শুভেন্দু না কানন, পুরনো মমতাকে কে বেশি চেনেন?
Sovan Chatterjee-Suvendu Adhikari: মমতার সঙ্গ ছাড়ার পরে বহু নেতার অবস্থা শোভনের মতো হলেও শুভেন্দু অধিকারী বরঞ্চ থেকেছেন ভিন্ন। রাজনৈতিকভাবে তাঁর গুরুত্ব অন্যসূত্রে বেড়েছে।
“পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল / কাননে কুসুমকলি সকলই ফুটিল।” এই কাননেও কুসুমকলি কি অবশেষে ফুটল! এই কাননও কি জাগ্রত হল আবার! হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, বলছি বৈশাখীময় শোভন চট্টোপাধ্যায়ের কথা। এবার শুভেন্দু-আবহে মমতার হয়ে ব্যাট ধরলেন তিনিই। লক্ষ্মীপুজোর শুভেন্দু-বলে, তৃণমূলের সদ্য প্রাক্তন নেতার মুখেই উঠে এল দিদির স্তুতি। ঠিক কোন প্রসঙ্গে, কী বললেন শোভন?
রবিবার লক্ষ্মীপুজোর দিন কাঁথির শান্তিকুঞ্জে, শান্তি-সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মীর পুজোয় আসেন শুভেন্দু অধিকারী। নিজের বাড়ির পুজোয় অতিথি হিসেবে উপস্থিত বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে পাশে নিয়ে শুভেন্দু বলেন, “নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় তৃণমূলনেত্রী মমতা যে বাড়ি থেকে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, এই বাড়িতেই ছিলেন তিনি। ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামের ঘটনা ঘটেছিল। ওই সময়ে এই বাড়ির ছাদে ছিলেন রাতে। নন্দীগ্রাম না হলে দিদি তো দিদিমা হয়ে যেতেন।”
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা, তথা মমতার একদা প্রিয় শুভেন্দুর এই মন্তব্যের পরেই ঠিক যতটা না তৃণমূল নেতারা সরব হয়েছেন, তুলনায় শোভন চট্টোপাধ্যায় মুখ খুলেছেন বেশি। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেসবুকে প্রোফাইলে একটি ভিডিও পোস্ট করে শোভন বলেন, “আমার মনে আছে রাত সাড়ে ১০টার সময় আমরা কোলাঘাট থেকে চণ্ডীপুরের দিকে বাঁক নিতেই আমাদের গাড়ি আটকে দেওয়া হল। সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি। দেখলাম, চারপাশ থেকে আমাদের ঘিরে ধরেছে বহু মানুষ। তাঁদের হাতে গাঁইতি, কোদাল। তাঁরা বলছেন, পুলিশ-মিডিয়া, কাউকে যেতে দেওয়া হবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেতে পারবেন। দিদিরও জেদ, ‘আমি নন্দীগ্রাম যাবই’। সে দিন আমিই এগিয়ে গিয়েছিলাম। পরিস্থিতি দেখে শুনে নেত্রীকে বলেছিলাম, আপনাকে ওরা মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছে। তাই কাউকে যেতে দেবে না বলছে। আপনি ফিরে চলুন। সেদিন শুভেন্দু চণ্ডীপুরে আসেননি কেন? কোথায় ছিলেন তিনি? নিজেকে তিনি নন্দীগ্রাম আন্দোলনের হোতা বলে এখন দাবি করছেন। মমতাই ওঁকে মন্ত্রী করে নিয়ে আসেন নন্দীগ্রাম থেকে। আমি, আপনি সব ওঁরই হাতে তৈরি। মনে রাখবেন, সৃষ্টি যদি স্রষ্টাকে অপমান করে, তবে স্রষ্টার কিছু যাবে আসবে না। মানুষ সব দেখছে, তাঁরাই বুঝিয়ে দেবেন।”
পুরনো প্রসঙ্গ, নন্দীগ্রাম আন্দোলন এবং মমতার রাজনৈতিক সাফল্যের বর্ণনা দেন শোভন চট্টোপাধ্যায়। আর এখানেই শুরু হয়েছে জল্পনা। এখানেই উঠেছে প্রশ্নও। তাহলে কি একদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছায়াসঙ্গী, বিধায়ক-বেহালার রাজপুত্র শোভন চট্টোপাধ্যায় ফের ফিরছেন নতুন ঘরে! বিজেপিকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানিয়ে শোভন আবার এক হবেন মমতার সঙ্গেই! যদিও ২০১৮ সালের পর থেকেই এক সময়ের দক্ষ কলকাতার মেয়র হঠাৎই পরিবার, ব্যাক্তিগত জীবন, সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং রাজনীতিতে বিতর্কের কেন্দ্রে চলে আসেন। শোভনের জীবনে বৈশাখী-আধিক্যে রত্না এবং রটনায় জর্জরিত হন শোভন। ঠিক এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে প্রাধান্য দিয়ে বেহালা পূর্বের প্রাক্তন বিধায়ক ছাড়েন সব। ঘর, দল, মন্ত্রিত্ব সমস্ত ছেড়ে একপ্রকার নির্বাসন বেছে নেন। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে নতুন সংসার পাতেন তিনি। ফের দিল্লি গিয়ে নতুন দলে যোগ দেন শোভন।
আরও পড়ুন- মমতার সঙ্গে একান্তে কথা! রাজনীতির মূল স্রোতে ফিরছেন মুকুল রায়?
কিন্তু মোহভঙ্গ হয় বিধানসভা নির্বাচনে টিকিট না পেয়ে। বঙ্গ-বিজেপিতে ‘অবহেলিত’ শোভন আবারও ফিরে যান বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। তার মধ্যে গঙ্গা দিয়ে বয়েছে অনেক জল। শোভন-জীবনে সমস্যার সৃষ্টি করেছে নারদ দুর্নীতির অভিযোগ। গ্রেফতার হয়েছেন। হাসপাতালে কেটেছে দিনরাত। প্রেমিকা বৈশাখীর, প্রেমিক শোভনের জন্য জেলের দরজায় ধাক্কা দেওয়া দেখেছে দেশ। তবুও শোভন থেকেছেন অবিচল। নাচ-গান-আড্ডা আর গল্পে নিজেকে রেখেছেন অনন্য, অনন্ত।
আর এদিকে শুভেন্দু, মমতা ছেড়ে পা বাড়িয়েছেন গেরুয়া-গৃহে। শান্তিকুঞ্জের সবুজ প্রলেপ রাতারাতি বদলেছে গেরুয়া রঙে। একদা মমতার কাছের মানুষ হয়েছেন শত্রু! নন্দীগ্রামে মমতাকে ভোটে হারিয়েছেন বিজেপি নেতা। তিনিই হয়ে উঠেছেন রাজ্য বিজেপির সর্বেসর্বা। ঠিক এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে যখন একই পরিবারের এক সদস্য স্রষ্টাকে আক্রমণে মত্ত বারবার, ঠিক সেই অবস্থাতেই আর এক সদস্য স্রষ্টার পাশে দাঁড়াচ্ছেন! নন্দীগ্রামকে কেন্দ্র করে দিদির মুখে ক্ষীর তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন একপক্ষ।
কেন ঘটছে এমন? হঠাৎ শোভন-সক্রিয়তা কি অন্য কোনও ইঙ্গিত করছে? আমরা কথা বলেছিলাম রাজনৈতিক মহলের একাংশের সঙ্গে। তাঁদের দাবি, প্রথমত, শোভন চট্টোপাধ্যায়ের কলকাতার মেয়র পর্ব, দমকল মন্ত্রিত্ব এবং রাজ্যের প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা থাকাকালীন যে অবস্থান, তা এক ধাক্কায় কমেছে। রত্না চট্টোপাধ্যায় এবং বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পর্কের খবর বারবার সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে জনমানসে প্রভাব ফেলেছে। তাই আগের মতো শোভনের জনতার মাঝে অস্তিত্ব আর তেমন নেই!
দ্বিতীয়ত, বিপরীতদিকে, মমতার সঙ্গ ছাড়ার পরে বহু নেতার অবস্থা শোভনের মতো হলেও শুভেন্দু অধিকারী বরঞ্চ থেকেছেন ভিন্ন। রাজনৈতিকভাবে তাঁর গুরুত্ব অন্যসূত্রে বেড়েছে। এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে বারবার শুভেন্দু, অভিষেকের সঙ্গে মমতার নাম করে আক্রমণ করছেন তৃণমূলকে। যা প্রাক্তন কোনও নেতার কাছ থেকে আসায় স্বাভাবিকভাবে অস্বস্তি বেড়েছে সবুজ শিবিরের।
তৃতীয়ত, এদিকে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর খুব একটা হালে জল পাননি শোভন। ক্রমশ আরও নিষ্ক্রিয় হতে হয়েছে তাঁকে। এর সঙ্গেই বিজেপি দলে বৈশাখীর গুরুত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যা তাঁদের দু’জনকেই সরিয়ে এনেছে বঙ্গ বিজেপির কাছ থেকে। এই অবস্থায়, মাত্র ৫৮ বছরেই রাজনৈতিক সন্ন্যাস না নিতে হলে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের যে ফের মাঠে নামার প্রয়োজন নেই, এমন মনে করছেন না কেউই।
ঠিক এই প্রেক্ষাপট এবং শুভেন্দু-আবহে বিজেপিতে গুরুত্ব হ্রাসের ফলপ্রসূ শোভনকে ফেরার তাগিদ নিতে হচ্ছে বারবার! সেখানে সরাসরি মমতা প্রসঙ্গকে উত্থাপন করে এক ঢিলে একাধিক জায়গায় লক্ষ্য ঠিক করতে চাইলেন পোড়খাওয়া এই বঙ্গ রাজনীতিক।
কীভাবে? রাজনৈতিক মহলের ওই অংশের মতে, তৃণমূলের কাছে নন্দীগ্রাম একটি আবেগ। এবং মমতার ক্ষমতা দখলের পথে এক মাইলস্টোন। ঠিক সেই আবেগে যাঁদের অবদান ছিল সেই বন্ধুরা অনেকেই আজ রাজনৈতিক শত্রু! যা মমতার সঙ্গে সরাসরি জড়িত, যা শুভেন্দু অধিকারীকে আক্রমণ করার মূল অস্ত্র হতে পারে। শোভন সেই অস্ত্রকেই নিজের সক্রিয় হওয়ার কেন্দ্রে পর্যবসিত করলেন হয়তো। যাতে মমতার আবেগ এবং শুভেন্দুর দুর্বলতা, একসূত্রে গেঁথে দেওয়া যায়।
আবার একথা সর্বজনবিদিত যে, বেহালা পূর্ব এবং বেহালা পশ্চিমের মধ্যে দলীয় ঠান্ডা লড়াই আগে থেকেই ছিল। অর্থাৎ পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং শোভন চট্টোপাধ্যায়। দু’জনই তৃণমূলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হলেও কে দিদির বেশি কাছের, কার হাতে বেশি নিয়ন্ত্রণ থাকবে, এ নিয়ে বিতর্ক ছিল। এদিকে শোভনের বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও একদা ভালো সম্পর্ক ছিল পার্থর। সেই সূত্রে শোভনের দলত্যাগ এবং শোভন-রত্না মুষলপর্বে মধ্যস্থতা করতে দেখা গিয়েছে পার্থকে। তবুও শোভন ফেরেননি। আবার এই পার্থ গ্রেফতার এবং তাঁর বান্ধবী প্রসঙ্গ উঠতেই সরব হয়েছেন বৈশাখী। অর্থাৎ অনেকেই তখন দাবি করেছিলেন, সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন বৈশাখী।
আরও পড়ুন- প্রকল্প তুমি কার! মমতার দাবি আর শুভেন্দুর নালিশের মাঝে কেমন আছে রাজ্যের উন্নয়ন?
এই অবস্থায় বেহালা পশ্চিমের হাল ধরবেন কে, কাউন্সিলর বাপ্পাদিত্য না নতুন কোনও মুখ, এ নিয়ে তৃণমূলে জল্পনা চলছে এখনও। এদিকে বেহালা পূর্বের বিধায়ক হয়েছেন শোভনের স্ত্রী। সেখানে গিয়ে শোভন আবার কাজ করবেন কিনা, তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
তৃণমুলের দুর্নীতি-অস্বস্তি এবং পার্থর গ্রেফতারির পর্বেই শোভনের সক্রিয়তা নিয়েই জল্পনা শুরু হয়েছে আবার। অনেকেই বলছেন, তৃণমূলে পার্থর মতো শোভনের সঙ্গে কোনও দিন দলীয় স্তরে তেমন মতভেদ ছিল না অভিষেকের। সেই ক্ষেত্রে অভিষেকের দিক থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার বিষয়ে তিনি এগিয়ে।
এদিকে শুভেন্দু-পর্বে মমতার পাশে দাঁড়ানোর আগেই নবান্নে গিয়েছেন শোভন। বৈশাখীকে সঙ্গে নিয়ে মমতার সঙ্গে দেখা করেছেন কানন। ওই সৌজন্য সাক্ষাতের আবহেই কি ঘরে ফেরার কাব্য রচিত হয়ে রয়েছে, এই প্রশ্নের মধ্যেই শোনা যাচ্ছিল ফের ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে আনুষ্ঠানিকভাবে তৃণমূলে যোগ দেবেন এই জুটি। কিন্তু তা হয়নি। কারণ হিসেবে দাবি উঠেছে, এখন আর শোভন একা নন, তাঁর সঙ্গে বৈশাখী রয়েছেন। নিলে এই দু’জনকেই জায়গা, পদ দিতে হবে। যা দলীয় চিন্তাধারা এবং রাজ্যের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দলীয় নেতাদের কথা ভেবেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তৃণমূলকে।
ঠিক এই পরিস্থিতিতে শোভনের দিদির হয়ে মুখ খোলা, তৃণমূলের পাশে দাঁড়ানোয় বঙ্গ বিজেপির মননে প্রাক্তন হয়েছেন শোভন, একথা নিশ্চিত করলেও এখনও তৃণমূলে তিনি স্বাগত একথা বলছেন না তৃণমূল নেতারাও। তবে সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ এবং শোভনের মমতা-স্তুতি যা ইঙ্গিত দিচ্ছে, তাতে কেউ কেউ বলছেন, কাননে বৈশাখী আবহে সবুজ ফুল বিকশিত হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা!