জীবনের মহাসমুদ্রে দুই গুরু যেন কলম্বাসের সেই কম্পাস...

Teachers' Day 2023: দুঃখ ডাকুক বা শোক, সেই দুঃখ যেন নিজের বাড়ির পাশের ময়ূরাক্ষী কিংবা কোপাই নদীর বালিতেই শুয়ে শুকাতে পারি, সেই শিক্ষা আমায় দিয়েছেন তাঁরা। আমার ভিতরের আমিকে চিনতে তাঁরাই শিখিয়েছেন।

শিক্ষক নাকি গুরুদেব? এ দ্বন্দ্ব আজকের নয়।  ব্যক্তিগত মনে হওয়া থেকেই যদি বলি, তাহলে বলতে হয়- সব গুরুদেবই শিক্ষক কিন্তু সকল শিক্ষক হয়তো গুরুদেব হয়ে উঠতে পারেন না। সবার আমি ছাত্র, তবুও জীবনে কিছু কিছু মানুদের সংস্পর্শে এলেই হাঁটুমুড়ে বসতে ইচ্ছে করে, দু-দণ্ডের ছায়া পাবো বলে মনে হয়। ছাত্রেরা পথিক,দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া বাকি তাদের। সে কথা জেনেই হয়তো পথের দু'ধারে স্নেহচ্ছায়া বিছিয়ে দেন তাঁরা। আর সেই দানের অছিলায় আদতে পুষ্ট করেন আমাদেরই। দেবগুরু বৃহস্পতি। অদ্ভুত ব্যাপার বলব না কাকতলীয় জানি না, আমার জীবনের সেই দুই গুরুর নাম সুব্রত নাগ ও দেবগুরু বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে আমি নিজেকে অতিমানব বা মহামানব বলে মানে উঠতে চাইছি না মোটেই। বরং সাধারণ মানুষ থেকে মানবতার চাষ আজীবন কীভাবে করে যেতে হয়, সেই পাঠ, সেই শিক্ষা পাওয়া আমার তাঁদের কাছ থেকেই।

আরও পড়ুন: বিমলাকে ‘শিক্ষা’ দিলেন না নিখিলেশ, পদাবলির বিরহকে ঘরে-বাইরে মিশিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ

কোনিরা আজীবন সাঁতরাবেই কিন্তু ঐ যে সেই মোক্ষম সেই শব্দবন্ধ 'কোনি ফাইট', যা আজ কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছে ক্রমশ। সেই শব্দেপ বিনির্মাণ বোধহয় করে দিয়েছিলেন তাঁরা প্রথম দর্শনে। সবাই স্রোতের অনুকূলে সাঁতরাবে,কিন্তু প্রিয় মাস্টারমশাই ধরিয়ে দিলেন,কোনির পর ঐ ছোট্ট অথচ কী ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ 'ফাইট' শব্দটি। যেখানে মিশে গেল স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতরানোর সাহস ও পরিশ্রমী শক্তির কথা। শিখিয়ে দিলেন, স্রোতের অনুকূলে গেলে মোহনা পাবেই। আর সেখানে সবাই সমান, বহমানতার ক্লান্ত ও দূষণ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। ফাইট বা লড়াইয়ের কোনও বোধ নেই,গা ভাসিয়ে দিলেই হল। অথচ প্রতিকূলে গেলে উৎস পাওয়া যায়, মানে যাকে বলে আখর আর কী!

বাঁধা ছকে আটকে না থেকে দিগন্তের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে শিখিয়েছেন আমার ওই দুই শিক্ষক, বলা ভালো গুরু। আমার মতো ছাত্রের কাছে ওঁরা দু'জন ঠিক সুনির্মল বসুর কবিতার"খোলা মাঠের মত"। আমাদের মনের সংকীর্ণতার অচলায়তন আদতে ভাঙে জ্ঞানের আলোয়। আর সেই আলো দিয়েই বাধার পাথার ভেঙে খোলা মাঠের মতো এক মনন তৈরি করেছেন তাঁরা আমার ভিতরে, যা দিয়ে আমি বা আমরা সভ্যতার রথচক্র সচল রাখতে শিখেছি। একটু আগেও পথের কথা বলছিলাম,যদি সেই পথ জলজ মহাসমুদ্র হয়ে থাকে দেবগুরু ও সুব্রত মহাশয় হলেন কলম্বাসের সেই কম্পাস।

আরও পড়ুন: শিক্ষায় এগিয়ে মেয়েরা, তাও কেন এই রাজ্যে কোনও মহিলাই ভোট পান না নির্বাচনে?

শিক্ষা মানে শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়। তাই নিজের মাটিকে চিনতে শিখতে বলেন তাঁরা। দুঃখ ডাকুক বা শোক, সেই দুঃখ যেন নিজের বাড়ির পাশের ময়ূরাক্ষী কিংবা কোপাই নদীর বালিতেই শুয়ে শুকাতে পারি, সেই শিক্ষা আমায় দিয়েছেন তাঁরা। আমার ভিতরের আমিকে চিনতে তাঁরাই শিখিয়েছেন। মস্ত এক আয়নার সামনে একা দাঁড় করিয়ে বলেছেন,'চিনতে পারছ?' এ যেন এক আয়নাবাজি! এই শব্দটি সচেতন এবং সদর্থক অর্থেই ব্যবহার করলাম। ছাত্রের নিজস্ব রাজনীতি থাকা যে আবশ্যিক এবং সেটা কোনও ভাবেই সরাসরি সংসদীয় রাজনীতি নয়, সে-ও বাতলে দিয়েছেন তাঁরা। জয় গোস্বামী একবার তার 'জয়ের শক্তি' বইতে বলেছিলেন, "শিল্পকে অর্জন করে নিতে গেলে তার একটা ধকল আছে।" লিনিয়াসের এনিম্যাল কিংডমের মতোই এই ধকলেরও স্তরবিন্যাস বা শ্রেণীবিন্যাস করে ও বুঝিয়ে,আমার গুরুরা বাজার ব্যবস্থার জুতোতে কীভাবে পা গলাতে হয় বিনা ফোস্কায়, তারও একটা সম্যক ধারণা দেন। তাই এখনো এই আর্থসামাজিক পরিস্থিতি দাঁড়িয়ে বলে উঠতে ইচ্ছে করে-


"তীরে কী প্রচন্ড কলরব
জলে ভেসে যায় কার শব
কোথা ছিল বাড়ি?
রাতের কল্লোল শুধু বলে যায় আমি স্বেচ্ছাচারী।"

More Articles