পছন্দ ছিল না কালীর রুদ্ররূপ, রামকৃষ্ণকেও সহজভাবে নিতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কল্পনার স্রোত উজাড় করে নিজস্ব কালীমূর্তি এঁকেছেন। শিল্পের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন ভাবনাচিন্তার আগল। এখানে মা কালী তাঁর নিজস্ব। একান্তই রাবীন্দ্রিক।
সন্ধ্যা হল গো– ও মা, সন্ধ্যা হল, বুকে ধরো।
অতল কালো স্নেহের মাঝে ডুবিয়ে আমার স্নিগ্ধ করো।।
ফিরিয়ে নে মা, ফিরিয়ে নে গো, সব যে কোথায় হারিয়েছে গো
ছড়ানো এই জীবন, তোমার আঁধার মাঝে হোক না জড়ো।।
মা কালীর রক্তপিপাসু মূর্তি রবীন্দ্রনাথ কখনও পছন্দ করেননি। তাই কাব্যে-সাহিত্যে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নতুন এক দেবীমূর্তির স্বরূপ তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর মা কালী তাই অন্যরকম, স্নেহময়ী! তাই গীতবিতানের পূজা পর্যায়ের এই গানে মা কালীর কাছে আর্তি প্রকাশ পেয়েছে। অতল কালো স্নেহের মাঝে ডুবিয়ে স্নিগ্ধ করার আকুলতা রয়েছে। নেই রক্তপিপাসু কালীর বর্ণনা। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সুন্দরের পূজারী। কালী আরাধনার সঙ্গে জড়িত বলিপ্রথা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর লেখায় বারবার এর বিরোধিতা উঠে এসেছে। সম্প্রতি পরিচালক লীনা মনিমেকলেই মা কালীর মতো এক চরিত্রকে দিয়ে ধূমপান করিয়েছেন। সে-ব্যাপারে প্রচ্ছন্ন মদত দিয়েছেন সাংসদ মহুয়া মৈত্র। এই নিয়ে তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীরা রে রে করে উঠেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, আজকের হিন্দুত্ববাদীদের যে চেহারা, তাঁরা কি রবীন্দ্রনাথের সময় থাকলে তাঁর বিরোধিতায় নামতেন? বিচিত্র কী!
পুরাণ ও তন্ত্রমতে, কালীর বিভিন্ন রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। এই সব রূপের মধ্যে দক্ষিণকালীর বিগ্রহই সর্বাধিক পরিচিত ও পূজিত। দেবীর চার হাতে খড়্গ, অসুরের ছিন্ন মুণ্ড, বর ও অভয়মুদ্রা। তাঁর গলায় রয়েছে নরমুণ্ডর মালা। দেবীর গায়ের রং কালো। মাথায় আলুলায়িত চালু। এবং তিনি শিবের বুকে ডানপা আগে রেখে দণ্ডায়মান। গুণ ও কর্ম অনুসারে শ্রীকালী কালীর আরেক রূপ। অনেকের মতে, তিনি এই রূপে দারুক নামের অসুরকে নাশ করেন। ইনি মহাদেবের শরীরে প্রবেশ করে তাঁর কণ্ঠের বিষে কৃষ্ণবর্ণা হয়েছেন। শিবের ন্যায় ইনিও ত্রিশূলধারিনী ও সর্পযুক্তা।
আরও পড়ুন: কালীকে তুইতোকারি, মুক্ত মনে দেবীর সাধনা করেছিলেন রামকৃষ্ণ
কালীর এই ভয়ংকর মূর্তি মেনে নিতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। তাঁর লেখায় বারবার তিনি বলিপ্রথার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথ কালী বিগ্রহকে খুব সদর্থকভাবে দেখেননি। রবীন্দ্রসাহিত্যে দেবী কালী এসেছেন অন্যভাবে। 'পত্রপূট’ কাব্যগ্রন্থের পনেরো সংখ্যক কবিতায় কালী হয়েছেন `রূদ্রাণী’। সুন্দর যখন অবমানিত হয়েছে, তখন রূদ্রাণীর তৃতীয় নয়ন থেকে বিচ্ছুরিত হয়েছে প্রলয় অগ্নি। 'পরিশেষ’ কাব্যগ্রন্থের `মোহনা’ কবিতায় কালী ও মহাকালের এক আশ্চর্যসুন্দর রূপকল্প খুঁজে পাওয়া যায়।
কালীরে বক্ষে ধরি শুভ্র মহাকাল/
বাঁধে না তারে কালো কলুষ জাল।
কালীর ভয়ংকরী নগ্নিকা মূর্তি রবীন্দ্রনাথের কাছে আকর্ষক ছিল না। হয়তো তাই, স্বদেশ পর্যায়ের এই গানটিতে মা কালীর নবসৃজন করলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, "ওগো মা তোমায় দেখে আঁখি না ফিরে...।"
রাবীন্দ্রিক কালীমূর্তির ডানহাতে খড়্গ, বাঁহাতে শঙ্কাহরণ করছেন। দুই নয়নে প্রেমের হাসি। ললাটনেত্র আগুনবরণ। রবীন্দ্রনাথ নিজে মনের রূপকল্প মিশিয়ে পৌরানিক নগ্নিকা দেবীকে রৌদ্রবসনী বলেছিলেন।
'শক্তিপুজো’ প্রবন্ধে কালীকে তিনি 'দস্যুর উপাস্য’, 'ঠগীর উপাস্য’, 'কাপালিকের উপাস্য’ দেবতা শক্তি বলেছিলেন। 'বাল্মিকী প্রতিভা’ নাটকে ডাকাতদের উপাস্য ছিলেন কালী। সরস্বতীর আশীর্বাদধন্য বাল্মীকি কালীকে ছেড়ে সরস্বতীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। 'বিসর্জন’ নাটকেও জনতা চরিত্র বলে, "মা পাঁঠা পায়নি, এবার জেগে উঠে তোদের এক একটাকে মুখ ধরে পুরবে।"
এই নাটকের শেষে কালীমূর্তি বিসর্জন দেওয়ার মধ্য দিয়ে কালীর রুদ্রাণী চেহারার প্রতি রবীন্দ্রনাথের তীব্র ক্ষোভই প্রকাশ পায়।
বিসর্জনের একই কাহিনি অবলম্বনে লেখা`রাজর্ষি’ উপন্যাসে জয়সিংহ বলছেন,
এই জন্যই কি সকলে তো মা বলে মা, তুই এমন পাষাণী, রাক্ষসী, সমস্ত জগৎ হইতে রক্তনিষ্পেষণ করিয়া লইয়ে উদরে পুরিবার জন্য তুই ওই লোলজিহ্বা বাহির করিয়াছিস? স্নেহ, প্রেম, মমতা, সৌন্দর্য, সমস্তই মিথ্যা, সত্য কেবল তোর ওই অনন্ত রক্ততৃষা!
কালীর উপাসক শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে সহজ হতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। তাঁরা কালীসাধনায় মুক্তচিন্তার ফল্গুধারা বইয়ে দিয়েছিলেন সমাজে। তাও রবীন্দ্রনাথ তাঁর কালী সম্পর্কিত চিন্তাধারা থেকে সরে আসেননি। সিস্টার নিবেদিতার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। আর নিবেদিতা ভেবেছিলেন, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ মিশন আর ঠাকুরবাড়ির সুসম্পর্ক দেশের ও সমাজের জন্য কল্যাণকর। কিন্তু কালীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আর ঠাকুরবাড়ির উগ্র বিরোধিতা আর উন্নাসিক কথাবার্তায় নিবেদিতার মোহভঙ্গ হয়। কালীঘাট মন্দিরে কালী বিষয়ে সুন্দর ভাবনার উপস্থাপনা করেন নিবেদিতা। সেই ভাবনা তাঁর গুরুর কালীসাধনারই প্রকাশ। যথারীতি ব্রহ্মকুল খুব বিরক্ত কালীবন্দনায়। নিবেদিতাকে বলতেন, "মৃত্যুর উপাসনা করো মার্গারেট।"
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি শ্রীরামকৃষ্ণকে আমন্ত্রণ জানিয়েও তা ফিরিয়ে নেন। জানতেন বিবেকানন্দ। বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথের শীতলতার প্রাচীর যেন শ্রীরামকৃষ্ণের ভবতারিণী। ঠাকুরবাড়ির ব্রাহ্মধর্মকে নিয়ে সংস্কার চেষ্টা প্রতিহত হয় দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী আর তাঁর পূজারির কাছে।
দক্ষিণেশ্বরে এসে ঈশ্বরের এক মানবী রূপ খুঁজে পেয়েছিলেন রামকৃষ্ণ। হৃদয়ের গভীর বিশ্বাস নিয়ে তিনি কালীকে `মা’ বলে ডাকেন। অবোধ শিশুর কাছে জগতে যিনি সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য, যাঁর কাছে সব খুলে বলা যায়, যা খুশি আবদার করা যায়, আনন্দ-দুঃখ প্রকাশ করা যায়, তিনিই মা। তবে মা কালীকে 'মা’ সম্বোধনে ছিল না কোনও শিশুসুলভ চপলতা, বরং ঈশ্বর যে সত্যাসত্যই খুব কাছের মানুষ, এই অনির্বচনীয় আপনবোধের প্রকাশ ছিল, ছিল গভীর প্রত্যয়। তাই কালী তাঁর কাছে একাধারে মা, একাধারে মেয়ে।
অনেক আগে থেকেই বাঙালির কাছে কালী মা। আবার মেয়েও। আদরের তুইতোকারি সম্পর্ক। কৌম কৃষিসমাজ থেকে পাওয়া, বাঙালির এ বড় নিজস্ব সংস্কার। সে রূপসাগর খোঁজে অরূপরতন, ইন্দ্রিয়সাধনায় ইন্দ্রিয়াতীতকে। ব্রহ্মসমাজের অনুভবময় নিরাকার ব্রাহ্মভবনা তাঁকে তত টানে না। ব্রাহ্মসমাজ প্রতিমায় অবিশ্বাসী। তবে রবীন্দ্রনাথ সেই অর্থে খাঁটি ব্রাহ্ম ছিলেন না। সেকথা তিনি নিজেও বলতেন। ভানুসিংহের রাধাভাবনা পিছু ছাড়েনি আজীবন। তবে কালীর মাধুরী কোথায় যেন আটকে গেছে তাঁর চিন্তায়। রবীন্দ্রনাথ রামপ্রসাদের সুরকে বলেছিলেন বাঙালির প্রাণের সুর, কিন্তু তাঁর চিন্তা-চেতনায় ছেয়ে ছিল যে কালীভাব, তা প্রকৃতপক্ষে অধরা ছিল কবির ভাবনায়।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কল্পনার স্রোত উজাড় করে নিজস্ব কালীমূর্তি এঁকেছেন। শিল্পের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন ভাবনাচিন্তার আগল। এখানে মা কালী তাঁর নিজস্ব। একান্তই রাবীন্দ্রিক।