্তি ৫,৭৭,৯৫৯ টাকা। তাঁর স্ত্রীর অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ২,০০,০০০ টাকা। চলতি বছরে স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে তাঁর মোট সম্পত্তির পরিমাণ ২৫,৮০,৪৫৯ টাকা। গতবছর সূর্যকান্ত মিশ্রর মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ১৮,৩৩,৮৭৩টাকা। তাঁর সম্পত্তি বেড়েছে ৭,৪৬,৫৮৬ টাকা।
সূর্যকান্ত মিশ্র একজন বামপন্থী রাজনীতিবিদ। ২০১১ সালের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বাম-শাসনের অবসান হলেও তিনি তার আসন ধরে রাখতে সক্ষম হন। বাম আমলে সূর্যকান্ত মিশ্র গ্রাম ও গ্রামীণ উন্নয়ন এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১১ সালের নির্বাচনের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় তিনি বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। রাজনীতির আবর্তে কম ক্ষমতাশালী ছিলেন না সূর্যকান্ত মিশ্র। তাহলে এখন প্রশ্ন হল মেহানতি মানুষের নেতা বলেই কি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্ররা মানুষের কাছে দায়বদ্ধ? তাই এমন আড়ম্বহীন, আদর্শে মোড়া প্রাত্যহিক জীবন। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক গুরুদায়িত্ব ঘাড়ে চাপার আগে লম্বা সময় একটাকায় রোগী দেখতেন, গ্রামে গ্রামে চিকিৎসার জন্য ঘুরে বেড়াতেন তিনি। একবার আলিমুদ্দিনে রাজ্যসম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য এক কমরেডকে কার্ডিয়াক ম্যাসাজ দিয়ে প্রাণে বাঁচান তিনি। সে ঘটনা আজও অনেকে মনে করতে পারেন।
এখন নিন্দুকেরা বলতে পারেন, সূর্যকান্ত মিশ্রর জীবনধারা নিয়ে এসব তো সিপিএম সমর্থকের দাবি। জল মেশানো নেই তো? এর জবাবে বলা যায়, ছবি তো আর মিথ্যে বলে না। সূর্যকান্ত মিশ্রর গোলগলা গেঞ্জি পরা যে ছবি সামনে এসেছে, তাতে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে, তিনি জীবনযাপনে অনাড়ম্বর সত্তা বজায় রেখে অন্য বাম নেতাদের ধারা ধরে রেখেছন। প্রাক্তন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান প্রয়াত প্রমোদ দাশগুপ্তরা যে সাদামাটা জীবনের আদর্শ ধরে রেখেছিলেন, তার উত্তরাধিকার বহন করছেন সূর্যকান্ত মিশ্রও।