বহিরাগত শেক্সপিয়র! তালমার রোমিও জুলিয়েট নিছক নিব্বা-নিব্বির প্রেম?

Talmar Romeo Juliet Review: ২০০৮ সালে 'চিরদিনই তুমি যে আমার' এবং তৎপরবর্তী 'প্রেম আমার', 'চ্যালেঞ্জ', 'লে ছক্কা'-র মতো ছবিগুলো যে প্রেমের ভাষা দিয়েছিল, তা প্রজন্মান্তরে বয়ে চলে ভিন্ন ভিন্ন স্তরে।

উত্তর কলকাতা এক অন্তর্লীন বোধ, তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'উত্তর কলকাতার কবিতা' প্রসঙ্গে সুকল্প চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথোপকথনে একথা বলেছিলেন প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই উত্তর কলকাতা তার ভূগোল ছাড়িয়ে যেতে পারে। 'তালমার রোমিও জুলিয়েট' বহুদিন পর বাংলা সিরিজে এক স্থানিকতার বোধ দিল। তালমার বদলে রোমিও জুলিয়েট বজবজেরও হতে পারত, শোভাবাজারেরও হতে পারত। এখানে মিলনের সূত্র কেবল মাটির প্রতি, শিকড়ের প্রতি এমন এক প্রেম ও মমতাবোধ, যা তালমাকে নিজের করে তুলতে পারে, নিজের এলাকাকেও করে তুলতে পারে তালমার মতো কোনও অঞ্চল। নিজভূমি এখানে কল্পভূমি হয়ে ওঠে, ভালোবাসার এমনই বিস্তার। উত্তরবঙ্গের তালমাকে চিত্রনাট্যকার দুর্বার শর্মা যেভাবে চিনছেন, তা তাঁর স্বভূমির প্রতি দায়, বিষাদ থেকেই জন্ম নিচ্ছে। তালমা লস্ট আইল্যান্ড হয়ে ওঠে তাই এই সিরিজের চরিত্র সোমনাথ ও তপনের কথোপকথনে। নতুন তালমায় যা ঘটে, তার আড়ালে পুরনো তালমার জন্যই লড়ে যায় এই সিরিজের লিয়াকত, বাদল, মোস্তাক, সোমনাথ, মৌসুমী, শাহিনরা। অন্যদিকে এই প্রজন্মের রানা, জাহানারা, শবনম, দীপ, পাপাই, ইরফানরা এক নতুন তালমার জন্ম দেয়, মৃত্যু দেখে চোখের সামনে। সিদ্দিকীর মতো ডানহাতরা সেখানে খেলোয়াড় হয়ে থেকে যায়।

এইসব চরিত্র দুর্বার শর্মার লেখা ও অর্পণ গড়াই নির্মিত সিরিজ 'তালমার রোমিও জুলিয়েট'-এর। তারও আগে, উইলিয়ম শেক্সপিয়রের। কিন্তু এই গল্প আদতে শেক্সপিয়রের নাও হতে পারত। 'তালমার...' দেখতে দেখতে প্রধান হোঁচট এটাই, শেক্সপিয়র এখানে বহিরাগত। কিছুটা অকারণ ঔপনিবেশিক অনুপ্রবেশই যেন ঘটেছে তাঁর। কারণ, যে বিচ্ছেদ এই গল্পের শেষে স্থায়ী হয়, তালমা নামক ভূখণ্ডটি যেভাবে আবার একা, বন্ধুহীন ও ঘটনাহীন হয়ে পড়ে, তা আদতে রক্তপাত ছাড়াও সম্ভব ছিল। এর কারণ বুঝতে গেলে একটি দৃশ্যের একটু বিস্তারে যাওয়া প্রয়োজন।

আরও পড়ুন- বাংলা সিনেমায় ‘দলিত’ স্বর! যে অভাব পূরণ করল অর্ণ-অনির্বাণ-সোহিনীর অথৈ

সোমনাথ ও তপন দুই বন্ধু। হরিহর আত্মা। একজন পুরনো পারিবারিক শত্রুতা, পারিবারিক ব্যবসা, রাজনীতির টানাপড়েন, দূরত্ব বাড়িয়ে চলা ছোট ভাই ও একটা গোটা প্রজন্ম প্রায়, ক্রমাগত বাবার উত্তরাধিকার বয়ে চলা, স্ত্রীয়ের অবিরত সমর্থন সব পিতৃতান্ত্রিক টিপ্পনি সত্ত্বেও— এই চেনা পুরুষ ছকে আটকে গিয়েছে। আরেকজন ব্যবসায়ী, সফল নয়, ক্ষুদ্র সংসারী আবর্তে খুশি, বন্ধু অন্তপ্রাণ, স্বল্পভাষী, কিন্তু চাইলে হাতে বন্দুক ধরতে পারে। এই দুই বন্ধু, তালমার নানাবিধ কেলেঙ্কারির মধ্যেই শান্তিতে দু'দণ্ড বসে এক সন্ধেবেলা। পানু সিডি, গোপন সিনেমা অভিযান, স্কুলবেলার বৃত্তান্ত নিয়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করে। চুপচাপ। স্তিমিত। শত দমচাপা সাসপেন্স, এই বুঝি খুনখারাপি হয় হয়-এর মাঝে তারা তাদের ছোটবেলার রোমন্থন করে। আর সেই রোমন্থন এক অন্য বাংলা সিনেমা-দুনিয়ার গল্প বলে, যেখানে 'বাংলা বই' হয়ে ওঠে হারিয়ে যাওয়া তালমা, হারিয়ে যাওয়া সেই শৈশব, 'নেই পথ নেই হারিয়ে গেছে সে দেশ'-এর এক অলীক 'ঘরে ফেরার গান'। সন্ধের অন্ধকারের ওই স্মৃতিচারণ একঝলক মনে করাবে, ব্রাত্য বসুর 'সিনেমার মতো'-র শেষ দৃশ্য, যেখানে মূল চরিত্র বলে সেইসব হারিয়ে যাওয়া প্রযোজকদের কথা, এবং তার সূত্র ধরেই বাংলা সিনেমার বদলে যাওয়ার গল্প উঠে আসে। মূলধারার অনভিজাত অপেরা থেকে হঠাৎই ঝকঝকে, মসৃণ হয়ে ওঠা বাংলা ছবির বদল, আদতে সমাজের অভ্যন্তরীণ বদলগুলোকেই চিহ্নিত করে ফেলে না কি?

'তালমার রোমিও জুলিয়েট'-এর প্রতিটি এপিসোডের নাম যদি দেখা যায়, শেক্সপিয়র সেখানে অনূদিত হয়েছেন বাংলা গানের বিবিধ কলি-তে। সেসব গান এবং সেসব বাংলা ছবি ছিল যত না শহরের, তার চেয়েও বেশি মফসসলের। হয়তো সাবেক কলকাতার যতটা, ততটা ঝলমলে নতুন আইটি কলকাতার নয়। ২০০৮ সালে 'চিরদিনই তুমি যে আমার' এবং তৎপরবর্তী 'প্রেম আমার', 'চ্যালেঞ্জ', 'লে ছক্কা'-র মতো ছবিগুলো যে প্রেমের ভাষা দিয়েছিল, তা প্রজন্মান্তরে বয়ে চলে ভিন্ন ভিন্ন স্তরে। সেসব ছবির নায়ক-নায়িকাদের আমরা কখনওই তথাকথিত 'সিরিয়াস' কাজে আশা করিনি। কিন্তু খোদ শেক্সপিয়রের নায়ক-নায়িকাকে, হালের লব্জে যাদের 'নিব্বা-নিব্বি' বলে, তেমন চরিত্রে অ্যাডপ্ট করার ভাবনাটা সচেতন বলেই মনে হয়েছে এই কাজে। তারা আদতে তাদের আগের দুই প্রজন্মের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটায়, রক্তপাতের অনিবার্যতাকে বহন করেই।

তাই শেক্সপিয়র কেবলই এই গল্পের বহিরঙ্গমাত্র, অন্তরঙ্গে এই কাজ 'লোকাল'। এই সিরিজের প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পরিবারের একটি মজুমদার পরিবার, সেই পরিবারের বেকারির ব্যবসা। সেই ব্যবসার স্লোগানে বলা হয়, 'দামে লোকাল, মানে গ্লোবাল'। সিরিজের গোড়াতেই সেই দেওয়ালের সামনে দেখা যায় বিষাদমন্থর এক শূন্যতা। কিন্তু ওইখানেই সিরিজের অ্যান্থেম প্রতিষ্ঠিত হয়। 'লোকাল'-এর তরফ থেকে গ্লোবালের চরণে পেন্নাম ঠুকেই যেন এই লোকায়ত পালা শুরু হয়। শুরুতেই ভিনভাষী জাদুকরের উপস্থিতি বা দীপ আর পাপাইয়ের বিদূষক হয়ে দেখা দেওয়ায় যে নাট্যপরিস্থিতি তৈরি করা হয়, তাকে চুপিসারে বাকি চিত্রনাট্য ও সিরিজে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু একইসঙ্গে এই সিরিজের শরীরে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই চলে আসে জাল আধার কার্ড, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের নীরব চাপ। যে ট্যুরিজম উত্তরবঙ্গের অন্তরকে দীর্ঘদিন দূরত্বে রেখে দিয়েছে, সেই ট্যুরিজমের আভাস সিরিজ জুড়েই পাওয়া যায়, তপনের সূত্রে। অথচ এই হাতা গোটানো, দাঁত কিড়মিড়, ঘোড়া টেপার বাস্তব থেকে তপন দূরে যখন যেতে চায়, তখন সে দিঘায় বেড়াতে যেতে চায়। এই স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ীদের এড়িয়ে শহর থেকে আসা পর্যটন মাফিয়ারা ঝাঁ চকচকে হোটেল বা হোমস্টে বানিয়ে এলাকা দখলের যে ছক তৈরি করেন, তার কাছেই শেষত যাবে 'ট্যুরিস্ট'-রা, যারা রয়েল বেঙ্গল-শূন্য ডুয়ার্সে বাঘ দেখতে না পেয়ে নালিশ করে তপনের এজেন্সিতে। অনুন্নয়ন, ঘুষ, দুর্নীতিতে মজে থাকা তালমার রাজনীতির ছবি ভাঙা রাস্তায়, খেত-মাঠের ক্যানভাসে যখন ফুটে ওঠে, তখন সেই রাজনীতির প্রতিনিধি বসে থাকে একেবারেই অ-নান্দনিক অথচ বড়লোকি সুইমিং পুলে, তাকে ধরা হয় টপ শটে।

আরও পড়ুন- সিনেমায় মাসল পাওয়ার আর রুচি হাত ধরাধরি করে চলতে পারে না: ইন্দ্রাশিস আচার্য

মজুমদার পরিবারকে যতটা ভালোবাসা, মমতায় ঘিরে রাখা হয়, ততটাই ঘিনঘিনে নিপীড়ন, অবদমন, বিশ্বাসঘাতকতার আখড়া হয়ে থাকে চৌধুরী-বাড়ি। কিন্তু এই পরিবারের সবচেয়ে খতরনাক শয়তান যে মোস্তাক, তার প্রবল পুরুষালি উপস্থিতির বিপরীত চেহারা দেখা যায় তার অতীতে। শাহিন বা মৌসুমীরা এই পরিবারের মজবুত কাঠামোকে ধাক্কা দিতে চায়। আদতে মোস্তাকও কি তাই চেয়েছিল?

অনির্বাণ ভট্টাচাৰ্যর মতো দুঁদে অভিনেতাকে এমন চোস্ত ভিলেনের চরিত্রে সচরাচর পাওয়া গেছে কি? চাহনিতেই এই চরিত্র বহন করেছেন তিনি, সে ত্রাস হয়ে ওঠা হোক বা বিষাদের সরগম। পায়েল দে, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, জয়দীপ মুখোপাধ্যায়দের পোক্ত অভিনয়ের পাশাপাশি অনুজয় চট্টোপাধ্যায়, দুর্বার শর্মার জুটির অভিনয় পাওনা হয়ে থাকল। অনুজয় ও দুর্বার তাঁদের চরিত্রকে ভালোবাসিয়েছেন। বুদ্ধদেব দাসকে আমরা যাঁরা মঞ্চে দেখেছি, তাঁরা আরও উৎসুক হয়ে উঠলাম, ক্যামেরার সামনে তাঁকে আরও বেশি করে দেখতে চেয়ে। উজান চট্টোপাধ্যায়, ডানা রায়, শিলাদিত্য চট্টোপাধ্যায়, অর্ক সেন, রাজু ধর, দেবদাস ঘোষ— এঁদের অভিনয়ের পরিসর দিক বাংলা ইন্ডাস্ট্রিও। অন্তত এই ভালো অভিনেতাদের চেনানোর জন্যই এই সিরিজের প্রতি বিতৃষ্ণ হচ্ছেন যেসব দর্শক, তাঁরা ক্ষমাসুন্দর হয়ে উঠতে পারেন। উজান তাঁর বয়সে যে শক্তিশালী অভিনয় করেন, তা দুর্লভ। সমঝদাররা জানেন, নিস্পৃহতা ও রসসঞ্চারে অমন নিপুণতা সহজে আসে না। দেবদত্ত রাহা ও হিয়া রায়ের এই রিল-জুটি আরও পরিণত হোক, এই কামনা থাকবে। পরিচালক অর্পণ গড়াইয়ের পরবর্তী কাজ নিয়ে আগ্রহ থাকবে, কৌতূহল থাকবে। সৌমিক হালদারের ক্যামেরা, দেবরাজ ভট্টাচাৰ্য, শুভদীপ গুহদের সংগীতের সঙ্গে এই নতুন প্রজন্মের মণিকাঞ্চনযোগ প্রাপ্তি হয়ে থাকল এই সিরিজে।

উত্তরবঙ্গের প্রতি আন্তরিক এই সিরিজ বাংলা কাজকর্মের জগতে এক অন্য বার্তাও বটে। স্থানিকতার মধ্যে সৎ থেকে যদি কালজয়ী কাজ নাও করা যায়, তাও সেই কাজকে স্বাগত জানাতে দ্বিধা করব না, সিন্থেটিক মহৎ সিনেমার নামে অশ্বডিম্ব প্রসবের বাংলা বাজারে তা আদতে প্রশান্তিই দেবে।

More Articles