ছাত্ররা টেনে নিয়ে গিয়েছিল শিক্ষকের জুড়িগাড়ি, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের যে কাহিনি জানে না অনেকেই
ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন।
সাল ১৯২১, মাইসোরের ঐতিহ্যশালী মহারাজা কলেজে মহাসমারোহে এক অনুষ্ঠান পালিত হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরাও খুব খাটাখাটনি করে অনুষ্ঠান করছে ঠিকই কিন্তু মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাদের মন ভালো নেই। তাদের সবচেয়ে প্রিয় অধ্যাপক মাইসোর ছেড়ে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছেন। অনুষ্ঠানের পর বাইরে বেরিয়ে অধ্যাপক দেখলেন তাঁর জন্য সুন্দর ফুল দিয়ে সাজানো জুড়িগাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু অবাক করার বিষয় হল সেখানে কোনও ঘোড়া লাগানো নেই। খানিক পরেই দেখা গেল ঘোড়ার জায়গায় ছাত্ররা নিজেরাই সেই জুড়িগাড়ি টেনে নিয়ে যাচ্ছে স্টেশন পর্যন্ত। যাওয়ার পথে রাস্তায় সকলে সেই অধ্যাপককে প্রণাম জানাচ্ছেন। কে ছিলেন এই যুবক অধ্যাপক? তিনি ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন।
ভারতবর্ষ জ্ঞানী, পণ্ডিত, দার্শনিক, সমাজ সংস্কারকদের ভূমি। তাঁদের মধ্যে এক উল্লেখযোগ্য নাম ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি এবং দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন। ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন। তিনি সর্বদা মনে করতেন– “শিক্ষকদের দ্বারাই দেশের ভবিষ্যৎ ভিত্তি মজবুত হতে পারে।" সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন ১৮৮৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির থিরুত্তানিতে এক তেলেগু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম ছিল সর্বপল্লী বীরস্বামী এবং মায়ের নাম সীতাম্মা। রাধাকৃষ্ণনের বাবা ছিলেন পণ্ডিত ব্রাহ্মণ, তিনি রাজস্ব বিভাগে কাজ করতেন। তাঁর মা ছিলেন গৃহিণী, বাড়ির সমস্ত কাজকর্ম সামলাতেন তিনিই। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের শৈশব কাটে মোট পাঁচ ভাই ও এক বোনের সঙ্গেই। পরবর্তীকালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন ১০ বছরের শিবকামুকে বিবাহ করেন। স্ত্রী তেমন শিক্ষিত না হলেও তেলুগু ভাষায় তাঁর দখল ছিল বেশ ভালো।
শৈশব থেকেই রাধাকৃষ্ণনের মধ্যে অদম্য জ্ঞানের তৃষ্ণা দেখা গিয়েছিল। ছোটো থেকেই বেশ বুদ্ধিমান ছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর বাবা চেয়েছিলেন ছেলেকে ইংরেজি না শিখিয়ে সংস্কৃত ভাষায় পড়াশোনা করিয়ে একজন পুরোহিত তৈরি করবেন। কিন্তু তরুণ এই ছেলের জন্য জীবন অন্য কিছুই পরিকল্পনা করে রেখেছিল। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার শুরু করেন তিরুপতিতে অবস্থিত লুথেরান মিশন নামক একটি একটি খ্রিস্টান মিশনারি প্রতিষ্ঠানে। ১৯০২ সালে, তিনি ম্যাট্রিকুলেশন স্তরের পরীক্ষায় ভালো নম্বরে উত্তীর্ণ হন যার জন্য তাঁকে একটি বৃত্তিও দেওয়া হয়েছিল। এরপর ১৯০৪ সালে কলা বিভাগের পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ভেলোরের ভুরহিস কলেজে যোগ দেন। ১৭ বছর বয়সে মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজে (মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত) যোগদান করেন তিনি। সেখান থেকে তিনি ১৯০৭ সালে স্নাতক হন এবং একই কলেজ থেকে তাঁর মাস্টার্সও শেষ করেন।
সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন তাঁর স্নাতকোত্তর শেষ করার পর মাত্র ২০ বছর বয়সে প্রেসিডেন্সি কলেজে দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯১৬ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত তিনি মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে দর্শনের সহকারী অধ্যাপক হিসেবেও কাজ করেন। ১৯১৮ সালে মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ঐতিহ্যশালী মহারাজা কলেজে দর্শনের অধ্যাপক হিসাবে নির্বাচিত করে। ১৯২১ সালে রাধাকৃষ্ণন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক মনোনীত হন। ১৯২৩ সালে ডক্টর রাধাকৃষ্ণনের বই 'ভারতীয় দর্শন প্রসাদ' প্রকাশিত হয়। তিনি ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও দর্শনের অধ্যাপনা করেন। ১৯৩১ সালে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর বা উপাচার্য পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছিলেন। ১৯৩৯ সালে তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন এবং ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত এই পদেই ছিলেন।
আরও পড়ুন- একচিলতে ঘরেই কেটে গেল জীবন, এনার্জিতে আশি বছরের বৃদ্ধ বিমান লজ্জায় ফেলবেন তরুণদেরও
ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন শিক্ষকতার সুদীর্ঘ জীবন কাটানোর পর ১৯৪৭ সালে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর অনুরোধে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। সর্বপ্রথমে নেহরু ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনকে ইউরোপ এবং আমেরিকার বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠান।
সেখান থেকে ফিরে এলে নেহেরু রাধাকৃষ্ণনকে বিশিষ্ট রাষ্ট্রদূত হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কূটনৈতিক কাজ করার আহ্বান জানান। শোনা যায়, এই সময়ে স্তালিনের সঙ্গে বৈঠক করতে গিয়ে একবার নাকি স্তালিনের ফোলা ফোলা গাল ধরে টেনে দিয়েছিলেন সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন। ব্যাপারটাতে প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরে বেশ আমোদিতই হয়েছিলেন স্তালিন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে ভারত-রুশ বন্ধুত্বের সূত্রপাত এখান থেকেই। এরপর ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত গণপরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তাঁর সরল এবং খাঁটি আচরণের সকলের প্রিয় ছিলেন রাধাকৃষ্ণন।
এরপর ১৩ মে, ১৯৫২ থেকে ১৩ মে, ১৯৬২ পর্যন্ত দেশের উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন রাধাকৃষ্ণন। তাঁকে উপরাষ্ট্রপতি করাতে অন্যান্য নেতারা হতবাক হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন নিজের কর্মদক্ষতার মাধ্যমে সবাইকে ভুল প্রমাণ করেন। মনে করা হয়, এখনও পর্যন্ত রাজ্যসভার সবচেয়ে দক্ষ সঞ্চালক ছিলেন ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনই। ১৯৬২ সালের ১৩ মে ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। শোনা যায়, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনকে ১৯৫৭ সালেই দেশের রাষ্ট্রপতি করতে চেয়ে ছিলেন জওহরলাল নেহেরু। কিন্তু তৎকালীন রাষ্ট্রপতি পণ্ডিত রাজেন্দ্র প্রসাদ আরেকটি মেয়াদ চেয়ে বসেন। তাঁর সমর্থনে ছিলেন আবুল কালাম আজাদ, গোবিন্দবল্লভ পন্থ, মোরারজি দেশাইয়ের মতো নেতারা। ফলত আরও ৫ বছর অপেক্ষা করতে হয় সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনকে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর কার্যকাল ছিল বেশ রোমাঞ্চকর। তিনি সম্ভবত ভারতের একমাত্র রাষ্ট্রপতি যিনি দু’টি যুদ্ধ দেখেছেন, দুই প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছেন এবং চার দফায় তিনজনকে (গুলজারিলাল নন্দা, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, ইন্দিরা গান্ধি) দেশের প্রধানমন্ত্রীর শপথ পাঠ করিয়েছেন।
আরও পড়ুন- মহিলাদের চুলেই ছিল পাচারের রাস্তা! কোথা থেকে এল ‘খোঁপা’ শব্দটি
পেশায় একজন শিক্ষাবিদ ছিলেন ড. রাধাকৃষ্ণন। রাজনীতিতে প্রবেশ করে স্বাধীনতার পর ভারতের শিক্ষানীতি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। ১৯৬২ সাল থেকে ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন সর্বসম্মতিক্রমে প্রতি বছর শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এর আগে প্রতিবছর গুরু পূর্ণিমায় শিক্ষক দিবস পালিত হত। ওই একই সময়ে ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনকে ব্রিটিশ আকাডেমির সদস্য করা হয় এবং ইংল্যান্ড সরকার তাঁকে অর্ডার অব মেরিটে ভূষিত করে। ১৯৭৫ সালের ১৭ এপ্রিল চেন্নাইয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহান মানুষটি।