রহস্যময় শিশু, কথা বলা পুতুল, এই জঙ্গলগুলিতে রয়েছে অলৌকিকের হাতছানি

মেক্সিকো থেকে জাপান অথবা রোমানিয়া। জঙ্গলের রহস্যের শেষ নেই। এমনকী, ভারতের বিভিন্ন জঙ্গল নিয়েও রয়েছে বিভিন্ন গল্প। আর সেই গল্পগুলির মধ্য দিয়ে রহস্যের আগুনে গা গরম করতে পর্যটকরা ছুটে বেড়াচ্ছেন অন্তহীন।

জ্যোৎস্না আরও ফুটিয়াছে, নক্ষত্রদল জ্যোৎস্নালোকে প্রায় অদৃশ্য, চারিধারে চাহিয়া মনে হয় এ সে পৃথিবী নয় এতদিন যাহাকে জানিতাম, এ স্বপ্নভূমি, এই দিগন্তব্যাপী জ্যোৎস্নায় অপার্থিব জীবেরা এখানে নামে গভীর রাত্রে, তারা তপস্যার বস্তু, কল্পনা ও স্বপ্নের বস্তু, বনের ফুল যারা ভালোবাসে না, সুন্দরকে চেনে না, দিকগবলয় রেখা যাদের কখনো হাতছানি দিয়ে ডাকে নাই, তাদের কাছে এ পৃথিবী ধরা দেয় না কোনোকালেই।

 
জ্যোৎস্নালোকিত রাতে মহালিখারূপের জঙ্গলের প্রেমে পড়েছিলেন বিভূতিভূষণ। তার সেই প্রেম যে কতখানি খাঁটি, তার প্রমাণ মেলে 'আরণ্যক'-এর পাতায় পাতায়। জঙ্গল সম্পর্কে বলতে গেলে নীললোহিত-এর কথা ধার করেই যেন বলতে হয় 'আকাশ কখনো পুরনো হয় না', থুড়ি জঙ্গল কখনও পুরনো হয় না। হ্যাঁ, ঠিকই, দিগন্তছোঁয়া পাহাড় দেখতে দেখতে আমরা যেমন বিস্মিত হয়ে পড়ি, অথবা সমুদ্রের অন্তহীন জলরাশির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ি সুনীল আকাশ আর সুনীল প্রচেতর মেলবন্ধনের রহস্য উন্মোচনে, ঠিক একইভাবে জঙ্গল যেন তার বুকের গভীরে থরে থরে সাজিয়ে রাখে অপার রহস্য। যে রহস্যর অমোঘ আকর্ষণে মানুষ বারবার ছুটে যায় জঙ্গল থেকে জঙ্গলে।

আজ আপনাদের এমনই কিছু জঙ্গলের গল্প বলা হবে যে, জঙ্গলগুলিকে বিশ্লেষণ করতে গেলে একটি কথাই মনে আসে, ভয়ংকর সুন্দর। হ্যাঁ, সৌন্দর্যর নিরিখে যেমন সেইসব অরণ্য অনন্য, তেমনই সেইসব জঙ্গলের আকাশছোঁয়া গাছের আড়াল থেকে রহস্য যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে জঙ্গলপ্রেমীদের। আর সেই ডাকে সাড়া দিয়েও কেউ হয়তো ফিরে আসেন, আবার কেউ বা হারিয়ে যান রহস্যের অতলান্তিকে।

আরও পড়ুন: চৌরঙ্গিতে শোনা যেত গর্জন! কলকাতাতেও মানুষ কাঁপত বাঘের ভয়ে

সুইসাইড ফরেস্ট, জাপান

নামটা দেখে চমকে উঠছেন তো? দাঁড়ান, আরও অবাক হওয়ার বাকি আছে। হ্যাঁ জাপানের এই জঙ্গল কুখ্যাত, আত্মহত্যাপ্রবণ অঞ্চল বলে। ১৯৫০ সাল থেকে জাপানের এই জঙ্গলে আত্মহত্যা করেছেন প্রায় ৫০০-র বেশি মানুষ। কিন্তু কেন এই আত্মহত্যা? আত্মহত্যাপ্রবণ অঞ্চল জানার পরেও আত্মহননকারী পতঙ্গের মতো কেন মানুষ ছুটে যায় এই অঞ্চলে? না, তার কারণ জানা যায় না। কিন্তু বহু পর্যটক দাবি করেন, এই জঙ্গলে এমন কিছু আছে, যা মানুষকে উৎসাহিত করে আত্মহননে। জাপানের মিথোলজিতেও নাকি এই অঞ্চলের অদ্ভুত আচরণ সম্পর্কে উল্লেখ আছে। তবে আত্মহননের এই ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ কিন্তু ধীরে ধীরে জাপান সরকারের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। সুইসাইড ফরেস্ট নামে পরিচিত হলেও জঙ্গলটির প্রকৃত নাম অওকিগাহারা ফরেস্ট।

ট্রায়াঙ্গল অফ ট্রানসিলভেনিয়া
জাপান থেকে এবার চলে আসা যাক রোমানিয়ায়। সালটা ১৯৬৮। হঠাৎই রোমানিয়া সরকারের নজরে এল সংবাদপত্রের একটি অদ্ভুত খবর। রোমানিয়ার রাতের আকাশে নাকি দেখা গেছে ভিনগ্রহীদের। না আমাদের বাংলার মতো ভিনগ্রহীরা সেখানেও কোনও বঙ্কুবাবুর সন্ধান পেয়ে ছিল কি না জানা যায় না, কিন্তু সেই ফ্লাইং সসারের ছবি তুলতে নাকি সমর্থ হয়েছিলেন রোমানিয়ার আর্মির এক সদস্য। রোমানিয়ার সমস্ত প্রথম সারির দৈনিকেও ফলাও করে প্রকাশিত হলো সেই ছবি। সরকার বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর শুরু করতেই চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার মতো তথ্য সামনে এল। যে জায়গায় ইউএফও-টি দেখা গেছে, সেই জায়গাটি পরিচিত ছিল 'ক্লিয়ারিং' নামে। জায়গাটি অবস্থিত হইয়া বাচু ফরেস্টের মধ্যে। জনশ্রুতি অনুযায়ী রোমানিয়ার কোনও মানুষ বা কোনও পর্যটক যদি এই 'ক্লিয়ারিং'-এর মধ্যে একবার পথ হারিয়ে ফেলেন, তাহলে তাঁর পক্ষে ফিরে আসা অসম্ভব। একটি অদ্ভুত গল্প প্রচলিত আছে অঞ্চলটি সম্পর্কে। কী সেই গল্প? একবার এক বছরপাঁচেকের শিশু ভুল করে এই 'ক্লিয়ারিং'-এ নাকি পথ হারিয়ে ফেলে, অনেক অনুসন্ধানের পরেও তার হদিশ মেলেনি। বেশ কিছু বছর পর সেই শিশুটি নিজে থেকেই ফিরে আসে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে বেশ কিছু বছর কেটে যাওয়ার পরেও তার বয়স বাড়েনি। তাহলে কি সময় থমকে আছে রুমানিয়ার এই জঙ্গলে? না কি জঙ্গলের ভেতর ঘটতে থাকে আরও কোনও অলৌকিক ব্যাপার? অদ্ভুত আচরণের জন্য জঙ্গলটি পরিচিত হয় ' বারমুডা ট্রায়াঙ্গল অফ ট্রানসিলভেনিয়া' নামে।

ত্রিচুর ফরেস্ট, ভারত
ভারতের কেরল। রহস্যের গন্ধে গন্ধে আমরা এসে হাজির দক্ষিণের এই রাজ্যটিতে। আর রহস্য-রোমাঞ্চের পাঁচফোড়নে ভারত না থাকলে ঠিক জমে না যেন। কেরলের ত্রিচুর ফরেস্টে নাকি রাতের অন্ধকারে দেখা মেলে সাত-আট বছরের এক শিশুর। কিন্তু কোনও শিশু এই ভয়াল জঙ্গলে নিশাচর প্রাণীদের সঙ্গে দিনযাপন কেন করবে? পরিচয় কী এই শিশুর? না, এরও উত্তর মেলেনি। ফলে উঠে এসেছে অশরীরী তত্ত্ব। অনেকেই নাকি রাতের অন্ধকারে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে সেই শিশুকে। এ কি শুধুই পর্যটকদের মনের ভুল?

দ‍্য আইল্যান্ড অফ দ্য ডলস, মেক্সিকো
খাস শহর কলকাতায় যেমন পুতুলবাড়ি নিয়ে আতঙ্ক আর আগ্রহের শেষ নেই, ঠিক তেমনই মেক্সিকোর বুকে এক জঙ্গলকে ঘিরে ছড়িয়ে রয়েছে হাজারও অলৌকিক কাহিনি, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে পুতুল। হ্যাঁ, এই জঙ্গলের মধ্যে গাছ থেকে ঝুলতে দেখা যায় বিভিন্ন পুতুলকে। আর সেইসব পুতুলের প্রত্যেকটি নাকি অলৌকিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত। আর এর পিছনে রয়েছে এক ভূতুড়ে কাহিনি, যা জানলে গা শিউরে ওঠে আমাদের। মেক্সিকোর এই জঙ্গলে থাকতেন একজন রক্ষী। একদিন পার্শ্ববর্তী নদীতে তিনি দেখতে পান একটি বাচ্চা মেয়ের মৃতদেহ, তার সঙ্গে ছিল একটি পুতুল। জঙ্গলের রক্ষীটি সেই মৃত শিশুর পুতুলটি ঝুলিয়ে দেয় একটি গাছে। আর এরপর এই জঙ্গলে শুরু হয় অশরীরীদের আনাগোনা। একসময় জলে ডুবে মৃত্যু হয় জঙ্গলের রক্ষীটির। কথিত আছে, শিশুটির মৃতদেহ যেখানে ভাসতে দেখা গিয়েছিল, সেখানেই পুনর্বার ভাসতে দেখা যায় জঙ্গলের পাহারাদারের মৃতদেহটি। ভূতবিলাসীদের মতে, এই ঘটনা কাকতালীয় নয় মোটেই। তবে কি অকালে মৃত শিশুটির আত্মা ঘুরে বেড়াত মেক্সিকোর এই জঙ্গলে?

পর্যটকদের দাবি, মেক্সিকোর এই জঙ্গলের পুতুলরা নাকি জীবন্ত। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলে, এমনকী, রাতের অন্ধকারে তারা চলাফেরাও করে। পুতুল ভূতের কথা শুনলে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়।

মেক্সিকো থেকে জাপান অথবা রোমানিয়া। জঙ্গলের রহস্যের শেষ নেই। এমনকী, ভারতের বিভিন্ন জঙ্গল নিয়েও রয়েছে বিভিন্ন গল্প। আর সেই গল্পগুলির মধ্য দিয়ে রহস্যের আগুনে গা গরম করতে পর্যটকরা ছুটে বেড়াচ্ছেন অন্তহীন।

 

তথ্য সূত্র:
আনন্দমেলা পত্রিকা

More Articles