নতুন ভারতে 'গোলি মারো...' বলার বাকস্বাধীনতা আছে, প্রশ্ন তোলার নেই
যখন গোটা দেশকে একপ্রকার ঘাড় ধরে 'আজাদি কা অমৃত মহোৎসব' পালন করানো হচ্ছে, তখন এই 'স্বাধীনতা' শব্দবন্ধটিকে একবার নেড়েচেড়ে দেখে নেওয়া দরকার।
এই ১৫ অগাস্ট গোটা দেশ মেতে উঠবে স্বাধীনতা দিবসের ৭৫ বছর উদযাপনে। সম্প্রতি দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর 'মন কি বাত'-এর ভাষণে গোটা দেশের উদ্দেশ্যে এই আর্জি রেখেছেন, যাতে দেশবাসীরা তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ২ অগাস্ট থেকে ১৫ অগাস্ট অবধি তাঁদের নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলের ডিপিগুলো তেরঙ্গা রাখেন। এই উদযাপনের একটা নামও দেওয়া হয়েছে। 'আজাদি কা অমৃত মহোৎসব'। বেশ ঝাঁ-চকচকে নাম। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, এই বছরের স্বাধীনতা দিবসে তাঁরা দেশের সেই সমস্ত যোদ্ধাদের কথা মনে করতে চান, যাঁদের কথা সচরাচর সামনে আনা হয় না। তবে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে যাঁদের অবদান অপরিসীম।
জানা গেল, এই উৎসবের পাঁচটা থিমও নির্ধারণ করা হয়েছে। থিমগুলিকে গোদা বাংলায় তর্জমা করলে খানিকটা এমন দাঁড়ায়, 'স্বাধীনতা', 'ভাবনা', 'সমাধান', 'কর্ম', 'অর্জন'। এই পাঁচটি থিমকে ভিত্তি করেই এই উদযাপন হতে চলেছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, এগুলি কেবল পাঁচটি মামুলি থিম নয়, এগুলি আদতে মূল মন্ত্র। যার ওপর ভর করে আগামীতে দেশ গড়া হবে।
এহেন হিড়িক-ই আমাদের টের পাইয়ে দিচ্ছে, যে ১৫ অগাস্টের উদযাপন এবার ঠিক কেমন চেহারা নিতে চলেছে।
আরও পড়ুন: গোপনীয়তার নেই মালিকানা! স্বাধীনতার ৭৫-এ ইন্টারনেটের নজরদারিতে বন্দি ভারত
প্রধানমন্ত্রী যে পাঁচটি থিম ঘোষণা করেছেন, তার মধ্যে সবক'টি নয়, মাত্র একটি থিম ধরেই যদি আমরা আমাদের আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি, তাহলে যে ছবিটা সামনে আসবে, তা হয়তো প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে দেখানো 'ভারত'-এর থেকে খানিক আলাদা।
'স্বাধীনতা দিবস', তাই পাঁচটি থিমের মধ্যে থেকে 'স্বাধীনতা' নামক থিমটিকেই বেছে নেওয়া যাক। যখন গোটা দেশকে একপ্রকার ঘাড় ধরে 'আজাদি কা অমৃত মহোৎসব' পালন করানো হচ্ছে, তখন এই 'স্বাধীনতা' শব্দবন্ধটিকে একবার নেড়েচেড়ে দেখে নেওয়া দরকার।
বেশি দূর না। জুলাই মাসের ঘটনা। ১৭ জুলাই ভোর ছ'টায়, ঝাড়খণ্ড পুলিশ সাংবাদিক রুপেশ কুমার সিং-এর বাড়ি পৌঁছয়। সেদিন বেলা অবধি পুলিশ রুপেশকে জেরা করেন। শেষমেশ বেলা ১:৪০ নাগাদ রুপেশকে তাঁরা ইউএপিএ-সহ আরও একাধিক মামলায় গ্রেফতার করেন। পুলিশের অভিযোগ রুপেশ 'সাংবাদিক' মুখোশের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে মাওবাদীদের হয়ে কাজ করছেন। তিনি মাওবাদীদের পলিটব্যুরো সদস্য প্রশান্ত বসুর সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। যদিও এই সমস্ত দাবি রুপেশের স্ত্রী অস্বীকার করেছেন।
রুপেশ কুমার দীর্ঘদিন ধরে আদিবাসীদের একাধিক সমস্যাকে সামনে নিয়ে আসছিলেন তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে। আদিবাসীদের উচ্ছেদ, মিথ্যে মামলা দিয়ে আদিবাসীদের জেলবন্দি করা, তাঁদের মাওবাদী তকমা দিয়ে ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যা করা, ইত্যাদি। সম্প্রতি তাঁর এমনই কিছু রিপোর্ট সচেতন মহলে বেশ সাড়া জাগাতে শুরু করেছিল। ঝাড়খণ্ডের সমস্ত প্রত্যন্ত এলাকার খবর জনসমক্ষে নিয়ে আসছিলেন তিনি।
এই আক্রমণের শিকার একা রুপেশ নন। রুপেশের ঘটনার ক'দিন আগে একইরকমভাবে না হলেও, রাষ্ট্রের হেনস্তার শিকার হন অল্ট নিউজের মহম্মদ জুবেইর। পরিকল্পনামাফিক ছড়ানো ভুয়ো খবরগুলিকে তাঁরা একপ্রকার ফাঁস করে দিচ্ছিলেন। জনগণকে সচেতন করে দিচ্ছিলেন ঘটনাগুলির সত্যতা বিষয়ে। আর সেটাই হলো তাঁর অপরাধ। অতএব, ডাক পড়ল কারাগারের।
যে-কোনও গণতান্ত্রিক কাঠামোর একটা অত্যন্ত জরুরি অঙ্গ বাকস্বাধীনতা। আবার সেই বাকস্বাধীনতার ওতপ্রোত অংশ সাংবাদিকদের স্বাধীনতা। একটা দেশ তার সাংবাদিকদের কতটা স্বাধীনতা দেয়, তা সেই দেশের শাসকের চরিত্র বুঝতে অনেকাংশে সাহায্য করে। এখানে নাম করে রুপেশ, জুবেইরের কথা বললাম। তবে তালিকা এখানে মোটেই শেষ হয় না। এই নামগুলো বাদ রাখলেও একাধিক নাম রয়ে যায়।
তবে এবার স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্নটা আসে, তা হলো, তার মানে কি হালেই বাকস্বাধীনতার এমন দুর্দিন এলো? আগের চিত্রটা কেমন ছিল?
আমরা ফেসবুক প্রজন্মের ভারতবাসী। আমরা যেমন সহজেই কোনও ভয়াবহ খবরে চমকে উঠি, ততোধিক সহজভাবেই সেই ঘটনা ভুলেও যাই। এটা আমাদের স্বভাবে এসে ঠেকেছে। মোদি সরকারের বাকস্বাধীনতা হরণ দেখে আমরা তার আগের জমানাগুলো, নিজেদের রাজ্যের অবস্থা, মাঝেমধ্যে বেমালুম ভুলে যাই।
ঘটনাটি ১৯৭৫-এর। দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন ইন্দিরা গান্ধী। একের পর এক রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। সেই সময় বাংলার এক প্রখ্যাত সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ তাঁর পুত্রকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে তিনি নিজের পুত্রের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন, যে এই জরুরি অবস্থার ফলে সে আর দেশের বাস্তবতাকে তাঁর নিজের লেখায় জায়গা দিতে পারবেন না। এই চিঠি ছড়িয়ে পড়ে। জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে এই চিঠি হয়ে ওঠে এক জোর প্রতিবাদ। ফলত, বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় আর সময় ব্যয় না করে গৌরকিশোর ঘোষকে তাঁর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করেন। সেই সময় গৌরকিশোর ঘোষের সঙ্গে বাংলার আরেকজন সাংবাদিক, বরুণ সেনগুপ্তকেও গ্রেফতার করা হয়। ইংরেজি দৈনিক 'দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস'-এর বিশিষ্ট সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারকেও সে সময় গ্রেফতার করেন ইন্দিরা গান্ধী সরকার।
জরুরি অবস্থা ভারতের ইতিহাসে একটি চিরকালীন ক্ষত। আর যে দেশ জরুরি অবস্থা প্রত্যক্ষ করে ফেলেছে, তাকে মোদি সরকারের পক্ষে নতুন কোনও 'চমক' দেওয়া কঠিন। সরল কথায়, মোদি জমানা সেই সমস্ত জমানারই লালিত শিশুমাত্র।
অন্যদিকে এই দৌড়ে আমাদের রাজ্য-ও বাদ পড়ে না। বাম জামানায় ২০০৯ সালে বাংলা 'পিপলস্ মার্চ' পত্রিকার সম্পাদক স্বপন দাশগুপ্তকে ইউপিএ আইনে গ্রেফতার করে বাম সরকার। পরে জেলবন্দি অবস্থাতেই তাঁর মৃত্যু হয়।
এখানে উল্লেখিত ঘটনার একটি ঘটনাও হয়তো আমাদের চমকে দেবে না। তবে যা ভাববার, তা হলো, স্বাধীনতা দিবসের ৭৫ বছর উদযাপনের পথে আমরা এগোলেও দেশের বাকস্বাধীনতার যে চিত্র সামনে আসছে, তা শিউরে ওঠার মতোই।
তবে কি বলতে চাওয়া হচ্ছে, ভারতে বাকস্বাধীনতা নেই? সাংবাদিকদের সামনে এসে কথা বলার, লেখার স্বাধীনতা নেই?
এর উত্তর খুঁজতে খুঁজতে একটা জিনিস চোখে পড়ল। ২০১৬ সাল। জেএনইউ-তে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন চলছে। সরকার লাগাতার ধরপাকড় চালাচ্ছে। সেদিন উমর খালিদ আর অনির্বাণ ভট্টাচার্য সদ্য জামিনে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে জেএনইউ-এর ক্যাম্পাসে এসেছেন। লাল আবিরে তাঁদের গাল মাখামাখি। ভরা জনতার সামনে উমর খালিদ ভাষণ দিচ্ছেন। তাঁর গোটা ভাষণের মধ্যে বাকস্বাধীনতা প্রসঙ্গে একটি কথা বলেন তিনি, "আমি বিশ্বাস করি না যে, ভারতে বাকস্বাধীনতা নেই। আমি বিশ্বাস করি আছে। অবশ্যই আছে। তবে প্রশ্ন হলো, তুমি কার পক্ষে আছো। বাকস্বাধীনতা তুমি সবসময় পাবে, যদি তুমি ক্ষমতার পক্ষে দাঁড়াও।"
প্রশ্নটা হয়তো সত্যি পক্ষের। উমর খালিদ তাঁর লড়াই দিয়ে একথা টের পাইয়ে দিয়েছেন। তিনি ক্ষমতার সপক্ষে থাকেননি। ক্ষমতাকে লাগাতার প্রশ্ন করে বিব্রত করেছে সে। তাই তাঁকে ইউএপিএ-সহ আরও একাধিক জামিন-অযোগ্য ধারায় জেলে বন্দি রাখতে হয়েছে। অন্যদিকে কপিল মিশ্রর মতো নেতা, যে আন্দোলনকারী এবং সংখ্যালঘুদের উদ্দেশ্য করে 'গোলি মারো শালো কো' স্লোগান তুলেছিল, সে বহাল তবিয়তে বুকে হাওয়া লাগিয়ে কয়েদখানার বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আজ ৭৫ বছর পরেও, দেশের এটাই বাস্তবতা। একাংশের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েই 'আজাদি কা অমৃত মহোৎসব' পালিত হতে চলেছে। এটা আমাদের মানতে হবে, বাকস্বাধীনতা কেবল ক্ষমতার আশপাশেই ঘোরাফেরা করে। আজ-ও তাই করছে। সেদিনও তাই করত।